রাজস্থান থেকে চোরাগোপ্তায় উধাও হয়েছে ৩১টি পাহাড়, প্রভাব পড়ছে পরিবেশে, চুপ সরকার
আরাবল্লী পর্বত মালার ১২৮টি পাহাড়ের মধ্যে ৩১টি উধাও হয়ে গিয়েছে, জাস্ট ভ্যানিশ

The Truth of Bengal– সত্যজিৎ রায়ের বিখ্যাত ছবি সোনার কেল্লা ছবির কথা মনে আছে? সেই দৃশ্যটা, জটায়ুর এন্ট্রির পর, আলাপচারিতার দৃশ্য!
জটায়ু- আরাবল্লী পাহাড় সম্বন্ধে আপনার জানা আছে বোধ হয়?
ফেলু- দৈর্ঘ্যে তিনশো মাইল, উচ্চতম অংশ মাউন্ট আবু, সাড় পাঁচ হাজার ফিট, গাছপালা কম, বালি আর পাথর।
জটায়ু- আমি ওসব কথা বলছি না, আমি ওখানকার ডেকয়েটসদের কথা বলছি, ওখানে দুর্ধর্ষ সব ডাকাত আছে জানেনতো?
ফেলু- সেরকমইতো শুনেছি….
অত্যন্ত সংক্ষেপে আরাবল্লী পাহাড়ের একটি ছোট বর্ণনা দিয়েছিলেন সত্যজিৎ রায়। দৈর্ঘ্যে তিনশো মাইল। হ্যাঁ এটি আরাবল্লী পাহাড়ের মালা। তার কোল থেকে হারিয়ে গিয়েছে বহু ছোট বড় পাহাড়।
আপনারা জানলে হয়তো অবাক হবেন এটা জেনে যে, ভূপৃষ্ঠে সবচেয়ে পুরনো পর্বতগুলির মধ্যে অন্যতম আরাবল্লী। এই পর্বত শৃঙ্খলা ভারতের উত্তর পশ্চিম এলাকায় অবস্থিত। আরাবল্লীর বিস্তার উত্তর পূর্ব থেকে দক্ষিণপশ্চিম দিকে। রাজ্যের হিসাব করলে, হরিয়ানা, রাজস্থান হয়ে চলে গিয়েছে গুজরাটের দিকে।
আরাবল্লীর জন্ম, আমাদের দেশ ভারতের থেকেও পুরনো। গবেষকদের মত, এই পর্বত তখন থেকে রয়েছে, যখন ভারত বা এই উপমহাদেশেরই জন্ম হয়নি। এমনকি হিমালয়ের জন্ম হয়নি। পর্বত গবেষকদের মত, এই উপমহাদেশে একমাত্র আরাবল্লী পর্বতমালা ভারতীয় উপমহাদেশের মানচিত্র নির্মাণে যেমন সাহায্য করেছিল, তেমন প্রকৃতিক গুনাগুন কেমন হবে, সেটা তৈরি করতেও সাহায্য করেছিল। ৭৫০ মিলিয়ন বছর আগে মালানি আগ্নেগিরির কারণে, শীতল যুগ থেকে টেনে বের করে এই অঞ্চলকে জীব বৈচিত্র্যের অনুকুল পরিবেশ তৈরি করেছিল।
আরাবল্লীর অরূপকথন
রাজস্থানের মতো তৃষ্ণার্ত এক রাজ্যকে জলদান করে চলার পিছনে যার অবদান অপরিসীম, সেটি হল এই আরাবল্লী পর্বতমালা। বর্তমানে রাষ্ট্রপতি ভবন, যে রাইসিনা হিলের উপর অবস্থিত, তাও আরাবল্লী পর্বতের অংশ। অতএব বোঝাই যাচ্ছে আমাদের দেশের জন্য, পরিবেশের জন্য আরাবল্লী পর্বতমালা কতটা গুরুত্বপূর্ণ। কয়েক কোটি বছর ধরে দাঁড়িয়ে রয়েছে আরাবল্লী পর্বতমালা। অথচ গত গত চার দশকে এই পর্বতমালার উপর যা অত্যচার হয়েছে, তা অবর্ণনীয়। এই ভাবে চলতে থাকলে দ্রুত ভ্যানিশ হয়ে যেতে পারে আরাবল্লী। ২০১৮ সালে সুপ্রিম কোর্ট একটি সেন্ট্রাল এমপাওয়ার্ড কমিটি তৈরি করে। সেই কমিটির রিপোর্ট থেকে জানা যায়, রাজস্থানে অবস্থিত আরাবল্লী পর্বত মালার ১২৮টি পাহাড়ের