হাঁপানি বা শ্বাসকষ্ট মানেই কি অ্যাজমা? একান্ত সাক্ষাৎকারে জানালেন ড. অংশুমান
Does wheezing or shortness of breath mean asthma? Dr. Angshuman said in an exclusive interview

Truth Of Bengal: হাঁপানি শুধুমাত্র অ্যাজমার কারণে হয় তা নয়। অ্যাজমার বিভিন্ন লক্ষণের মধ্যে একটি লক্ষণ হাঁপানি। হাঁপানি, অ্যাজমা সম্পূর্ণভাবে সারানো যায় না, তবে চেষ্টা করলে নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। দরকার সচেতনতা। এর লক্ষণ কী? কী করণীয়? একবার ইনহেলার শুরু হলে কী সারা জীবন নিতে হবে? জানালেন বিশিষ্ট চিকিৎসক পালমোনোলজিস্ট ডক্টর অংশুমান মুখার্জি। কথা বলেছেন আমাদের প্রতিনিধি অর্পিতা বসু।
প্রশ্ন: হাঁপানি কী?
উত্তর: হাঁপানি বা শ্বাসকষ্ট এমন একটি রোগ যা শ্বাসপথে বায়ু চলাচলে বাধা তৈরির কারণে হয়। হাঁপানির বৈশিষ্ট্য হল বুকে চাপ অনুভব হওয়া, শ্বাস-প্রশ্বাসের সাথে শো শো শব্দ হওয়া, বুকের মাংসপেশি শক্ত হয়ে যাওয়া এবং কাশি। হাঁপানির সমস্যায় কখনও আগে টান ওঠে পরে অন্যান্য লক্ষণ দেখা দেয় আবার উল্টোটাও হতে পারে।
প্রশ্ন: আপনারা বলেন হাঁপানি বহু অসুখের লক্ষণ। হাঁপানি কেন হয়?
উত্তর : জেনেটিক এবং পরিবেশগত কারণে হাঁপানি হতে পারে। ফুসফুসে বাতাস বহনকারী সরু সরু অজস্র নালী আছে। অ্যালার্জি ও অন্যান্য কারণে সূক্ষ্ম শ্বাসনালী গুলির মাংসপেশি সংকুচিত হয়ে পড়ে, ঠিকমতো বাতাস চলাচল সেখান থেকে করতে পারে না, ফলে শরীর প্রয়োজনীয় অক্সিজেন পায় না। তখন নিঃশ্বাসের কষ্ট সহ নানান শারীরিক সমস্যা শুরু হয়। অ্যাজমা, সিওপিডি, লাং ক্যান্সার,লাং ফাইব্রোসিস,প্লুরাল ইফিউশন এমনকি হার্ট ফেলিওরের কারণেও হাঁপানি হতে পারে।
প্রশ্ন: কারা আক্রান্ত হন?
উত্তর: ৮ থেকে ৮০ সবাই আক্রান্ত হতে পারেন। শিশু এবং অল্প বয়সীদের মধ্যে অ্যাজমার প্রবণতা বেশি দেখা যায়। তবে অ্যাজমা বয়স্কদেরও হতে পারে। সিওপিডি বা আইএলডি সাধারণত ৪০ বছরের পর থেকে বেশি দেখা যায়।
প্রশ্ন : বাচ্চাদের হাঁপানি হলে বুঝবো কী করে?
উত্তর : সুস্থ প্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রে স্বাভাবিক শ্বাস-প্রশ্বাসের হার প্রতি মিনিটে ১৮ থেকে ২২ বার। শিশুদের ক্ষেত্রে,স্বাভাবিক হার প্রতি মিনিটে ৩০ থেকে ৬০ বার। কোনও শিশুর যদি শ্বাস নেওয়ার সময় শ্বাসকষ্ট হয়, শো শো শব্দ হয়, শ্বাস ছাড়ার সময় গলার নিচে বা বুক ও পাঁজরের মাঝের অংশটি ভেতরের দিকে ঢুকে যায়, ঘন ঘন সর্দি-কাশি হয় তাহলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
প্রশ্ন : শ্বাসকষ্ট হলে অনেকেই বুঝতে পারেন না হার্ট না ফুসফুসের কারণে এই শ্বাসকষ্ট হচ্ছে, সেক্ষেত্রে কোন চিকিৎসকের কাছে যাওয়া প্রয়োজন ?
