কলকাতারাজ্যের খবর

‘উৎসবে ফিরছি না’, সমাজের প্রান্তিক মানুষদের বাদ দিয়ে ‘জাস্টিস’ সম্ভব!

'I am not returning to the festival', 'Justice' is possible by excluding the marginal people of the society!

Truth of Bengal, বিকাশ ঘোষঃ আগামী মঙ্গলবার বিশ্বকর্মা পুজো। এ বিশ্বকর্মা পুজো থেকেই কার্যত দুর্গাপুজোর আমেজ গায়ে মাখবেন আমবাঙালি। বাংলার দুর্গাপুজো সীমানার সীমারেখা ছাড়িয়ে আজ বিশ্বজনীন। ভারতবর্ষের প্রত্যেকটি রাজ্যে যেমন দুর্গা পূজার আয়োজন হয় তেমনি বিশ্বের অধিকাংশ দেশেই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে ব্রিটেন, ইতালি থেকে জার্মানি, সমুদ্র সৈকত কিংবা পাহাড়ের কোলে সর্বত্রই মা দুর্গার ব্যাপ্তি। দুর্গা পুজোকে ঘিরে ব্যবসা-বাণিজ্যের বিশ্বায়নও ঘটে।

সে সংস্কৃতির ক্ষেত্রে হোক বা বাণিজ্যে। সারা বছর এই পুজোর জন্যই কোটি কোটি মানুষের অপেক্ষমাণ চোখ চেয়ে থাকে। আরজি করের তরুণী চিকিৎসকের ধর্ষণ ও খুনের ঘটনার প্রেক্ষিতে প্রতিবাদের ঝড় বইছে। জুনিয়র ডাক্তাররা কর্মবিরতি চালিয়ে যাচ্ছেন। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ পর্যন্ত অমান্য করে অনড় রয়েছেন আন্দোলনে। স্বাস্থ্য ভবন অভিযান থেকে লালবাজার অভিযান বা রাস্তায় প্রতিবাদ লাগাতার চলছে। মহিলারা রাত জাগো কর্মসূচি পালন করছেন।

এই ইস্যুতে যখন বঙ্গজুড়ে প্রতিবাদের ঝড়, তিলোত্তমার বিচারের দাবিতে সোচ্চার মানুষ তখন দরজায় কড়া নাড়ছে সর্বজনীন দুর্গোৎসব। কয়েক মাস আগে থেকেই সর্বত্রই পুজো উদ্যোক্তারা শুরু করে দিয়েছেন প্রস্তুতি। সেই প্রস্তুতি আরও গতি পেয়েছে দিন যত এগিয়ে আসছে। বাকি যে কটা দিন রয়েছে আর সময় নষ্ট নয়। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী থেকে ঢাকি, ইলেকট্রিশিয়ান থেকে শোলা শিল্পী, প্যান্ডেলের কর্মী থেকে ঘুগনিওয়ালা – প্রত্যেকের চোখে এখন রঙিন স্বপ্ন। এই দুর্গাপুজোর কটা দিন তাদের কাছে সারা বছরের রুটি রুজির আসল সময়।

এরই মধ্যে সামাজিক মাধ্যমে আরজি কর ঘটনার সঙ্গে পুজোকে কেমন তালগোল পাকিয়ে দেওয়া হচ্ছে। অবশ্য কয়েকটা পুজো সংগঠন শুরুটা করেছিল আগেই। রাজ্য সরকারের দেওয়া অনুদান ফিরিয়ে দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছিল। এবার সামাজিক মাধ্যমে অনেকেই অতি সক্রিয় হয়ে উঠেছেন পুজো বয়কট করতে। এ ধরনের পোস্ট করছেন অনেকেই, “উৎসবে ফিরছি না”। শুধু এখানেই থেমে নেই, সামাজিক মাধ্যমে এই নিয়ে জোরদার প্রচারও চালাচ্ছেন তারা। অবশ্য পাল্টা প্রতিবাদও ফিরে আসছে তাদের দিকে।

উৎসবে ফিরে আসার বার্তা দিয়ে তাদের বক্তব্য, “গরিবের উপকার মহৎ কাজ সঙ্গে তিলোত্তমাও বিচার পাক।” যাঁরা বলছেন “উৎসবে ফিরছি না”…. একদম ঠিক, উৎসবে ফিরবেন না। একদম না। উৎসবের একমাস ছুটিতে থাকবেন। পরিবার নিয়ে বেড়িয়ে পড়বেন কোথাও ঘুরতে! সময়টা বেশ কেটে যাবে! একদম উৎসবে ফিরবেন না! আমার পাড়ার অর্জুন কাকা সারা বছর প্রত্যাশায় থাকেন ঢাকের বায়না পাবেন বলে। পুজোর কটা দিন ঢাক বাজিয়ে যা রোজগার হয় তাতে বেশ কয়েক মাস চলে যায়। কালী পুজোটা ছেলেমেয়েদের নিয়ে খুব আনন্দে কাটান অর্জুন কাকা।

বউটার নতুন একটা শাড়ি হয়, ছেলেমেয়েগুলোর নতুন জামা পায়। একদম উৎসবে ফিরবেন না। এবার আর পুরী, দার্জিলিং নয়, এবার তো আর উৎসব নেই, অনেক দূরে যাওয়া যাক না…। পাশের পাড়ার পরান, প্রতিবছর পুজোর সময় পুজো প্যান্ডেলের বাইরে খাবারের দোকান দেয়, পুজোর কটা দিনে অতিরিক্ত বেশ রোজগার হয়। সারা বছর এই পুজোর দিনগুলির দিকে চেয়ে থাকেন তিনি। পাড়ার মোড়ে মধু কাকার গার্মেন্টসের দোকান।

