মায়ানমারে কেন যুদ্ধ করছে চিন জাতির মানুষেরা, কীযোগ এদের ভারতের সঙ্গে!
৬০ ধরনের উপজাতি রয়েছে যারা প্রায় ২০ উপভাষায় কথা বলে থাকে অঞ্চলভেদে

The Truth of Bengal: ভারত স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই এক অদ্ভুত ছাই চাপা আগুনে জ্বলছে উত্তরপূর্ব ভারত। কখনও নাগাল্যান্ড, কখনও মণিপুর আবার কখনও অসম। স্থানীয় জনজাতি, উপজাতিদের মধ্যে চলে এক অদ্ভুত লড়াই। তার কিছু শিকড় রয়েছে পড়শি দেশ মায়ানমারেও।
সাংস্কৃতিক দিক থেকে বিচার করলে বৈচিত্র্যের দেশ হিসেবে ভারতের মতো মায়ানমারকেও বিচার করা চলেছে। কিন্তু ভারত ও মায়ানমারের পার্থক্য যেমন রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে রয়েছে, তেমন রয়েছে সাংস্কৃতিক দিক থেকেও। সরকারি পরিসংখ্যান বলছে, ১৩৫ রকমের জনজাতির বাস মায়ানমারে। যাঁদের মধ্যে রয়েছে শতাধিক ভাষা ও উপভাষা। এদের মধ্যেই একটি জনজাতি হল চিন। ২০১৪ সালের মায়ানমারের জনসংখ্যা সমীক্ষা অনুসারে প্রায় ৫ লক্ষ চিন মানুষ রয়েছেন।
চিন জনজাতির বসবাস দক্ষিণ-পশ্চিমস্থ মায়ানমারে চিন রাজ্যে, যার পশ্চিমে রয়েছে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বিভাগ ও ভারতের মিজোরাম রাজ্য এবং উত্তরে মণিপুর রাজ্য, পূর্ব দিকে মায়ানমারের সাগাইং বিভাগ এবং ম্যাগওয়ে বিভাগ, দক্ষিণে রাখাইন প্রদেশ।
সরকারি তথ্য বলছে, চিনদের মধ্য ৬০ ধরনের উপজাতি রয়েছে যারা প্রায় ২০ উপভাষায় কথা বলে থাকে অঞ্চলভেদে। তাদের মধ্যে সংস্কৃতিগত, ভাষাগত কিছু পার্থক্য থাকলেও ইতিহাস, ঐতিহ্য, ভৌগলিক অবস্থানই এদের ঐক্যবদ্ধ ‘চিন’ জাতিতে পরিণত করেছে। মায়ানমারে বৌদ্ধ ধর্মালম্বীর সংখ্যা বেশি থাকলেও চিন জাতির নাগরিকরা, ৯০ শতাংশ খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী। ইতিহাস বলছে, ১৯৮৮ সালের পর চিন রাজ্যে ব্যাপক সামরিক অভিযান চালানো হয়। এরপরেই নানা ভাবে বৈষম্যের শিকার হতে থাকে তারা। একটা অংশ শরণার্থী হয়ে চলে আসে ভারতে একটা অংশ মালেশিয়ায়। মায়ানমারে দীর্ঘদিন ধরেই তারা স্বায়ত্ত্বশাসনের দাবী জানিয়ে আসছে।
ইংরাজি পরিভাষায় যাকে বলে এথনিক কনফ্লিক্ট বা জাতিগত লড়াইয়ে মূলে রয়েছে, জাতি গোষ্ঠী চেতনা। এর পাশাপাশি যেগুলি জায়গা দখল করে রয়েছে, সেগুলি হল অর্থনৈতিক স্বার্থ, অসম মর্যাদা, আধুনিকীকরণ, সাংস্কৃতিক বহুত্ববাদ। যেখানে মানুষের জন্ম হয়, বেড়ে ওঠে, সেখানকার ঐতিহ্যের টান বেশি থাকে, আর সেখানে জাতিগত সংঘাতও বাড়ে। জাতিগত ঐতিহ্যরক্ষার সংঘাতে কখনও কখনও জায়গা করে নেয় অস্ত্র।
