শ্রীলঙ্কার গৃহযুদ্ধ ও এক ‘শান্তির ফেরিওয়ালা’র বিয়োগান্ত কাহিনি
srilanka civil war and death cause of indian former pm rajiv gandhi

The truth of Bengal: রামায়ণের সূত্র ধরলে প্রচীনকাল থেকেই ভারতের দক্ষিণের দ্বীপ রাষ্ট্রের কথা মনে আসে। ভারত মহাসাগরের বুকে এক ছোট্ট দেশ। অথচ এই দেশটার বুকেই জন্ম নিয়েছে কত রক্তক্ষয়ী ইতিহাস। প্রচীন ইতিহাসের কথা এখন আর বলছি না তবে ছুঁয়ে যাবো, প্রক্ষাপট বুঝতে। বলবো, এক অদ্ভুত অধ্যায়ের কথা, বঞ্চনার কথা, রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের কথা, আর তার মূল্য চোকাতে হয়েছিল ভারতকে।
একটা সময়ে শ্রীলঙ্কায় ত্রাসের অন্যতম নাম হয়ে উঠেছিল ভেলুপিল্লাই প্রভাবকরণ ও তার সংগঠন এলটিটিই। কিন্তু তিনি ত্রাস হয়ে উঠেছিলেন কেন? একবার দেখা যাক শিকড়টাকে। প্রায় ২ হাজার বছর আগে, সম্রাট অশোকের পুত্র অরহন্ত মাহেন্দ্র সিংহল দ্বীপে গিয়েছিলেন বৌদ্ধ ধর্ম প্রচারে। সেই থেকে লঙ্কাতে বৌদ্ধ ধর্মের প্রচার ও প্রসার বাড়তে থাকে। বিংশ শতাব্দীর গোড়াতেও বৌদ্ধ ধর্মালম্বীদের সংখ্যা ছিল ৭০ শতাংশ। পরিসংখ্যান বলছে, শ্রীলঙ্কায় মূলত দুটি গোষ্ঠী ছিল, তার মধ্যে একটি তামিল এবং অন্যটি সিংহলী। শ্রীলঙ্কায় তামিলদের অবস্থান মূলত দেশের উত্তর এবং পূর্বে। ধর্ম হিন্দু, প্রধান ভাষা তামিল, জনসংখ্যার নিরিখে বিচার করলে মাত্র ১৫ শতাংশ তামিল মানুষের বাস।
অন্যদিকে সিংহলীরা ছিল দেশের দক্ষিণ ও মধ্য অঞ্চলে, ধর্ম বৌদ্ধ (থেরাভারা ধারার) প্রধান ভাষা সিংহলী যা সংস্কৃত থেকে প্রভাবিত। তামিলদের প্রধান অবস্থান ছিল উত্তরে জাফনা, এখানে জাফনা সাম্রাজ্য ছিল। আর পূর্বে দিকে ছিল ক্যান্ডি সাম্রাজ্য। ব্রিটিশরা ভারত সহ দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় জাঁকিয়ে বসার পরেই, শ্রীলঙ্কাতেও তারা কব্জা জমায়। সেই সময় তামিলরা সংখ্যালঘু থাকলেও, ইংরেজদের পছন্দের ছিল। ফলত উচ্চপদস্থ সরকারি দফতরে কাজ পেয়েছিল তামিলরা। কারণ, তামিলরা ছিল উচ্চশিক্ষিত, এবং বাধ্য।
১৯৪৮ সালে শ্রীলঙ্কা ছাড়ে ব্রিটিশরা। সেই সময়ই শ্রীলঙ্কায় চালু হয়ে সংসদীয় শআসন ব্যবস্থা। দেশের ছোট বড় সমস্ত গোষ্ঠীর প্রতিনিধিদের রাখার ব্যবস্থা করা হয়। দেশে সংসদীয় ব্যবস্থা চালু হওয়ার পর এক ধরণের বৈষম্য দেখা দেয় দ্বীপ রাষ্ট্রে। তামিলরা সংখ্যালঘু হওয়ার কারণে, সংসদে ব্যাপক জায়গা দখল করতে পারেনি।
সিংহলীরা সংসদে সংখ্যাগুরুর ছিল, ফলত বেশ কিছু পরিবর্তন আনা হয় সরকারি নীতিতে। সিংহলীদের সরকারি পদে বাড়তি জায়গা দেওয়া হয়। এখান থেকেই শুরু হয় নতুন সংঘাত। বারুদের মধ্যে প্রথম স্ফূলিঙ্গ জ্বলে ওঠে ১৯৫৬ সালে। সরকারি ভাষা হিসেবে একমাত্র সিংহলী ভাষাকে মান্যতা দেওয়া হয়। ফলত সরকারের সমস্ত পদ থেকে তামিলরা পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়। ব্রিটিশশাসনকালে সরকারি ভাষা ছিল ইংরাজি, কিন্তু স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৫৬ সালে বদলে ফেলা হয় রাজভাষা। বঞ্চিত হন তামিলরা। পঠন পাঠনের ক্ষেত্রেও তামিলদের বদলে সিংহলীদের জন্য আসন সংরক্ষণ বাড়ানো হয়।
