বাপি লাহিড়ির মৃত্যুর কারণ ছিল স্লিপ-অ্যাপনিয়া, কি এই রোগ? জানুন বিস্তারিত
Bapi Lahiri's death was caused by sleep apnea, what is this disease? Know the details

Truth Of Bengal: ঘুমের ঘোরে অনেকেই নাক ডাকেন। কখনো কখনো বাড়ে নাক ডাকার তীব্রতা। কিন্তু খুব কম জনই বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে দেখেন। স্লিপ অ্যাপনিয়ার একটি প্রধান লক্ষণ হল নাক ডাকা, তবে এটি একমাত্র লক্ষণ নয়। কখনো কখনো ঘুমের মধ্যেই শ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়।
স্লিপিং ডিসঅর্ডার সংক্রান্ত এই সমস্যা হৃদ্যন্ত্রের ডান ও বাঁ পাশে থাকা ভেন্ট্রিকলের ক্ষতি করে। আপনিও স্লিপ অ্যাপনিয়ায় ভুগছেন না তো? কী এই স্লিপ অ্যাপনিয়া? লক্ষণ কী? সম্পূর্ণ নিরাময় কী সম্ভব? জানালেন বিশিষ্ট চিকিৎসক ডক্টর কৌশিক মুখার্জি। কথা বলেছেন আমাদের প্রতিনিধি অর্পিতা বসু।
প্রশ্ন : স্লিপ অ্যাপনিয়া কী?
উত্তর: স্লিপ অ্যাপনিয়া একটি শ্বাস-প্রশ্বাস সংক্রান্ত সমস্যা, যা ঘুমের সময় ঘটে। শ্বাসনালীর উপরে অবস্থিত পেশীগুলির শিথিল হয়ে যাওয়া বা বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে শরীরে পর্যাপ্ত অক্সিজেন সরবরাহ হয় না। ফলে শ্বাসপ্রশ্বাস বন্ধ হয়ে যায়। হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলে দমবন্ধ হয়ে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়।
প্রশ্ন : স্লিপ আপনিয়ার প্রকারভেদ কী?
উত্তর: স্লিপ অ্যাপনিয়ার দুটি প্রকারভেদ আছে ।
১) অবস্ট্রাকটিভ স্লিপ অ্যাপনিয়া (ওএসএ) এক্ষেত্রে গলার পেশী শিথিল হয়ে শ্বাসনালীর উপরে বাধার কারণে শ্বাস বন্ধ-প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে।
২) সেন্ট্রাল স্লিপ অ্যাপনিয়া (সিএসএ)
এক্ষেত্রে, মস্তিষ্ক শ্বাসপ্রশ্বাস নেওয়ার জন্য সংকেত পাঠাতে ব্যর্থ হয়, ফলে শ্বাসপ্রশ্বাস বন্ধ হয়ে যায়।
প্রশ্ন : স্লিপ অ্যাপনিয়া কেন হয়?
উত্তর : কারণ হিসেবে আমরা বলতে পারি,
১) ঘুমের সময় উপরের শ্বাসনালী সংকুচিত বা বন্ধ হয়ে যাওয়া,গলার পেশী শিথিল হওয়া, যা শ্বাসনালীকে অবরুদ্ধ করে।
২)কোনো কোনো ক্ষেত্রে জিহ্বা বা টনসিলও শ্বাসনালীকে অবরুদ্ধ করে ফলে শ্বাস প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে যায়।
৩)স্থূলতা বা অতিরিক্ত ওজনও শ্বাসনালীতে পেশীর চাপ বাড়িয়ে দেয়।
৪)সেন্ট্রাল স্লিপ অ্যাপনিয়ার ক্ষেত্রে ঘুমের সময় মস্তিষ্ক শ্বাসপ্রশ্বাস নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হয়, ফলে শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে যায়।
৫)কিছু ক্ষেত্রে হার্ট ফেইলিউর, কম অক্সিজেনের মাত্রা, অথবা স্নায়ুতন্ত্রের ক্ষতির কারণেও এটি হতে পারে।
৬) এছাড়াও কখনো কখনো বংশগত কারণ,অ্যালার্জি, টনসিল বড় হওয়া, এবং অত্যধিক অ্যালকোহল বা ধূমপানের কারণে স্লিপ অ্যাপনিয়া হতে পারে।
প্রশ্ন : এর লক্ষণ কী? একজন কিভাবে বুঝবেন তিনি স্লিপ অ্যাপনিয়ায় আক্রান্ত?
