বিনোদন

যখন সিনেমা হল’টাই স্টেডিয়াম! ফুটবল ও অজয় এর যুগলবন্দীতে কেমন হল ‘রহিম’ কাহিনী?

The Truth Of Bengal: ১৯৫২ থেকে ১৯৬২ সাল। এই দশটা বছর ভারতের ইতিহাসে পরিচিত ছিল । এবং মনে করা হয় সেই সময় থেকে আজকের ফুটবল খেলার মধ্যে তখনকার সেই কাঙ্ক্ষিত সাফল্য আর চোখে দেখা যায় না। সত্যিই তো! আজ যতই ভারত বিশ্বকাপের ময়দানে খেলার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করতে দেখা গেলেও, এবং নিঃসন্দেহে ভালো খেললেও সেই সাফল্যের চূড়ায় পৌঁছতে পারার নেশা এখনও জন্মায়নি খেলোয়াড়দের মধ্যে। অন্তত সিনেমাটি দেখার পর তা একেবারেই স্পষ্ট। ভারত যে প্রথমবারের জন্য এশিয়ান গেমস খেলে সোনা জিতেছিল তা জানেন কজন? অবশ্য না জানাটাই যদিও বিশ্বাস করবার মতো কারণ বেশি জানলে ক্ষতিও হয় বেশি! সকলে যদি জানতেন যে, ভারত এশিয়ান গেমস্ এ সোনা পেয়েছে তবে ভারতকে মাথায় তুলে রাখতেন! তা যেমন সত্য, ঠিক তার পরে অলিম্পিকে যুগোস্লাভিয়ার সঙ্গে ম্যাচ খেলে ১-১০ স্কোরে লজ্জাজনক হারের ফলে সরাসরি মাথা থেকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের মধ্যেই নামিয়ে আনতেও এক চুলও সময় লাগবে না ভারতবাসীর, সেটিও আরেকটি তিক্ত সত্য বটে। তবে না জানাটাই শ্রেয় নয়কি? এখন অনেক বড় বড় কথা বলাই যায় তবুও ২০২৪-এ দাঁড়িয়ে থেকে উন্নত পরিকাঠামো সহ বর্তমান ভারতীয় ফুটবল দলের অবস্থা যেমনই হোক না কেন, ৭২ বছর আগে কিন্তু এ দেশের জাতীয় দল বিদেশের মাটিতে গিয়ে ওই ফলাফলের পরেও দলকে যে আবারও ঘুরে দাঁড়াবার সাহস দেখিয়েছিলেন, দলের কাণ্ডারী সৈয়দ আবদুল রহিম! ‘ময়দান’ তাঁরই কাহিনি।

ছবির শুরুতেই দেখা যায় অলিম্পিকে ভারত বনাম যুগোস্লাভিয়ার সঙ্গে সেই লজ্জার হার। দলের কোচ তখন রহিম। সেইসময় ৭০ মিনিট খেলার অভ্যাস থেকে হঠাৎই বিলেতের মাঠে ৯০ মিনিট খেলার দক্ষতা তখনও জন্মায়নি দেশীয় ফুটবলার’দের মধ্যে। তার মধ্যেই খালি পায়ে খেলা। পছন্দের দল ঠিক পেয়ে ওঠেননি সেইসময় ভদ্রলোক। তাই এই হারের বদলার জন্য যে প্রয়োজন ছিল একটা ভালো দল বা টিম তা তিনি বুঝতে পারেন এবং সেটি তৈরির জন্য সম্পূর্ণ অধিকার নিয়ে নেন। আর সঙ্গে কিছু নতুন খেলার উপকরণ ও স্ট্র্যাটেজি নিতে থাকেন পাশাপাশি। এরপর নিজের হাতে করে ভারতীয় ফুটবল দল গড়ে তোলেন রোহিম। যাঁর দৌলতে ভারতীয় ফুটবল দল ১৯৫৬-তে অস্ট্রেলিয়া অলিম্পিক্সে চতুর্থ এবং ১৯৬০-এ রোম অলিম্পিক্সে চতুর্থ হন। তাঁর চেষ্টাতেই ভারতীয় ফুটবল টিম ‘ব্রাজিল অফ এশিয়া’ খেতাব করে নিয়েছিল নিজেদের নামে এবং পরবর্তীতে আমাদেরই এই ভারতীয় দল এশিয়াল গেমসে সোনা যেতে। এরপর দুরারোগ্য ক্যানসারে আক্রান্ত হন রোহিম। জীবনের শেষ মোড় থেকে তাঁর কামব্যাক সঙ্গে ফুটবল ফেডারেশনের রাজনীতির সঙ্গে লড়াই করে কীভাবে ভারতীয় দলের সঙ্গে থেকে সাফল্যের নয়া কাহিনি লিখলেন, সেই গল্পই বলা হয়েছে মূলত এই ছবিতে। যা খেলা-প্রেমিদের নিঃসন্দেহেই ভালো লাগবে। বেশি সেন্সিটিভ হলে কিছুটা মন খারাপে পরবেন সিনেমা হলেই।