জাতিগত সংঘাতের আরেকটি কারণ অর্থনৈতিক স্বার্থ। জাতিভিত্তি পরিচয়ের ভিত্তিতে শ্রম-বিভাজন, শ্রেণী সৃষ্টি ইত্যাদির মাধ্যমে বিভাজন লক্ষ্য করা যায়। অর্থনৈতিক লাভ ও ক্ষতি হিসেব নিয়ে, দুই গোষ্ঠীর মধ্যে মধ্যে যেমন ব্যবসায়ী-ব্যবসায়ী, ব্যবসায়ী-শ্রমিক, শ্রমিক- শ্রমিক দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। যেমন- একটি দেশের মূলধারার জনগণ যখন ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর কোনও পণ্যকে বর্জন করে, তখন তাদের মধ্যে অর্থনৈতিক স্বার্থ বিঘ্নিত হয়। দেখা দেয় সংঘাত।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরুর পর ব্রিটিশ উপনিবেশিক শাসককে উপড়ে ফেলতে, জাপানে প্রশিক্ষণের জন্য যান, তিরিশজন বার্মিজ। প্রতিষ্ঠা করেন বার্মিজ ইন্ডিপেন্ডেন্ট আর্মি (বিআইআর)। ১৯৪২ সালের দিকে রেঙ্গুন দখল করে তারা ‘বার্মা রাষ্ট্র’ নামে জাপানের পুতুল রাষ্ট্র গড়ে তোলেন।
বর্তমানে অং সান সুচির বাবা অং সান, যিনি ছিলেন সেই তিরিশজনের একজন। যখন দেখেন জাপানিদের অবস্থা খারাপ হচ্ছে, তখনই পালা বদলে ফেলেন তাঁরা। উপমহাদেশ থেকে ব্রিটিশরা চলে গেলেও অং সানের হাত ধরে বার্মা স্বাধীনতা পায়। অং সান প্যাংলং চুক্তির মাধ্যমে সেখানকার বিভিন্ন গোষ্ঠী গুলিকে স্বশাসন বা অটোনমি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। যদিও তাঁর মৃত্যুর পর, সেই পর্ব হিমঘরে চলে যায়। পরে ১৯৬২ সালে সামরিক বাহিনী অভ্যুত্থানে ক্ষমতা দখল করে। এরপরেই জুন্টা সরকার স্থানীয় জন গোষ্ঠীগুলির উপর চড়াও হয়। সামরিক বাহিনী গোষ্ঠীগুলির বিদ্রোহ ও আন্দোলনের ঝাঁঝ দেখে সমঝোতা করতে বাধ্য হয়। কিন্তু সামরিক সরকার তাদের স্বায়ত্তশাসন মেনে নেয়নি।
চিন প্রদেশে যে চিন জনজাতি বসবাস করে তারা মূলত প্রায় ৫৩ ধরনের ক্ষুদ্র স্থানীয় আদি জনজাতি। তাদের মধ্যে প্রধান দুটি শাখা বার্মিজ কুকি-চিন ও চিন-নাগা। ১৮২৪ সালে বার্মা ব্রিটিশ শাসনে অন্তর্ভুক্ত হলেও ১৮৯৬ সালের পুকোক্কু চিন হিলস রেগুলেশন অ্যাক্ট অনুসারে চিন প্রদেশ আলাদাভাবে শাসিত হয়েছে। কিন্তু মায়ানমারে একের পর এক সামরিক জুন্টা সরকার ক্ষমতায় এলেও এদের স্বায়ত্ত্বশাসনকে স্বীকৃতি দেয়নি। বরং দাবি জানানো হলে, তাদের উপর চালানো হচ্ছে মারাত্মক অভিযান।
১৯৮৮ সালে ‘৮৮৮৮’ আন্দোলনের সময় সামরিক জুন্টা সরকারের ভিত যখন নেড়ে ওঠে, সেই সময় সেনা সরকার নির্বিচারে হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করে। সেই বছরই প্রতিষ্ঠিত হয় চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট বা সিএনএফ যার সামরিক শাখা প্রতিষ্ঠান হচ্ছে চিন ন্যাশনাল আর্মি (সিএনএ), যারা চিন প্রদেশের