উত্তর : শ্বাসকষ্ট যেহেতু ফুসফুসের রোগের প্রধান লক্ষণ তাই শনপালমোনোলজিস্টের কাছে যাওয়া উচিত। তবে হৃদরোগের কারণেও শ্বাসকষ্ট হতে পারে। তাই হৃদরোগ নাকি ফুসফুসের কারণে শ্বাসকষ্ট হচ্ছে তা বুঝতে না পারলে, প্রথমে জেনারেল ফিজিশিয়ানের পরামর্শ নিন। তিনিই প্রয়োজন অনুযায়ী আপনাকে একজন পালমোনোলজিস্ট বা কার্ডিওলজিস্টের কাছে পাঠাবেন। শ্বাসকষ্টের সঙ্গে যদি বুকে ব্যথা, কথা বলতে অসুবিধা, বা অন্য কোনো গুরুতর উপসর্গ থাকে, তাহলে অবিলম্বে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
প্রশ্ন: হাঁপানির সমস্যায় অনেকেই প্রথমদিকে গুরুত্ব দেন না। দীর্ঘদিন ফুসফুসের সমস্যা থাকলে ভবিষ্যতে তা কতটা অ্যালার্মিং?
উত্তর : শ্বাসকষ্টের সমস্যাকে শুরুতে অনেকেই গুরুত্ব দেন না। সিওপিডি বা অ্যাজমার ক্ষেত্রে অনেকেই রোগের প্রাথমিক পর্যায়ে সচেতন না হওয়ায় বেশ খানিকটা অ্যাডভান্স স্টেজে রোগীরা আমাদের কাছে আসেন। এই পরিস্থিতি দীর্ঘস্থায়ী হলে, তা বেশ উদ্বেগের কারণ হতে পারে। তাই প্রথমেই কারণ অনুসন্ধান করা জরুরি।
প্রশ্ন: কোন পরিস্থিতিকে সিভিয়ার অ্যাজমা বলা হয় ? সিভিয়ার অ্যাজমা কী হৃদরোগের কারণ হয়ে উঠতে পারে ?
উত্তর : সিভিয়ার অ্যাজমার ক্ষেত্রে লক্ষণগুলো গুরুতরভাবে বেড়ে যায় শ্বাসকষ্টের মাত্রা বেড়ে যায়।রোগীকে বারবার স্টেরয়েড দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে, অনেক ক্ষেত্রে বারবার হাসপাতালে নিয়ে যাবার প্রয়োজন পড়ে। সিভিয়ার অ্যাজমা হলে তার থেকে হার্ট অ্যাটাক এবং ব্রেন স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়তে পারে। আমাদের ফুসফুস এবং হার্ট অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত । ফুসফুসের উপর চাপ বাড়লে হার্টের ওপরেও চাপ বাড়ে। তাই এর চিকিৎসার সময় ন্যূনতম হার্টের পরীক্ষাও করা হয়। দেখে নেওয়া প্রয়োজন হার্ট এবং ফুসফুসের মধ্যে রক্ত চলাচলের চাপ বাড়ছে কিনা। সেক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় ওষুধ দেবার প্রয়োজন পড়ে।
প্রশ্ন: চিকিৎসা কী?
উত্তর : ১)অ্যাজমা এবং সিওপিডির সমস্যার ক্ষেত্রে প্রধান ওষুধ ইনহেলার, নেবুলাইজার। ২)লাং ক্যান্সারের ক্ষেত্রে বায়োপসির পর প্রয়োজনীয় চিকিৎসা করা হয়।
৩)আইএলডি ফুসফুসের একটি জটিল রোগ যেখানে ফুসফুসের টিস্যুগুলো মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় তাই সময় নষ্ট না করে দ্রুত চিকিৎসা শুরু করা প্রয়োজন।
৪)প্লুরাল ইফিউশন অর্থাৎ ফুসফুসের বাইরের চাদরে জল জমলে প্রথমে কিছুটা জল বার করে পরীক্ষা করা হয়।
৫)হার্টের সমস্যার কারণে জল জমলে ,জল বার করার সাথে সাথে হার্টের চিকিৎসা করা হয়। যদি টিবির কারণে জল জমে তাহলে টিবির চিকিৎসা করা হয়। ক্যান্সার ধরা পড়লে তার প্রয়োজনীয় চিকিৎসা করা হয়। আবার থোরাকোস্কোপির মাধ্যমেও সমস্যা সনাক্ত করা হয়।
প্রশ্ন : অনেকেই ভাবেন ইনহেলার ব্যবহার করতে শুরু করলে তা আর বন্ধ করা যায় না। এটা কী ঠিক?