১)অতিরিক্ত নাক ডাকা এই সমস্যার প্রধান উপসর্গ। এই রোগে আক্রান্ত হলে নাক ডাকার তীব্রতা অনেক বেশি হয়।
২)মাঝে মাঝে ঘুমের মধ্যে দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার অনুভূতি হয়, বিশেষ করে চিত হয়ে ঘুমানোর সময় শ্বাস বন্ধ হয়ে যায়। কিছু সময়ের জন্য হৃৎস্পন্দন বেড়ে যায়।
৩) ঘুম থেকে ওঠার পর গলা শুকিয়ে আসে। এই রোগে আক্রান্ত হলে শ্বাস নিতে অসুবিধা হয়, মুখ দিয়ে শ্বাস নেওয়ার ফলে গলা শুকিয়ে যায়।
৪) রাতে ঘুম ভালোভাবে না হওয়ায় দিনের বেলায় ক্লান্তি, মাথা ব্যথা থাকে। মেজাজ খিটখিটে থাকে।মনোযোগের অভাব হয়। কারও সাথে কথা বলতে ভালো লাগে না, অবসাদগ্রস্ত লাগে।
৫)কাজ করতে গিয়ে বা গাড়ি চালাতে গিয়ে হুট করে অনেকেই ঘুমিয়ে পড়েন। এই ধরনের সমস্যা থাকলে তাই শুরুতেই সচেতন হওয়া প্রয়োজন।
প্রশ্ন : নাক ডাকার সমস্যা তো অনেকেরই থাকে, সেক্ষেত্রে এই সমস্যা থাকা মানেই কী স্লিপ অ্যাপনিয়া?
উত্তর: স্লিপ অ্যাপনিয়ার একটি প্রধান লক্ষণ হল নাক ডাকা। তবে এটি একমাত্র লক্ষণ নয়। নাক ডাকা একটি সাধারণ সমস্যা, তবে জোরে এবং ঘন ঘন নাক ডাকা, অথবা ঘুমের সময় শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়া স্লিপ অ্যাপনিয়ার একটি প্রধান লক্ষণ হতে পারে।
প্রশ্ন : এই সমস্যা কী শুধুমাত্র রাতের বেলায় ঘুমের মধ্যেই হয় নাকি, দিনের বেলাতেও ঘুমের মধ্যে হতে পারে?
উত্তর :স্লিপ অ্যাপনিয়া সাধারণত রাতের বেলায় ঘুমের মধ্যে ঘটে, তবে এটি দিনের বেলাতেও হতে পারে।
প্রশ্ন : কাদের স্লিপ অ্যাপনিয়া হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে?
উত্তর : স্লিপ অ্যাপনিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার নির্দিষ্ট কোনও বয়স নেই। যে কোনও বয়সেই স্লিপ অ্যাপনিয়া হতে পারে। তবে,
১)বয়স্করা এবং মহিলাদের তুলনায় পুরুষরা বেশি ঝুঁকিপূর্ণ।
২)যাঁদের ওজন বেশি, তাঁদের ঘুমের সময়ে শ্বাসনালির উপর চাপ বেশি পড়ে, ফলে স্লিপ অ্যাপনিয়া হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে।
৩)প্রিমেনোপজ়াল বা কম বয়সি মহিলারা অবস্ট্রাকটিভ স্লিপ অ্যাপনিয়ায় আক্রান্ত হতে পারেন, তাঁদের মধ্যে নাক ডাকার উপসর্গ সহজে লক্ষ্য করা যায় না। অথচ, সকালে ঝিমুনি ভাব, ক্লান্তি ও অ্যাংজ়াইটি দেখা দেয়।
৪) যাদের উচ্চ রক্তচাপ বা ডায়াবেটিসের সমস্যা আছে তাঁরাও ঝুঁকিপূর্ণ।
প্রশ্ন : কোন সময় চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত?
