
Truth of Bengal, রাজু পারাল: শিল্প ও সাহিত্যের পবিত্র তপোবনে যে সকল গুণী মানুষ তাঁদের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেগিয়েছেন তাঁদের মধ্যে শিল্পগুরু অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাম অনে কউঁচুতে আছে। প্রাণহীন যান্ত্রিক শিল্প চর্চাকে বর্জন করে নতুন আঙ্গিকে, নতুন প্রকাশ চেতনায় ভারতীয় শিল্পকে সঞ্জীবিত করে জাতিকে নিষ্কৃতি দিয়েছিলেন তিনি। রং ও রেখার এক আশ্চর্য জাদুকর ছিলেন। দর্শকের কাছে তিনি পরিচিতি লাভ করেন ‘ছবির রাজা’ হিসেবে। শিল্পের প্রতি অনুরাগই তাঁকে পৌঁছে দিয়েছিল দক্ষতার শীর্ষে। হয়ে উঠেছিলেন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ শিল্পীদের একজন। তাই মৃত্যুর ১৫০ বছরের অধিক পরেও তাঁর চর্চাআজওসমান প্রাসঙ্গিক।
নবজাগরণের পীঠস্থান জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে জন্মাষ্টমীর দিন জন্ম নেন শিল্পীগুরু অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের তৃতীয় পুত্র গিরিন্দ্রনাথের পৌত্র। তাঁর পিতা গুণেন্দ্রনাথ ও মাতা সৌদামিনী দেবী। পিতা গুণেন্দ্রনাথ ছিলেন ছবি আঁকায় বিশেষ পারদর্শী। সৌখিন ও সৌন্দর্য রসিক মানুষও ছিলেন তিনি। বড় দাদা গগনেন্দ্রনাথ ও ছোট বোন সুনয়নী দু’জনেই ছিলেন সেকালের নামজাদা চিত্রশিল্পী। মেজদাদা সমরেন্দ্রনাথও ছিলেন শিল্পরসিক। পোট্রেট আঁকায় পারদর্শী ছিলেন কাকা জ্যোতিরিন্দ্রনাথও। এরকমপরিবেশে বড় হওয়ায় অবনীন্দ্রনাথের মধ্যেও গড়ে ওঠে শিল্পের প্রতি সহজাত আকর্ষণ।
বলবাহুল্য, ঠাকুর পরিবারের আবহাওয়া ছিল তৎকালে সাহিত্য, অঙ্কন,সঙ্গীত, অভিনয়ইত্যাদির এক বৈচিত্র্যময় পরিবেশ। রবীন্দ্রনাথের বড়দা দ্বিজেন্দ্রনাথ থেকে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরবাড়িতে এই সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল গড়ে তুলেছিলেন।তবে, অবনীন্দ্রনাথের জীবনের সবকিছু প্রেরণার উৎস ছিল কাকা রবীন্দ্রনাথ (অবন ডাকতেন ‘রবিকা’)। কবিগুরু’চিত্রাঙ্গদা’ লেখা শেষ করে অবনীন্দ্রনাথকে বলেছিলেন আঁকার জন্য। সে প্রসঙ্গে অবনীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘‘… এই হল রবিকাকার সঙ্গে আমার প্রথম আর্ট নিয়ে যোগ। তারপর থেকে এতকাল রবিকাকার সঙ্গে বহুবার আর্টের ক্ষেত্রে যোগাযোগ হয়েছে, প্রেরণা পেয়েছি তাঁর কাছ থেকে। আজ মনে হচ্ছে আমি যা কিছু করতে পেরেছি তার মূলে ছিল তাঁর প্রেরণা।’’
বাল্যকাল থেকেই অবনীন্দ্রনাথের মনটা ছিল ‘চোখে ভরা’। যা কিছু দেখতেন, যা কিছু ভাবতেন সবই তাঁর মনে ছবি হয়ে উঠত, আর তাঁর কথার মধ্যে ফুটে উঠত সেই ছবির ব্যঞ্জনা। তাঁর বাল্যকালের স্মৃতিকথাকতকটা বাস্তব আর কতকটা মিশে আছে বাল্যমনের কল্পনা। তাঁর বাল্যজীবন কেটেছে পদ্মদাসী ও রামলাল চাকরের কাছে। পদ্মদাসীর কথা বৃদ্ধ বয়সেও যে তাঁর স্মৃতি জুড়ে কতটা ছিল, সে কথা তিনি ‘আপন কথা’-য় বলেছেন:”আলোর কাছে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি পদ্মদাসী মস্ত একটা রুপোর ঝিনুক আর গরম দুধের বাটি নিয়ে দুধ জুড়োতে বসে গেছে—তুলছে আর ঢালছে সেই তপ্ত দুধ। দাসীর কালো হাত দুধ জুড়োবার ছন্দে উঠছে আর নামছে, নামছে উঠছে।”