১৯৬০-৭০ সালের রেকর্ড বলছে, বহু তামিল ছাত্রছাত্রী স্কুল থেকে বেরনোর পরেও কলেজে ভর্তি হতে পারেনি। এই সময়ই তামিল সাহিত্য ও সংবাদমাধ্যমের উপরেও নিষেধাজ্ঞা জারি করে সরকার। শুরু হয় এক অদ্ভুত লড়াইয়ের রাজনীতি। ফলত ছোট খাটো হিংসা বাড়তে থাকলো। ১৯৫৬ সালে সিংহলী ভাষা সরকারি ভাবে একমাত্র ভাষা হওয়ায়, দেশে দাঙ্গা শুরু হতে থাকে। বহু ছোট খাটো দাঙ্গা হয়। যদিও ভাষা ও অধিকারকে ঘিরে কোনও বৃহত্তর আন্দোলন হত, তা মূলত শান্তিপূর্ণ ও অহিংসই ছিল। এই ভাবে চললো প্রায় ২০ বছর।
এক দীর্ঘ শান্তিপূর্ণ আন্দোলন, প্রতিবাদ বিক্ষোভের পরেও ফল না মেলায় সাতের দশকে একাংশ তামিল সশস্ত্র আন্দোলনের পথে পা বাড়ায়। কিছু সংগঠন তৈরি হয়, তার মধ্যে ১৯৭২ সালে গঠিত হয় এল টি টি ই। অন্যদিকে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে আন্দোলন চালিয়ে যায়, তামিল ন্যাশানাল অ্যালায়েন্স নামে এক সংগঠন। এই সংগঠনের দাবি ছিল, যেখানে তামিলদের সংখ্যাধিক্য রয়েছে সেখানে স্বায়ত্তশাসন দিতে হবে। এই দাবিতেই গড়ে ওঠে তামিল ডায়সপোরা। অর্থাৎ সারা বিশ্বে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা তামিলরা সংঘবদ্ধ হতে থাকে, দাবি রূপায়ণের জন্য বিদেশ থেকে ফান্ডিং আসতে শুরু করে। তবে পুরো টাকাটাই সশস্ত্র আন্দোলনের জন্য।
শ্রীলঙ্কা গৃহযুদ্ধের সময় এক বড় ভূমিকা ছিল এল টি টি ই-র। এই সশস্ত্র সংগঠনের প্রধান ছিল ভেলুপিল্লাই প্রভাকরণ। এরা দলের পতাকার যে সিম্বল ছিল, তা ভারতের তামিলনাড়ুর চোল সাম্রাজ্যের ধ্বজার। এদের সদস্যরা ছিল অত্যন্ত মোটিভেটেড। দাবি ছিল, সম্পূর্ণ স্বাধীন রাষ্ট্র। আগেই বলেছি, তামিল ন্যাশনাল অ্যালায়েন্স-স্বায়ত্ত শাসন চাইলেও, এরা চাইত আলাদা রাষ্ট্র। প্রভাকরণের এই সশস্ত্র গ্রুপ ছিল প্রচণ্ড অর্গানাইজ এবং শৃঙ্খলাপারায়ণ। সেনাতে যেভাবে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়, ঠিক সেইভাবে সদস্যদের প্রশিক্ষণ চলত। এমনকি, আত্মঘাতী স্কোয়াডও ছিল।
নয়ের দশকে এই সংগঠনের দাপট এতোটাই বাড়ে যে দেশের উত্তর ও পূর্ব দিকে, সমান্তরাল সরকার চালাতো। এমন কি নিজস্ব মুদ্রা, ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থা, এয়ারফোর্স, নৌবাহিনীও তৈরি করে ফেলে। এয়ারফোর্স খুব শক্তিশালী না থাকলেও, নৌবাহিনী ছিল অত্যন্ত শক্তিশালী। সাউথ ইস্ট এশিয়া থেকে নিজেদের জাহাজে অস্ত্র আমদানি করতো। এর পরে আসা যাক শ্রীলঙ্কার গৃহযুদ্ধ, ইলম যুদ্ধে। এই যুদ্ধের মূলত চারটি ভাগ দেখা যায়। যুদ্ধে শুরু হয় ১৯৮৩ সালে, শেষ হয় ২০০৯ সালে।