মধ্যে ৩১টি উধাও হয়ে গিয়েছে। জাস্ট ভ্যানিশ। শুধু রাজস্থানেই আরাবল্লী পর্বমালার ২৫ শতাংশ আধুনিক নগরায়নের ফলে উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এদিকে হরিয়ানা সরকারের প্রিন্সিপল সেক্রেটারি এ কে সিংয়ের নেতৃত্বে গঠিত কমিটির রিপোর্টেও দাবি করা হয়েছে, হরিয়ানাতে আরাবল্লী রেঞ্জ আগের থেকে অনেকটাই ছোট হয়ে গিয়েছে।
আরাবল্লীর জন্ম প্রায় ১ দশমিক ৯ বিলিয়ন বছর আগে। এটি একটি ফোল্ড মাউন্টেন হিসেবে পরিচিত। অর্থাৎ, যখন ভূমির দুটি ভিন্ন টেকটোনিক প্লেট মুখোমুখি সংঘর্ষে উপরের দিকে উঠে আসে, তাকে ফোল্ড মাউন্টেন বলা হয়। তবে এটি কোনও এক সময়ের শুধু মহাজাগতিক ঘটনা নয়, এই প্রক্রিয়া চলতে থাকে হাজার লক্ষ বছর ধরে। আরাবল্লীর মতো হিমালয় পর্বত মালাও একটি ফোল্ড মাউন্টেন। বয়সের বিচার করলে আরাবল্লীর তুলনায় হিমালয় অনেক অনেক বয়স কম। তাই এখনও হিমালয় রেঞ্জের টেকটোনিক প্লেটের অবস্থান বদল হতে দেখা যায় এখনও, ফলে হিমালয় এখনও বাড়ছে। তাই হিমাচল উত্তরাখণ্ডকে ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকা হিসেবেও চিহ্নিত হয়েছে। হালেই আপনারা দেখেছেন, কীভাবে বসে যাচ্ছে জোশীমঠ। এটা তারই একটি কারণ। তবে আরাবল্লী একটি ওল্ড ফোল্ড মাউন্টেন রেঞ্জ। তাই হিমালয়ের মতো, এখন আর বসে যাওয়ার সম্ভাবনা নেই, আরা বাড়ারও সম্ভাবনা নেই।
পরিসংখ্যান বলছে, গুজরাট থেকে হরিয়ানা পর্যন্ত আরাবল্লী রেঞ্জ ৬৭০ কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত। গবেষকদের দাবি, এটি একসময় হরিদ্বার পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। ফলে, এই পর্বতমালাকে গঙ্গা এবং ইন্দাস নদীর ন্যাচারাল ডিভাইডার হিসেবে মনে করা হয়। শুধু তাই নয়, বর্ষাকালে, সজলধারা মেঘকে শিমলা ও নৈনিতালের দিকে ধাক্কা দিকে পাঠানোর ক্ষেত্রে, আরাবল্লীর ভূমিকা অনস্বীকার্য। এরই প্রভাবেই উত্তরভারতের একাধিক রাজ্যে বর্ষার জল ছড়িয়ে পড়ে ও ভারসাম্য রক্ষা করে। অন্যদিকে, শীতকালে সেন্ট্রাল এশিয়া থেকে আসা শৈতপ্রবাহকে বাধাদান করে, ফলে গঙ্গা ও ইন্দাসের জল জমে বরফ হয়ে যায় না। রাজস্থানের থর মরুভূমি প্রকৃতিক রক্ষাকবচ হিসেবে যেভাবে কাজ করে, সেভাবে একই কাজ করে থাকে আরাবল্লী।
এই বিস্তির্ণ অঞ্চলে জীববৈচিত্র্যের ক্ষেত্রেও ভারসাম্য বজায় রেখে চলেছে আরাবল্লী। ২০টির উপর বণ্যপ্রাণ স্যাঙচুয়ারির সঙ্গে সরিস্কা দিল্লি লেপার্ড ওয়াইল্ডলাইফ করিডোরের ভারসাম্য বজায় রেখে চলেছে। পাশাপাশি ৩০০-র বেশি প্রজাতির স্থানীয় গাছপালা, গুল্ম, লতার আবাসভূমি। ১২০টির প্রজাতির পাখিরও চারণভূমি আরাবল্লী। অর্থাৎ বোঝাই যাচ্ছে গুরুত্ব কতটা।