যদিও সিনেমার কাস্টিং নিয়ে কথা বলার আগে কেমন হয়েছে সিনেমাটি সেটা বলে নেওয়া ভীষণ প্রয়োজনের! তাই এটুকু বলতেই হয়, সিনেমার ইন্টারভ্যাল এর আগের মুহুর্ত পর্যন্ত কিছুটা একঘেঁয়ে লাগলেও লাগতে পারে। তাছাড়াও সময়টা একেবারেই কম নয়। ৩ ঘন্টা ১ মিনিট দৈর্ঘ্যের এই সিনেমার প্রথম ১ ঘন্টার পর বিরতি হয়ে যায়। যা থেকে মনে প্রশ্ন উঠতেই পারে যে, ঠিক জমাতে পারলেন না পরিচালক। তবে বিরতির পর যখনই আপনি দ্বিতীয় পর্ব দেখা শুরু করবেন আপনাকে আর নিজের চেয়ার ছেড়ে ওঠার সুযোগ করে দেবে না ‘ময়দান’। সিনেমা হল পরিণত হবে আদর্শ এক খেলার মাঠে।

বরাবরের মতই এই ছবিতেও অজয় দেবগন’কে দুর্দান্ত অভিনয় করতে দেখা গিয়েছে। তাছাড়াও ছবির কাস্টিং এতটাই নিখুঁত যে একপ্রকার ধারনার বাইরে। রোহিম যেভাবে পরখ করে নিজের টিমকে সঠিক ফরম্যাটে সাজিয়ে ছিলেন ঠিক একই ভাবে পঞ্চাশের দশকের জাতীয় দলের সেইসকল ফুটবলারদের ছবি দেখে ও তাঁদের চরিত্রের সাদৃশ্য রেখে অভিনেতা খুঁজে বের করা এবং তাঁদের দিয়ে বিশ্বাসযোগ্য ফুটবল খেলিয়ে নেওয়ার মতো অসাধ্য সাধন করে দেখিয়েছেন পরিচালক। প্রতিটি ফুটবলার’কে এত নিখুঁত ভাবে পর্যবেক্ষণের পর কাস্টিং’এ নেওয়া হয়েছে যা সত্যিই প্রশংসা করতে বাধ্য করে। টিমের প্রত্যেক অভিনেতার কাজই প্রশংসার জন্য বাধ্য করবে। তাছাড়াও যাকে ক্রীড়া সাংবাদিকের চরিত্রে দেখা গিয়েছে, গজরাজ রাও’কেও সিনেমায় দুর্দান্ত অভিনয় করতে দেখা গিয়েছে। সিনেমায় বাংলার তিনজন অভিনেতাই ছিলেন অনবদ্য। রুদ্রনীল প্রতিবারই যেমনভাবে কথা দেন নিজের সেরা দেওয়ার জন্য, তেমনই তিনি এবারও নিরাশ করেন নি। কথা রেখেছেন তাঁর এই সিনেমাতেও দুর্দান্ত পারফরম্যান্সের মধ্য দিয়ে। সঙ্গে রহিমের স্ত্রী সাইয়ার ভূমিকায় প্রিয়ামণিকে প্রত্যেক দৃশ্যে অদ্ভুত সপ্রতিভ লেগেছে। এককথায় ‘ময়দান’-এর সব থেকে বড় আকর্ষণ ছিল সিনেমার সকল পার্শ্বশিল্পীরা।

যদি প্রসঙ্গ ওঠে এবার পরিচালনা নিয়ে, একটা নালিশ অবশ্যই করবার রয়েছে পরিচালক অমিত শর্মাকে! তার পরিচালনা যথেষ্ট সুন্দর, এবং তাতে কোনও প্রশ্ন না থাকলেও, এই সিনেমার সময়সীমা নিয়ে কিছুটা অভিযোগ থেকেই যায়। সিনেমা আরও কিছুটা ছোট হলে মন্দ হত না একেবারেই! বরং মানুষের মধ্যে প্রথম ধাপে অকারণে বিরক্ত হয়ে ওঠার প্রবণতা দেখা যেত না। অনায়াসে ৪০ মিনিট কেটে দৈর্ঘ্য আরও ছোট করাই যেত। এবং আরও কিছু ব্রেকডাউন দিলে কিংবা হৃদয়ে আঘাত করলে আরও ভালো হত, গল্পের কাঠামো।ছবিটির গানের দ্বায়িত্বে ছিলেন এ আর রহমান ও লিরিক্স লিখেছেন মনোজ মুন্তাশির। যা ছিল এককথায় দারুণ। গোটা সিনেমাটি একবার হলেও দেখাটা ভীষণ ভাবে দরকার আজকের জেনারেশনের। যারা এই সকল ব্যক্তিত্বর কথা কেবল শুনে এসেছেন, এবং যারা খেলা-প্রেমি তাদের বিশেষ করে সিনেমাটি দেখতে যাওয়া প্রয়োজন। একদম পরিবারের সঙ্গে দেখার মতো সিনেমা। যা একবার দেখার পর আবারও দেখতে ইচ্ছে করতেই পারে।

Related Articles