উত্তর: স্লিপ অ্যাপনিয়ার সমস্যা যদি আপনার প্রতিদিনের জীবনযাত্রাকে ব্যাহত করে, ওষুধ খাবার পরেও যদি ডায়াবেটিস বা উচ্চ রক্তচাপের সমস্যা স্লিপ অ্যাপনিয়ার কারণে নিয়ন্ত্রণে না থাকে, তখন অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া প্রয়োজন।
প্রশ্ন : কী ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হয়?
উত্তর : স্লিপ অ্যাপনিয়া আছে কিনা বুঝতে একজন রোগীর পূর্ণাঙ্গ স্লিপ স্টাডি প্রয়োজন। সেক্ষেত্রে পলিস মনোগ্রাফি টেস্ট বা হোম স্লিপ অ্যাপনিয়া পরীক্ষা (এইচএসএটি) করা হয়।
প্রথমে স্লিপ স্টাডির মাধ্যমে বোঝা দরকার রোগটা কতটা গুরুতর পর্যায়ে পৌঁছেছে। শরীরে কতটা পরিমাণে অক্সিজেনের ঘাটতি তৈরি হচ্ছে, ঘুমের মধ্যে কী-কী সমস্যা হচ্ছে। এই টেস্টের মাধ্যমে ঘুমের মধ্যে রোগীর চোখের মুভমেন্ট, নাক ডাকা, হার্ট রেট, ব্রেন ওয়েভ, মাসল টুইচিং, অক্সিজেন স্যাচুরেশন, এমন বেশ কিছু প্যারামিটার পরীক্ষা করে দেখা হয়।
এছাড়াও এমআরআই বা সিটি স্ক্যান, ইসিজি, ইকো কার্ডিওগ্রাফি, ওভার নাইট পিপি মনিটরিং করা হয়। এই ধরনের রোগীদের শরীরে অক্সিজেনের মাত্রা কম থাকে এবং কার্বনডাই-অক্সাইডের মাত্রা বেশি থাকে। এবিজি বা আর্টেরিয়াল ব্লাড গ্যাস পরীক্ষার মাধ্যমে রক্তে অক্সিজেন, কার্বন ডাই অক্সাইড এবং পিএইচ পরিমাপ করা হয়।
প্রশ্ন : কী কী ধরনের জটিলতা হতে পারে?
উত্তর : স্লিপ অ্যাপনিয়ায় আক্রান্ত রোগীদের ক্ষেত্রে রক্তচাপ বেশি থাকে যা ওষুধ নেওয়ার পরেও নিয়ন্ত্রণে আসতে চায় না। ডায়াবেটিসের সমস্যা থাকে। পাশাপাশি কার্ডিওভাসকুলার কমপ্লিকেশন, হার্ট ফেইলিওর ও স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ে।
প্রশ্ন : এর চিকিৎসা কী?
উত্তর: ১) স্লিপ অ্যাপনিয়ার ক্ষেত্রে স্থূলতা একটা বড় কারণ। তাই প্রয়োজন লাইফস্টাইল পরিবর্তনের।প্রথমত ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। সুষম খাদ্যাভ্যাস গড়ে তুলুন। খাওয়ার ঠিক পরেই শুয়ে না পরে একটু হাঁটাহাঁটি করুন। হজমের সমস্যা কমলে নাক ডাকার সমস্যা থেকে কিছুটা মুক্তি পাওয়া সম্ভব। নিয়মিত যোগাসন করুন। উচ্চ রক্তচাপ এবং ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। মদ্যপান থেকে বিরত থাকুন।
২) দ্বিতীয়ত সিপিএপি-র ব্যবহার। এটি একটি মাস্কের মত যন্ত্র, যা ঘুমোনোর সময় রোগীকে পড়তে হয়। সিপিএপি যন্ত্রটি ঘুমের মধ্যে শ্বাসনালিকে খুলে রাখে এবং শ্বাস-প্রশ্বাসকে স্থিতিশীল করে সামগ্রিক ঘুমের মান উন্নত করে।
৩) সিপিএপি ছাড়াও অন্যান্য ধরনের মাস্কও ব্যবহার করা হয়, যেমন BiPAP এবং Auto-CPAP।
৪) স্লিপ অ্যাপনিয়ার চিকিৎসায় সার্জারি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিকল্প। বিশেষ করে যখন (সিপিএপি) থেরাপির মতো অন্যান্য চিকিৎসা পদ্ধতি পর্যাপ্তভাবে কাজ করে না। এছাড়াও প্রয়োজনে বিভিন্ন ধরনের সার্জারির মাধ্যমে শ্বাসনালীকে খোলা বা প্রশস্ত করা হয়।
প্রশ্ন : চিকিৎসার মাধ্যমে সম্পূর্ণ নিরাময় কী সম্ভব?
