স্বাস্থ্য

পুষ্টিতে ভরপুর সুগন্ধি দেশি চাল তুলাইপাঞ্জি-কালোনুনিয়া

Desi Rice Tulai Panji

The Truth of Bengal,Mou Basu: বাংলার মাটি রত্নগর্ভা। এই বাংলার মাটিতে নানান রকম সুগন্ধি দেশি চালের চাষ হয়। এসব চাল যেমন স্বাদে অতুলনীয় তেমনই পুষ্টিগুণেও ভরপুর। জনপ্রিয় একটি পণ্যের ট্যাগলাইন ‘এখানেই থেমে থেকো না’ মেনে চলে রাজ্য সরকার আজ গোবিন্দভোগ চালের পাশাপাশি তুলাইপাঞ্জি, কালোনুনিয়ার মতো বিভিন্ন সুগন্ধি দেশি চাল সংরক্ষণেও বিশেষ ভাবে উদ্যোগী হয়েছে। দুই সুগন্ধি দেশি চাল কালোনুনিয়া আর তুলাইপাঞ্জি একান্ত ভাবেই উত্তরবঙ্গের চাল। কৃষিবিজ্ঞানী ও পুষ্টিবিদদের মতে, “তুলাইপাঞ্জি আর কালোনুনিয়া, দুটোই বাংলার ফোক রাইস বা নিজস্ব দেশি চাল। অন্য দেশি চালের মতোই এই দু’টো চালও পুষ্টিকর। ধান ২ রকমের হয়, একটা জাপোনিকা রাইস আর আরেকটা ইন্ডিকা রাইস। ইন্ডিকা রাইস হল দেশি ধান, যার পুষ্টিগুণ জাপোনিকা রাইসের চেয়ে বেশি। উচ্চ ফলনশীল ধান হল এই জাপোনিকা রাইস। পুষ্টিগুণ কম থাকে দেশি ধানের চেয়ে। দেশি ধানে পুষ্টিগুণ বেশি হলেও ফলন কম হয়। বাংলা ছাড়া কোথাও এত হাই পলিশড চাল ব্যবহার হয় না। চাল যত বেশি পলিশড হবে পুষ্টিগুণ কমে যাবে। দরকারি খনিজ পদার্থ, ভিটামিন এসব বেরিয়ে যাবে। ধানের খোসার মধ্যে চালের ওপরে একটা লেয়ার বা স্তর থাকে যেখানে দরকারি অয়েল, খনিজ পদার্থ আর প্রোটিন থাকে। কিন্তু আমরা বাঙালিরা অজ্ঞ তাই আমরা ওই স্তর তুলে দিয়ে সাদা চকচকে চাল পছন্দ করি। আমরা সরু চাল পছন্দ করি, স্বাদ আর পুষ্টিগুণ নিয়ে মাথা ঘামাই না।

সুগন্ধি তুলাইপাঞ্জির চাষ মূলত হয় উত্তর দিনাজপুর জেলার রায়গঞ্জ মহকুমা আর দক্ষিণ দিনাজপুরের কিছু জায়গায়। সুগন্ধি এই দেশি প্রজাতি চালের স্বাদ ও গন্ধ একেবারেই নিজস্ব। তুলাইপাঞ্জিকে বলা হয় ‘নন বাসমতি অ্যারোম্যাটিক রাইস’ অর্থাৎ বাসমতি নয় কিন্তু সুগন্ধি চাল। তুলাইপাঞ্জি ধানের গড় উচ্চতা ৫.৫ মিমি। তুলাইপাঞ্জি চালে প্রচুর পরিমাণে অ্যামাইলোজ, প্রোটিন ও ফাইবার মেলে। পুষ্টিকর এই চাল রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়, হজমে সাহায্য করে, কোলেস্টেরলের মাত্রা কমায়। উত্তর ও দক্ষিণ দিনাজপুরের নিজস্ব এই তুলাইপাঞ্জি ধান চাষ করতে কোনো রকম রাসায়নিক সার ব্যবহার করা হয় না। দারুণ স্বাদ হয় তুলাইপাঞ্জি চালের ভাতের। সাধারণত, পাট চাষ হয়ে যাওয়ার পর আগস্ট থেকে ডিসেম্বর সময়ের মধ্যে তুলাইপাঞ্জি ধান চাষ করা হয়। কোনো ভাবে স্বাদ যাতে না চলে যায় তার জন্য রাসায়নিক সার ব্যবহারই করা হয় না।তুলাইপাঞ্জিকে বলা হয় উত্তরবঙ্গের বাসমতি রাইস। ২০১৭ সালে জিওগ্রাফিকাল ইন্ডিকেশন (জিআই) ট্যাগ লাভ করে তুলাইপাঞ্জি চাল। অনেকের মতে তুলাই নদীর থেকে এই ধানের নামকরণ হয়েছে। ২০১২ সালে লন্ডন অলিম্পিক গেমসের ফুড ফেস্টিভ্যালেও এই চাল পাঠিয়েছিল পশ্চিমবঙ্গ সরকার।

উত্তর দিনাজপুরের রায়গঞ্জ, কালিয়াগঞ্জ, হেমতাবাদ আর করণদিঘি ব্লকের পাশাপাশি দক্ষিণ দিনাজপুরের কুশমাণ্ডি ব্লকে চাষ করা হয় তুলাইপাঞ্জির।১৩০০ খ্রিস্টাব্দের সংস্কৃত গ্রন্থেও উল্লেখ রয়েছে তুলাইপাঞ্জির। আগে চাষিরা তুলাইপাঞ্জি ধান চাষ করতে তেমন ভাবে উৎসাহিত হতেন না। কিন্তু এখন রাজ্য সরকারের উদ্যোগে এই দেশি চাল উৎপাদন প্রচুর পরিমাণে বেড়েছে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেই এই চালের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর যিনি প্রায়সই অতিথিদের প্যাকেটজাত এই চাল উপহার দেন। এই চালে যে পরিমাণ চাল তার দ্বিগুণ পরিমাণ জল নিয়ে ভিজিয়ে রাখবেন। ফুটন্ত জলে ৮-১০ মিনিট রান্না করলেই ভাত তৈরি। রান্না করার সময় থেকেই সুগন্ধ বেরতে শুরু করে। এয়ার টাইট কৌটোতে রাখুন এই চাল।তুলাইপাঞ্জির মতোই আরেক দেশি চাল হল কালোনুনিয়া। ছোট্ট আকারের কালো রঙের ধান থেকে তৈরি হয় ঐতিহ্যশালী কালোনুনিয়া চাল। ছোট্ট আকারের সাদা রঙের হয় কালোনুনিয়া চাল। উচ্চ ফলনশীল ধানের চাপে কোণঠাসা এসব দেশি চালের সঙ্গে জড়িয়ে আছে সাংস্কৃতিক গরিমাও। কালোনুনিয়া চালকে বলা হয় ‘প্রিন্স অফ রাইস’। বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সুগন্ধি চাল এই কালোনুনিয়া। বলা হয়, কোচবিহারের মহারাজা নৃপেন্দ্র নারায়ণের বিশেষ প্রিয় ছিল এই চালের ভাত। দেবতা মদনমোহনকেও অর্পণ করা হত এই চালের তৈরি খাবার। কোচবিহার ছাড়াও জলপাইগুড়ি ও আলিপুরদুয়ারে চাষ করা হয় কালোনুনিয়া চাল।