১৯৭৬ সালে এল টি টি ই তৈরি হলেও, কোনও বড় ঘটনা ঘটায়নি বা ঘটাতে পারেনি। ১৯৮৩ সালে এল টি টি ই, ১৩ জন শ্রীলঙ্কার সেনাকর্মীকে নৃশংস ভাবে হত্যা করে। এর পরেই দেশে দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে। ঘটনার জেরে প্রায় ৩০০০ তামিল নাগরিক মারা যান। সরকার এল টি টি ই-র বিরুদ্ধে চূড়ান্ত অভিযানে নামে।
এল টি টি ইও, সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে দেয়। তিন হাজার তামিল নাগরিক মারা যাওয়ার সহানুভূতিকে তারা কাজে লাগায়। ১৯৮৩ থেকে ৮৭ পর্যন্ত চলে চূড়ান্ত যুদ্ধ ও গুপ্তহত্যা। এই সময়ই ভারতের গুপ্তচর বিভাগ রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালিসিস উইং, এল টি টি ই কে মদত জোগাতে থাকে। তাদের প্রশিক্ষণ, অস্ত্র সাপ্লাইয়ের বড় ভূমিকা নেয় ভারত। ভারতের তামিল এবং শ্রীলঙ্কার তামিলদের মধ্যে যেহেতু একটা সাংস্কৃতিক সম্পর্কও ছিল, সেটা পুরো দমে কাজে লাগাত এলটিটিই। শ্রীলঙ্কায় বড় কোনও ঘটনা ঘটিয়ে গা ঢাকা দেওয়ার আদর্শ জায়গা ছিল তামিলনাড়ু।
১৯৮৭ সালে শ্রীলঙ্কা সরকার ভারতের কাছে আবেদন করে। ভারত যেন এল টি টি ই কে সমর্থন না করে। সেই সময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন রাজীব গান্ধী এবং শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট জে আর জয়বর্ধনে। দুইপক্ষের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ভারতের তরফেও বেশ কিছু প্রস্তাব দেওয়া হয়, সেগুলি হল ১। তামিল ভাষাকে মর্যাদা দিতে হবে। ২। রাজ্যগুলির মধ্যে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে। ৩। উত্তর ও পূর্ব এলাকাকে এক করে দেওয়া হোক, যাতে একই সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকে। ৪। ভারত শান্তি বাহিনী পাঠাবে। এই বাহিনী শ্রীলঙ্কা সরকার আর এল টি টি ই-র মধ্যে শান্তির সেতু বন্ধন করবে।
চুক্তি সম্পাদিত হওয়ার পরেই, এল টি টি ই-কে সাহায্য করা ছেড়ে দেয় ভারত। বিষয়টি ভালো ভাবে নেয়নি শ্রীলঙ্কার তামিলরা। তারা এবার প্রশ্ন তুলতে শুরু করে, তারা লড়াই চালাচ্ছে সরকারের বিরুদ্ধে ভারত নাক গলাচ্ছে কেন? যদিও সেই সময় শান্তি বাহিনীর কাছে এল টি টি ই ছাড়া বাকি সমস্ত সশস্ত্র সংগঠন আত্মসমর্পণ করে। শ্রীলঙ্কা ভারতের দাবিও মেনে নেয়।
১৯৮৭ সালে ভারত শান্তি বাহিনী পাঠায়, পোশাকি নাম ছিল অপারেশন পবন নামে। তার উপরেই হামলা চালায় এল টি টি ই। যদিও ভারতীয় সেনা এল টি টি ইদের জাফনা থেকে সরিয়ে দেয়। ১৯৮৭ থেকে ৯০ পর্যন্ত চলতে থাকে অপারেশন পবন। এই সময়ে ভারতে এক অদ্ভুত রাজনৈতিক ডামাডোল শুরু হয়। ৮৯ সালে রাজীব গান্ধী হেরে যান। সেই সময় প্রশ্ন ওঠে, শ্রীলঙ্কায় সেনা মোতায়েন রাজীবের সিদ্ধান্ত ছিল। অযথা দেশের টাকা খরচ করা হচ্ছে, পড়শি দেশের সমস্যায়। তাই শ্রীলঙ্কা থেকে সেনা সরিয়ে আনা হোক। এদিকে শ্রীলঙ্কাতেও একটা ক্ষোভ জমতে থাকে, শ্রীলঙ্কার মাটিতে তিন বছর ধরে ভারতীয় সেনা কী করছে? দেশের অভ্যন্তরীণ চাপে ভারত সেনা প্রত্যাহার করে।