স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে সামরিক জুন্টা সরকারের বিরুদ্ধে। জান্তা সরকারও চিন সাধারণ নাগরিকদের উপর চালাচ্ছে নির্যাতন, নির্বিচারে গ্রেফতার, বেআইনি আটক, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এসবতো লেগেই রয়েছে। এমনকী চিনাদের সহযোগিতায় মায়ানমারের জুন্টা সরকার বিমান হামলা চালাচ্ছে চিনদের উপর।
২০২১ সালে ফের একবার সামরিক বাহিনী ক্ষমতায় আসার পর থেকে ২০২৩ সালের অগাস্ট পর্যন্ত অন্ততপক্ষে ৪৪০ জন চিনকে হত্যা করে, অন্ততপক্ষে ৬৪ চিন বিমান হামলায় তাদের ঘরবাড়ি হারিয়েছে, আহত হয়েছে কমপক্ষে ৪১ জন। মোট ৭৭ বার বিমান হামলা চালানো হয়েছে, তার জেরে ১৪৭টি বাড়ি ও ধর্মীয় উপাসনালয় গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। বিমান হামলার ৭০ শতাংশের বেশি পরিচালিত হয় ২০২৩ সালের প্রথম মাত্র ৪ মাসে। পরিসংখ্যান বলছে, চিনদের ৭০ শতাংশই দারিদ্রসীমার নিচে বসবাস। বর্তমানে চিনদের অনেকে গৃহহারা, অনেক চিন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছে। যার জেরে জুন্টা সরকারের বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে নিতে বাধ্য হয়েছে তারা।
১৯৪৮ সালে বার্মার স্বাধীনতার আগে পর্যন্ত চিন প্রদেশ ছিল প্রধান-শাসিত, এবং বার্মা থেকে স্বাধীন অঞ্চল। অং সানের নেতৃত্বে বিভিন্ন জাতিগত গোষ্ঠী নিয়ে যখন ইউনিয়ন অব বার্মা জন্ম গঠিত হয়, তখন চিনও ছিল তার অংশ। প্যাংলং চুক্তির মাধ্যমে একনায়কতান্ত্রিক শাসনের অবসান হয়, এবং গণতন্ত্রের সূচনা হলেও তা স্থায়ী হয়নি। বার্মার প্রতিষ্ঠাতা অং সানকে হত্যা করার পর, ১৯৪৭ সালে যখন বার্মার সংবিধান রচনা হয়, তখন উপজাতিদের আলাদা প্রদেশগুলো অভ্যন্তরীণ উপনিবেশে পরিণত হয়। তারাই এখন গণতন্ত্রের পক্ষে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে।
১৮০০ সালে চিন প্রদেশে শুরু হয় আমেরিকান ব্যাপ্টিস্ট চার্চের ধর্মীয় মিশন। যার ফলে চিন প্রদেশের খ্রিস্টধর্মাবলম্বীরা ধর্মের ভিত্তিতে এক হতে থাকে। ফলত মায়ানমার একটি বৌদ্ধ ধর্মপ্রধান দেশ হলেও চিনরা খ্রিস্টধর্মাবলম্বী জাতি হয়ে ওঠে, যাদের বেশিরভাগ আমেরিকান ব্যাপ্টিস্ট চার্চপন্থী। সামরিক জুন্টা সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই চিনদের নির্যাতনের পেছনে একটি কারণ দর্শিয়ে থাকে, সেটি হল তাদের ধর্মীয় ভিন্নতা। সরকারের বিমান হামলার অন্যতম লক্ষ্যবস্তু হচ্ছে চিনদের ধর্মীয় উপাসনালয়গুলি। জুন্টা সরকার প্রায় ২০০টি ধর্মীয় উপাসনালয় ধ্বংস করেছে, যার মধ্যে পশ্চিম চিন প্রদেশের খ্রিস্টান চার্চের সংখ্যাই হচ্ছে ৮৫টি।