বন্যপ্রাণের কথা বাদ দিলেও, আরাবল্লীকে দিল্লি এনসিআরের ফুসফুস বলে মনে করা হয়। এখানকার দূষণ নিয়ন্ত্রণের জন্য আরাবল্লীর জঙ্গল এক প্রাকৃতিক বরদান। ইতিহাস থেকে জানা যায়, ৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে কপার এবং অন্য ধাতুর খনন শুরু হয় এখানে। এমনকী, রাজস্থানে আমরা যে টানে বেড়াতে যাই তা হল, বিখ্যাত একাধিক কেল্লা। সেই সব স্থাপত্যের পিছনেও অবদান রয়েছে আরাবল্লীর। একসময় আহাদ, গিলুন্ড এবং বৈরাথের মতো সভ্যতার জন্ম হয়েছিল এই আরাবল্লী পর্বতমালাকে কেন্দ্র করেই। অর্থনৈতিক, প্রাকৃতিক এবং ভৌগলিক পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষাকারী এই পর্বতের অবস্থা এখন অন্তিম পর্যায়ে। ধীরে ধীরে ক্ষয়রোগ আক্রান্ত হয়ে উঠেছে। কিন্তু এই ক্ষয়রোগের কারণ কী?
আরাবল্লীর হারিয়ে যেতে বসার কারণ
লক্ষাধিক বছর ধরে মানব সভ্যতার সমস্ত চাহিদা পূরণ করে এসেছে আরাবল্লী। কিন্তু গত কয়েক দশকে, নির্মাণ ব্যবসা এবং নগরায়ণের ফলে টুকরো টুকরো করে উধাও করে দেওয়া হচ্ছে আরাবল্লীকে। ঠিক যেভাবে, হায়নারা, একটা জীবন্ত প্রাণীকে কুরে কুরে খায়। ফরেস্ট সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার একটি রিপোর্ট থেকে জানা যায়, আরাবল্লীর ৩২০০টি জায়গায় চলছে অবৈধ খননকার্য।
পাশাপাশি কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেলনারেলের একটি রিপোর্ট থেকেও জানা যায়, ২০১১ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত ৯৮.৮৭ লক্ষ মেট্রিক টন খনিজ পদার্থ অবৈধভাবে তুলে নেওয়া হয়েছে এখান থেকে। অসৎ রাজনৈতিক নেতা এবং ভূমি মাফিয়াদের দৌরাত্ম্যে ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে আরাবল্লী। সূত্রের খবর, আরাবল্লী থেকে খনিজ পদার্থ তোলার জন্য মাফিয়ারা ডিনামাইটও ব্যবহার করছে। এর ফলে, শুধু পাহাড়ের প্রাকৃতিক বাঁধনই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তাই নয়, গোপন পথে পাচারও করে দেওয়া হচ্ছে। খনি মাফিয়ারা, এই কাজ করে চলেছে, নির্ভয়ে।
চুপ, ধৃতরাষ্ট্রের সরকার চলছে
গত কয়েক বছরের রিপোর্ট থেকে জানা যায়, এই অঞ্চলে মাইনিং মাফিয়া এবং পুলিশকর্মীদের মধ্যে একাধিক এনকাউন্টার হয়েছে। হত্যা করা হয়েছে, পুলিশকর্মী, সরকারি পদস্থ আধিকারিকদেরও। রাজস্থান, হরিয়ানা ও দিল্লি এনসিআরে দ্রুত হারে বাড়ছে নগরায়ন। আর প্রত্যেকটি জায়গার নির্মাণশিল্প ফুলে ফেঁপে উঠছে আরাবল্লীকে ধ্বংস করে। দিল্লি এনসিআরে উন্নয়নের জন্য লাগামছাড়া ভাবে গাছ কাটা হচ্ছে, ধীরে ধীরে ইট, কাঠ, পাথরের জঙ্গল তৈরি হচ্ছে। এর বিরুদ্ধে কড়া পদক্ষেপ নেওয়াতো দূর অস্ত, পাল্টা যে পদক্ষেপ করা হচ্ছে, তা আরও ভয়ঙ্কর। ১০০০ টাকা থেকে ১১০০০ টাকা জরিমানা করে মামলা খতম করে দেওয়া হচ্ছে।