১৯৯১ সালে ভারতে সাধারণ নির্বাচন, সেই সময় রাজীবের জেতার সম্ভাবনা প্রবল হয়। অন্তত রাজনৈতিক হাওয়া তাই ছিল। এল টি টি ই আশঙ্কা করতে থাকে, রাজীব গান্ধী ফের ক্ষমতায় এলে, শ্রীলঙ্কায় ফের একবার শান্তি বাহিনী পাঠাতে পারে। রাজীবকে হত্যার পরিকল্পনা করে এবং তা সম্পন্নও করে।
এর পর, বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ হামলা চালিয়ে যায় এল টি টি ই। মাঝে শান্তি বৈঠক হলে, এই বৈঠককে স্রেফ বাহানা হিসেবে ব্যবহার করতো প্রভাকরণ। সে নিজেও জানতো, শান্তি বৈঠকে বসা একটা অজুহাত মাত্র, এই ফাঁকে অস্ত্র আমদানি আর প্রশিক্ষণ, কর্মী নিয়োগ চলতো জোর কদমে।
২০০০ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ট্যুইন টাওয়ারে হামলা চালায় আল কায়দা। এরপর বিশ্ব জুড়ে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে আমেরিকা। ঘোষণা করা হয়, যে দেশ সন্ত্রাসবাদের শিকার তাকেই সাহায্য করবে আমেরিকা। শ্রীলঙ্কা সরকারও বাড়তি জোর পায়। এদিকে প্রভাকরণ বার্তা দেওয়ার চেষ্টা করে আল কায়দার সঙ্গে তাদের গুলিয়ে ফেলা হচ্ছে, তাদের লড়াই সরকারের বিরুদ্ধে, নীতির বিরুদ্ধে। আর আল কায়দা লড়াই চালাচ্ছে নিজেদের ধর্মের নামে।
২০০২ সালে নরওয়ের মধ্যস্থতায় শ্রীলঙ্কা সরকার আর এল টি টি ই-র মধ্যে শান্তি চুক্তি সম্পাদিত হয়। এই চুক্তি কাগজো হলেও, বাস্তবে অস্ত্র বিরতি লঙ্ঘন চলছিলই। যদিও নরওয়ে চুক্তিতে স্বাধীন দেশের দাবি ছেড়ে, যুক্তরাজ্যের দাবি মেনেছিল এলটিটিই। কিন্তু সরকারের বিরুদ্ধে বারবার এল ই টি ই অভিযোগ আনতে থাকে, সরকারপক্ষ অস্ত্রবিরতি লঙ্ঘন করছে। ২০০৪ সালে আরও এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে। বড় ভাঙন ধরে এল টি টি ই তে। প্রভাকরণের প্রায় ডান হাত করুণা গ্রুপ ছেড়ে সরকারের পক্ষ নেয়। পাশাপাশি ২০০৪ সালে সুনামিও আছড়ে পড়ে শ্রীলঙ্কায়। প্রায় ৩৫ হাজার মানুষ মারা যান। এবং এল টি টি ই-র দখলে যে জায়গা ছিল, সেই জায়গাগুলি ব্যাপক মাত্রায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
২০০৫ সালে দেশের প্রসিডেন্ট নির্বাচন হন, মাহিন্দা রাজাপক্ষে। এই সময় বিদেশমন্ত্রীকে হত্যা করে এল টি টি ই। ২০০৬ সালে যুদ্ধ চরম রূপ নেয়। ২০০৮ সালে সেনা জোর বাড়ায়। চলতে থাকে লাগাতার অভিযান। ২০০৯ সালে পুরো এল টি টি ই দের এলাকা দখল নেয় শ্রীলঙ্কা সেনা এবং এনকাউন্টারে মারা যায় প্রভাকরণ। মারা যায়, তার নাবালক পুত্রও।
Free Access