উত্তর: স্লিপ অ্যাপনিয়া সম্পূর্ণরূপে সেরে যায় না, চিকিৎসা ও জীবনযাত্রার পরিবর্তনের মাধ্যমে তা নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। যদি স্থূলতা বা নির্দিষ্টভাবে নাক, কান, গলার কোনো সমস্যার কারণে হয় সেক্ষেত্রে ওজন হ্রাস বা অস্ত্রোপচারের সাহায্যে নিরাময় সম্ভব।
প্রশ্ন : এর থেকে কি আকস্মিক মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে?
উত্তর : কোভিড পরবর্তী পর্যায়ে “sudden cardiac death” এর ঘটনার সঙ্গে আমরা প্রত্যেকে পরিচিত। স্লিপ অ্যাপনিয়ার কারণে হৃদরোগ এবং স্ট্রোকের ঝুঁকি বেড়ে যায়। ঘুমের সময় শ্বাসপ্রশ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়ায় হঠাৎ মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।
প্রশ্ন : সি প্যাপ কী সারা জীবন ব্যবহারের প্রয়োজন হয় ?
উত্তর: নাক, কান ও গলার কোনো গঠনগত ত্রুটি বা স্থূলতার কারন ছাড়া অন্য কারণে স্লিপ অ্যাপনিয়া হলে তা নিয়ন্ত্রণে রাখতে সারা জীবন এই যন্ত্র ব্যবহারের প্রয়োজন হয়। ঘুমের সময় এই যন্ত্রটি ব্যবহারের ফলে তা শ্বাস-প্রশ্বাসকে স্বাভাবিক রাখতে সাহায্য করে। এতে রোগের লক্ষণগুলো কমে আসে এবং রোগী স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারেন। সারা জীবন যন্ত্রটি ব্যবহার করতে হবে বলে হতাশ হওয়ার কিছু নেই। এটি একটি চিকিৎসাব্যবস্থা মাত্র, যা জীবনে স্বাচ্ছন্দ্য বজায় রাখতে সাহায্য করে।
প্রশ্ন : সবশেষে পাঠকদের উদ্দেশ্যে কি বলতে চাইবেন?
উত্তর : অন্যান্য সমস্যার মতোই স্লিপ অ্যাপনিয়াও একটি রোগ। এতে মানসিকভাবে ভেঙে পড়ার কিছু নেই। চিকিৎসার মাধ্যমে স্বাভাবিক জীবনযাপন সম্ভব। চিকিৎসা না করালে নানা রকম জটিলতা তৈরি হতে পারে।
স্লিপ অ্যাপনিয়া এড়াতে,
১)ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখুন।
২)সুষম খাদ্যাভ্যাস গড়ে তুলুন এবং নিয়মিত শরীর চর্চা করুন।
৩) যাদের উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজের মতো সমস্যা রয়েছে তারা অবশ্যই সচেতন থাকুন।
৪) নাক ডাকার সমস্যা থাকলে, ঘুমের মধ্যে বারবার দম আটকে আসলে, শ্বাস নিতে কষ্ট হলে অবহেলা না করে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।