উত্তর : ইনহেলার নিয়ে প্রচুর ভুল ধারণা আছে। এমনই একটি ধারণা ইনহেলার একবার নিলে তা বন্ধ করা যায় না। ইনহেলার হল এক ধরনের ওষুধ। যা গ্যাসের আকারে সরাসরি ফুসফুসে পৌঁছে যায়। অনেকেরই ভুল ধারণা ইনহেলার স্টেরয়েডের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে, তা একেবারেই ঠিক নয়। যাদের সিওপিডি আছে তাদের সারা জীবন ইনহেলার নিতে হয়। বাচ্চাদের অনেক ক্ষেত্রেই বড় হলে সমস্যা কমে যায়, ফলে ইনহেলার নেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। তবে ভবিষ্যতে আবারো সমস্যা দেখা দিলে ইনহেলার ব্যবহার করতে হবে। তাই চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কখনোই ইনহেলার বন্ধ করা উচিত নয়।
প্রশ্ন: অ্যাজমা কী সম্পূর্ণ নিরাময় সম্ভব, নাকি নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব?
উত্তর : অ্যাজমা, হাঁপানি একটি দীর্ঘস্থায়ী রোগ। এর কোন স্থায়ী চিকিৎসা নেই। তবে নিয়মিত চিকিৎসার মাধ্যমে একে নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব।
প্রশ্ন: খাওয়া-দাওয়ার প্রতি কতটা সতর্ক থাকা দরকার ? কোনও খাবারে অ্যালার্জি থাকলে কী তা বন্ধ করা উচিত?
উত্তর : কোনও খাবারে অ্যালার্জি থাকলে হাঁপানি রোগীদের তা এড়িয়ে চলা উচিত। এতে হাঁচি, কাশির মতো সমস্যা দেখা দেয়। ফলে শ্বাসকষ্ট জনিত সমস্যা আরো বাড়তে পারে। ফ্রিজের ঠান্ডা খাবার খাওয়া একেবারেই উচিত নয়। ফল,সবুজ শাকসবজি অর্থাৎ অ্যান্টিঅক্সিডেন্টযুক্ত খাবারের সাথে ভিটামিন ডি ও ভিটামিন ই সমৃদ্ধ খাবার খাদ্য তালিকায় রাখা উচিত। কখনো খুব ভরপেট খাবেন না, কারণ পেট অতিরিক্ত ভরে যাওয়ার কারণেও শ্বাসকষ্ট হতে পারে। তাই আমাদের পরামর্শ বারবার খাবার খান কিন্তু অল্প পরিমানে।
প্রশ্ন: সবশেষে জানতে চাইবো ফুসফুস কিভাবে ভালো রাখা সম্ভব?
উত্তর : অ্যাজমা বা হাঁপানির সমস্যা থাকলে কিছু সাবধানতা নেওয়া প্রয়োজন।
১)নিউমোনিয়া, ইনফ্লুয়েঞ্জার টিকা নেওয়া জরুরি।
২) অ্যাজমার রোগীদের রোগলক্ষণগুলি শীতকালে বাড়ে। তাই বাইরের ঠান্ডা বাতাসে যতটা কম বেরোনো যায় ততই ভালো। বা সেক্ষেত্রে নাক, কান, গলা ঢেকে রাখা প্রয়োজন। ঠান্ডা লাগলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
৩)ফ্রিজের ঠান্ডা খাবার খাবেন না। ভরপেট না খেয়ে,বারবার খাবার খান কিন্তু অল্প পরিমানে।
৪) অ্যাজমা আছে বলে অনেকেই শরীরচর্চা করতে ভয় পান। তা একেবারেই উচিত নয়। প্রতিদিন হাঁটাচলা, সাইকেল চালানো , সাঁতার কাটা, যোগাসনের সাথে প্রাণায়াম অবশ্যই করুন। তবে খেয়াল রাখা উচিত শরীর চর্চার সময় অতিরিক্ত ঘাম,কাশি,বুকে ব্যথা বা শ্বাসকষ্ট জনিত সমস্যা হচ্ছে কিনা।
৫) মাথা ভেজানোর অন্তত ৩০ মিনিটের মধ্যে চুল শুকিয়ে ফেলা দরকার।
৬)ধুলো এবং দূষণ থেকে বাঁচতে মাস্ক ব্যবহার করা উচিত।
৭) প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ধূমপান থেকে বিরত থাকুন।
৮) আসবাবপত্র, বিছানা পরিষ্কার রাখুন। ধোয়া,ধুলো এড়িয়ে চলুন।
৯) অ্যাজমা বা হাঁপানির সমস্যা থাকলে চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ইনহেলার বন্ধ করবেন না।