সারা বছর তেমন বেঁচাকেনা থাকে না। তবে পূজোর মাসখানেক আগে থেকে ব্যস্ততা চরম আকারে পৌঁছায়। সপ্তমীর দিন পর্যন্ত নাওয়া-খাওয়ার সময় পান না। এবার তো উৎসব নেই! ইলেকট্রিকের কাজ করে ওই ছেলেটা, পুজোর সময় তার কি রেলা…এবার কোন কাজ থাকবে না…. এবার যে উৎস নেই…! বহু কষ্টে টাকা জোগাড় করে এ বছরই নতুন টোটো কিনেছে সেলিম। চোখে স্বপ্ন ছিল পুজোয় যাত্রী টেনে টোটোর দাম তুলে নেবেন। কিন্তু এ বছর যে উৎসব নেই. …. আপনারা কি জানেন এই দুর্গা পুজোর সঙ্গে ব্যবসার সম্পর্ক? দুর্গোৎসবের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে বিপুল অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড।

প্রতিমা, মণ্ডপ নির্মাণ থেকে শুরু করে আলোকসজ্জা-সহ পুজোর অন্যান্য ব্যবস্থাপনার প্রতি স্তরে যুক্ত থাকেন বিপুল সংখ্যক মানুষ। এদের কেউ প্রতিমাশিল্পী, কেউ মণ্ডপ নির্মাতা কিংবা আলোক শিল্পী বা ঢাকি। পুজোর আচার অনুষ্ঠানের সঙ্গে অনেকের যোগ থাকে। বহু ক্ষুদ্র পেশাজীবী অপেক্ষা করেন দুর্গোৎসবের জন্য, যেহেতু এই সময় সবচেয়ে ভালো উপার্জন হয়। দুর্গাপুজো ধর্মীয় আয়োজনের গণ্ডি অনেক দিন আগেই পেরিয়ে গিয়েছে। এখন এই পার্বণ এক সর্বজনীন উৎসব। এই উৎসব উপলক্ষে নতুন পোশাকের কেনাবেচা যেমন হয়, তেমনই খাবারের চাহিদায় রেস্তোরাঁ ব্যবসা জমে ওঠে।

দলে-দলে মানুষ পুজোর ছুটিতে ভ্রমণে বেরিয়ে পড়েন। এর ফলে হোটেল ও পরিবহণ ব্যবসাও চাঙ্গা হয়ে ওঠে। একইসঙ্গে ব্যবসা থেকে রাজস্ব আদায় বেড়ে যায়। কোভিড কালে ব্রিটিশ কাউন্সিল রাজ্যের দুর্গাপুজো নিয়ে একটি সমীক্ষা চালিয়েছিল। ২০১৯ সালে দুর্গাপুজোয় ৩২ হাজার ৩৭৭ কোটি টাকার ব্যবসা হয় রাজ্যে। যা রাজ্যের জিডিপি-র প্রায় ২.৬ শতাংশ। ২০২২ সালে পুজো ঘিরে ৪৫ হাজার কোটি টাকার ব্যবসা হয়েছিল। গত বছর দুর্গোৎসবে ৬০ হাজার কোটি টাকার উপরে ব্যবসা হয়েছে রাজ্যে। এই টাকার একটা বড় অংশ পেয়ে থাকেন শিল্পী ও তার সহযোগী কর্মীরা।

পুজোর যা বাজেট থাকে তার ৭০ শতাংশ টাকা প্রতিমা, মণ্ডপ, আলোকসজ্জা, ঢাকি, পুরোহিতের জন্য খরচ করা হয়। এ সবের সঙ্গে জড়িত কর্মীরাই এই টাকা রোজগার করেন। অর্থনীতিবিদদের মতে, উৎসবের সময় মানুষের টাকা খরচ করার প্রবণতা বাড়ে। অর্থনীতিতে টাকার এই সঞ্চালনের ফলে ব্যবসাতেও গতি আসে। এবছর উৎসব নয় বলে যারা চিৎকার করছেন তাঁদের কাছে প্রশ্ন, উৎসব না করলেই জাস্টিস পাওয়া যাবে এ কথা কোন গীতায় লেখা আছে? দেশের সর্বোচ্চ তদন্তকারী সংস্থা সিবিআই তদন্ত করছে? সারা দেশের মানুষ নির্যাতিতার পরিবারের পাশে রয়েছে। সারা দেশের মানুষ জোরের সঙ্গে আওয়াজ তুলেছে ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’।

এই লড়াই তো চলবেই। তাই বলে উৎসব বন্ধ করেই লড়াই লড়তে হবে তার কি মানে আছে। দেশের কোটি কোটি মানুষের রুটি রুজি নির্ভর করে পুজোর দিনগুলিতে। তাদের পেটে লাথি মেরে শুধু জাস্টিস চাইলে তা কি যথাযথ বিচার হয়? যাদের অবশ্য মাসের শেষে রোজগার নিয়ে চিন্তা নেই তারা এমন কথা ভাবতে পারেন, অর্জুন কাকা বা পরান দা রা তা ভাবতে পারেন কী? অর্জুন দা’রাও সমাজের বাইরের কেউ নন। আর প্রতিবাদ হোক, আন্দোলন হোক, জাস্টিস সবাই চাই। সবাই চাই সমাজের অসুরদের চিরতরে নির্মূল করতে। সেই সংগ্রাম মুষ্টিমেয় মানুষের দ্বারা সম্পন্ন হবে না। সেই লড়াইয়ে চাই, অর্জুন দা পরানদেরও।

Related Articles