বাল্যকালে পদ্মদাসীকে ছাড়া এক দণ্ডও চলত না অবনীন্দ্রনাথের। সকালে ঘুম ভাঙানো থেকে রাতে ঘুম পাড়ানো পর্যন্ত তাঁর সব কাজের দায়িত্বেই ছিল পদ্মদাসী। বাস্তব অভিজ্ঞতার সঙ্গে শিশুমনের খেয়ালি কল্পনার কত ছবিই না ছড়িয়ে ছিল তাঁর আঁকা ও লেখায়। একা ঘরে বসে দেখতেন নানা ধরনের ছবি। চোখে পড়তো দেওয়ালে টিকটিকি ওৎ পেতে আছে, চড়ুই বাসাবাঁধছে, চিল চুপ করে বসে আছে, খড়খড়ির ফাঁক দিয়ে আলো এসে পড়েছে, দেওয়ালে হেঁটে চলেছে মানুষের ছায়া। দুপুরে ছোট পিসির ঘরে ঢুকে তন্ময় হয়ে দেখতেন দেওয়ালে ঝোলানো দেবদেবীর পট, অয়েল পেন্টিং আর কৃষ্ণনগরের মাটির পুতুল। অবাক চোখে তাকিয়ে দেখতেন ‘শ্রীকৃষ্ণের পায়েস ভক্ষন, ‘শকুন্তলা’, ‘মদনভস্ম’, ‘কাদম্বরী’ইত্যাদি।
নয়কী দশবছর বয়সে সপরিবারে একবার কোন্নগরের বাগানবাড়িতে গেলেন তাঁরা। সেখানেই প্রকৃতির সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ পরিচয় হল। কাগজ-পেন্সিল-তুলি-কলম নিয়ে বসে পড়লেন অবন। কলসি কাঁখে মেয়েরা নদীর ঘাটে যাচ্ছে, ছেলেরা পাঠশালায় চলেছে, রাখাল বালক গরু নিয়ে ঘরে ফিরছে, মুদির দোকান, বাঁশঝাড়, রথতলা, ধান খেত, নদীর বুকে ভাসমান নৌকা—এসব দেখলেন আর আঁকলেন।
অবনীন্দ্রনাথ বাল্যকালে আঁকার প্রেরণা পান মায়ের কাছ থেকে। তবে তাঁর প্রথাগত অঙ্কন শিক্ষার শুরু ২৫-২৬ বছর বয়েসে। পরিবারিক বন্ধু কুমুদ চৌধুরি তাঁর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেন আর্ট স্কুলের ভাইস প্রিন্সিপাল ইতালিয়ান শিল্পী গিলার্ডির। অবনীন্দ্রনাথ তাঁর কাছেই শিখলেন প্যাস্টেল, তেল রং, প্রতিকৃতি আঁকা। ৬মাস শেখার পর বন্ধ করলেন গিলার্ডি’র কাছে আঁকা শেখা। বাড়িতেই ছবি আঁকবেন বলে স্টুডিয়ো খুললেন। উৎসাহ দিলেন কাকা রবীন্দ্রনাথ। সে সময়ে তাঁদের বাড়িতে আসতেন কেরলের প্রসিদ্ধ শিল্পী রবি বর্মা। তিনি অবনীন্দ্রনাথের আঁকা ছবিগুলির প্রভূত প্রশংসা করলেন।
১৮৯৩ সালে ইংরেজ শিল্পী সিএলপামারের কাছে অবনীন্দ্রনাথ পুনরায় শুরু করলেন আঁকা শিক্ষার পর্ব। পামারের কাছে রপ্ত করলেন জল রং, কালি-কলম ও তেল রঙের পদ্ধতি। ইউরোপীয় কায়দায় ছবি আঁকায় দক্ষ হয়ে উঠলেও তাঁর মন সর্বদাই অতৃপ্তিতে ভুগত। দেশীয় ছবিরসূক্ষ্মকারুকার্য, ঔজ্জ্বল্য এবং বর্ণ সমাবেশ তাঁর মনকে এমনভাবে আকৃষ্ট করল যে তিনি দেশীয় রীতিতেই ছবি আঁকার সিদ্ধান্ত নিলেন শেষপর্যন্ত।