১৯৯২ সালে কেন্দ্র সরকারের পরিবেশ মন্ত্রক আরাবল্লী নোটিফিকেশন জারি করে বলেছিল, কেন্দ্রের অনুমোদন ছাড়া কোনও মাইনিং কাজ করা যাবে না। এমনকী, ২০০২, ২০০৫, ২০০৯ এবং ২০১৮ সালে ভিন্ন মামলায় সুপ্রিম কোর্টও নির্দেশ জারি করে, আরাবল্লী রেঞ্জে মাইনিং করা যাবে না। যদিও সেসব খাতায় কলমে রয়ে গিয়েছে, এনফোর্সমেন্টের অভাবে। বর্তমানে অবৈধ মাইনিংতো দূর অস্ত, প্রকৃতি বাঁচাতে সাধারণ মাইনিং বন্ধ করারও নির্দেশ দেয়নি কোনও সরকার। সরকারি পরিসংখ্যান বলছে, হরিয়ানা সরকার বহু বন্যভূমিকে সাধারণ ভূমি হিসেবে রেকর্ড করায়, জঙ্গল সাফ করে দেওয়া নির্বিচারে। সারা ভারতে রাজ্যেস্তরে বিচার করলে দেখা যায়, হরিয়ানাতেই সবচেয়ে কম বনভূমি রয়েছে।
আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত
হরিয়ানা সরকারের কর্মকাণ্ড দেখলে আরও আশ্চর্য হতে হয়। ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে হরিয়ানা সরকারের প্রিন্সিপল সেক্রেটারির নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করা হয়। সেই কমিটি এক অদ্ভুত সুপারিশ করা হয়। বলা হয়, আরাবল্লীর বিস্তারকে পুনর্বিবেচনা করা উচিৎ। অর্থাৎ ন্যাশনাল গ্রিন ট্রাইবুনাল এবং অন্যান্য আইনি জটিলতাকে পাস কাটিয়ে যাতে পাহাড় ও অরণ্য, ভূমি মাফিয়াদের হাতে তুলে দেওয়া যায়, তার সুবন্দোবস্ত করা। আর সেই রিপোর্টকে হাতিয়ার করে, হরিয়ানা সরকার, আরাবল্লীর একটা অংশের অস্তিত্বকেই অস্বীকার করে। অর্থাৎ এটা প্রমাণ করার চেষ্টা, আরাবল্লী একটা অংশ ওই বিস্তীর্ণ অঞ্চলে কোনওদিন ছিলই না।
এখানেই পরিবেশ কর্মীরা ক্ষোভ দেখাতে থাকেন। তাঁদের অভিযোগ, মহেন্দ্রগড়, ফরিদাবাদ এবং পালওয়াল অঞ্চলের ৩৫ হাজার হেক্টর জমিকে সাধারণ জমি বলে, ভূমি মাফিয়াদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। সরকারি রিপোর্ট বলছে, স্রেফ রাজস্থান থেকেই ৩১টি পাহাড় গায়েব হয়ে গিয়েছে। আর তার বদলে রাজস্থান সরকার বছরে ৫০০০ কোটি টাকা রয়ালটি নিয়ে কোষাগার ভরেছে। হরিয়ানাতেও চলছে বনভূমি হত্যার কাজ। এখন প্রশ্ন, ভারতের বুকে যে প্রাকৃতিক রোষ নেমে আসতে চলেছে, তা কে রোধ করবে?
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি কি এই বিষয়টি নিয়ে গুরুত্ব দেবেন? আশায় রয়েছেন পরিবেশকর্মীরা।