নতুন উৎসাহে এঁকে চললেনবৈষ্ণব পদাবলী, বেতাল পঞ্চবিংশতি, কৃষ্ণলীলাইত্যাদি। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের উত্তাল রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে অবনীন্দ্রনাথ এঁকেছিলেন তাঁর সবথেকে আলোচিত ছবি ‘ভারতমাতা’। অবনীন্দ্রনাথ তাঁর গভীর দেশপ্রেম ও অভিনব কল্পনার পরিচয় দিয়েছিলেন ছবিটিতে। ভগিনী নিবেদিতা ছবিটি দেখে ‘প্রবাসী’ (ভাদ্র,১৩১৩) পত্রিকায় লিখেছিলেন,‘‘এই ছবিখানি ভারতীয় চিত্র শিল্পে এক নবযুগের প্রারম্ভ সূচনা করিবে বোধ হয়… চিত্রপটে তৎকর্তৃক পরিব্যক্ত মানসিক আদর্শ খাঁটি ভারতের জিনিস; আকার-প্রকারও ভারতীয়।’’
প্রথমে চিত্রটির নাম অবনীন্দ্রনাথ ‘বঙ্গমাতা’ রাখলেও পরে ভগিনী নিবেদিতার নামকরণ করেন ‘ভারতমাতা। চিত্রটির মধ্যে দিয়ে শান্ত, অভয় এবং সমৃদ্ধি প্রদানকারী মাতৃদেবীর রূপকে কল্পনা করা হয়েছে। সমকালে বিভিন্ন আন্দোলনে মিছিলের সামনে এই চিত্রটি আন্দোলনকারীদের হাতে থাকত। অবনীন্দ্রনাথ ও তাঁর শিষ্যদের ছবি এদেশে যেমন বহুবার প্রদর্শিত হয়েছে, তেমনই তাঁদের ছবির প্রদর্শনী হয়েছে লন্ডন, প্যারিস ও টোকিওতে। ফলে তাঁর খ্যাতি কেবল ভারতে নয়, বিদেশেও ছড়িয়ে আছে। অবনীন্দ্রনাথের অনেক ছবি বিদেশি শিল্প রসিকেরা কিনে নেওয়ায় সেগুলি বিদেশে চলেগিয়েছে।
এছাড়া অবনীন্দ্রনাথ ছবি শেষ করে উপহার দিয়েছেন শিল্পরসিক বিশিষ্ট মানুষদের ও প্রিয়জনদের। অবনীন্দ্রনাথের আঁকা বেশ কিছু ছবি রয়েছেভারতীয় মিউজিয়াম, ন্যাশনাল গ্যালারি (দিল্লি), কলাভবন (শান্তিনিকেতন) এবং দেশ-বিদেশের বহু ব্যক্তিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক সংগ্রহে। বলাবাহুল্য, অবনীন্দ্রনাথ যে চিত্রকলার সৃষ্টি করেছিলেন সে যুগে তা আজও শিল্পরসিকদের মুগ্ধ করে। ষাট বছরের কাছাকাছি এসে ছবি আঁকা প্রায় ছেড়েই দিলেন অবনীন্দ্রনাথ। নিজেই বলতেন,‘আর মন ভরে না’।
একসময়ে রবিকার (রবীন্দ্রনাথ) উৎসাহে লেখার দিকেও ঝুঁকেছিলেন অবনীন্দ্রনাথ। তাঁর কলম থেকেই জন্ম নিয়েছিল’ক্ষীরের পুতুল’, ‘রাজ কাহিনি’,’নালক’,’ বুড়ো আংলা’,’ভূত পতরীর দেশ’,’জোড়া সাঁকোর ধারে’,’ রং বেরং’, ‘মাসি’,’বাগেশ্বরী শিল্প প্রবন্ধআবলি’,’বসন্তের হিমালয়’ ইত্যাদি কালজয়ী সাহিত্য। অবনীন্দ্রনাথের পাণ্ডিত্য ও মৌলিকতার পরিচয় পেয়ে১৯২১ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ডিলিটউপাধি দিয়ে সম্মানিত করে। ১৯৪১ সালের ৭ আগস্ট সব কিছু বদলে গিয়েছিল অবনীন্দ্রনাথের।
ওই দিনেই চিরকালের জন্য রবিকাকা পাড়ি দিয়েছেন চিরঘুমের দেশে। অবনীন্দ্রনাথ বাড়ির দক্ষিণের বারান্দায় বসে আপন মনে এঁকে চলেছেন রবিকাকার অন্তিম যাত্রার ছবি। পরে যা ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় ছাপা হয়। ১৯৪১সালে অবনীন্দ্রনাথ ও তাঁর পরিবার ঠাকুরবাড়ি ছেড়ে বরাহনগরের ‘গুপ্ত নিবাস’-এ উঠলেন। সেখানেই কাটিয়েছিলেন জীবনের শেষ কটা দিন। ১৯৫১সালের ৫ ডিসেম্বর না ফেরার দেশে চলে যান শিল্পগুরু অবনীন্দ্রনাথ।