সম্পাদকীয়

বামেদের নিশানায় কেন ‘কবিতা অ্যাকাডেমি’?

Why is 'Kavitha Academy' targeted by the Left?

Truth of Bengal:সুমন ভট্টাচার্য:  বামেদের বা আরও নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে ‘ফেসবুকীয় বাম’-য়েদের, কারণ তার বাইরে বামেদের আর অস্তিত্বই বা কোথায় আছে, তাঁদের নিশানায় এখন এই বঙ্গের কবিতা অ্যাকাডেমি এবং তার প্রধান সুবোধ সরকার। কেন বামেদের এবং ‘ফেসবুকীয় বাম’-য়েদের নিশানায় কবিতা অ্যাকাডেমি? তার কারণ কেউ জানে না। এটা বোঝা যায়, যে ‘বাজারি’ মিডিয়া তাঁদের হাওয়া দিয়েছে এবং সেই হাওয়াতে তাঁরা কবিতা অ্যাকাডেমি নিয়ে একদম ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। আজকের সিপিএম এবং ‘নিজেদের সিপিএম মনে করা’ ‘বুদ্ধিজীবী’রা আসলে ‘বাজার’ এবং ‘বাজারি’ মিডিয়ার উৎসাহেই যাবতীয় লম্ফঝম্প করেন। অতএব ‘বাজারি’ মিডিয়া যখন বলেছে, যে কবিতা অ্যাকাডেমি নিয়ে হট্টগোল বাঁধাতে হবে, তখন ‘ফেসবুকীয় বিপ্লবী’রা একেবারে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। তাঁদের নিশানায় কবিতা অ্যাকাডেমি এবং তার প্রধান সুবোধ সরকার। অবশ্য কবিতা অ্যাকাডেমি গড়ার জন্য তাঁরা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ধন্যবাদ জানিয়েছেন, আবার সেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কেই ‘খোলা চিঠি’ লিখে ফেলতেও তৎপর হয়েছেন। প্রশ্ন হচ্ছে, যে কেন হঠাৎ ‘ফেসবুকীয় বাম’-এদের কবিতা অ্যাকাডেমি নিয়ে এত উৎসাহ? নিজেরা ডাক পাচ্ছেন না বলে? নাকি কবিতা অ্যাকাডেমি দখল নিতে চান বলে? ঠিক যেমন রাজ্য মেডিকেল কাউন্সিলের দখল নিতে চান বলে বাম এবং অতি-বাম আশ্রিত ডাক্তাররা আর জি করের পর ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন? আসলে এই রাজ্যের বাম এবং অতি-বামেদের দেখে বোঝা মুশকিল, তাঁরা ঠিক কী চান! অন্তত রাজ্যের ভালো বা মানুষের ভালো তাঁরা চান, এরকম কোনও দাবি বা এরকম কোনও প্রমাণ তাঁরা উপস্থাপিতও করতে পারবেন না, চেষ্টাও করেন না!

কেন বললাম এই ‘ফেসবুকীয় বাম’-এরা বা রাজ্যের বাম এবং অতি-বামেরা মানুষের ভালো অথবা যাতে রাজনীতিরও কোনও উপকার হয়, এমন কোনও কাজ করতে পারবেন না? গাজায় যখন গোটা প্যালেস্টাইন রাষ্ট্রটাই, সেই রাষ্ট্রের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা থেকে শিক্ষা ব্যবস্থা সব কিছু ধ্বংস করে দেওয়া হচ্ছিল, তখন এই বাম বা অতি-বামেরা কোনও প্রতিবাদই সংগঠিত করতে পারেননি। আবার বাংলাদেশে যখন ইউনুস সরকার দিনের পর দিন সেই দেশের সংখ্যালঘুদের, হিন্দুদের অত্যাচার করেছে, তাদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছে, সেখানে মহিলাদের নির্যাতন করেছে, তখনও এই ‘ফেসবুকীয় বাম’ বা অতি-বামেরা কখনও কোনও সদর্থক ভূমিকা নিতে পারেননি। রাস্তায় মিছিল করেননি, প্রতিবাদে মোমবাতি জ্বালেননি, এবং কোনও কিছুই না করতে পেরে ভেনেজুয়েলায় মাদুরো জিতেছেন কিনা, সেই নিয়ে একমাত্র উল্লাস প্রকাশ করেছেন। দক্ষিণ আমেরিকার যে নির্বাচনে ভেনেজুয়েলায় কোনও শাসক ৮৫ শতাংশ ভোট পায়, সেটা যদি গণতন্ত্র হয় এবং বাম ও অতি-বামেরা যদি সেই গণতন্ত্রের পূজারি হন, তাহলে নমস্কার তাঁদের! এবং দোহাই তাঁদের গণতন্ত্র ও রাজনৈতিক বোধ নিয়ে। আসলে কোথায় কী সমর্থন করতে হয়, সেটাই এই বাম ও অতি-বামেরা জেনে উঠতে পারেননি, বুঝেও উঠতে পারেননি। এবং আজকে যখন পৃথিবীতে দক্ষিণপন্থী শক্তি মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে, তখন তাঁরা দিশেহারা। তাঁরা জানেনও না কেন প্যালেস্টাইনে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা বা শিক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংসের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে হবে, আবার বাংলাদেশেও সংখ্যালঘু হিন্দুদের উপর যে নির্যাতন চলছে, তার বিরুদ্ধেও প্রতিবাদ করতে হবে। এই ‘ব্যালেন্স’ বা ‘ভারসাম্য’ রক্ষা করা, এবং সামঞ্জস্য রক্ষা করে চলার কোনও ইতিহাস বা বর্তমান পৃথিবীতে কোনও নিদর্শনও তাঁরা রাখতে পারছেন না।

বাম এবং অতি-বামেদের কিছু ‘প্রজেক্ট’ থাকে। ডিজাইনার প্রোজেক্ট, মানে পোস্টারের ডিজাইন ভাল হয় এবং বেশ চমৎকার ক্যাচলাইন থাকে! অন্তত গত এক বছরের রাজনীতিকে দেখলে সেরকমটাই মনে হয়। আর জি করে একটি নৃশংস হত্যা এবং তার প্রতিবাদে নারীদের ক্ষোভকে কাজে লাগিয়ে তাঁরা ভেবেছিলেন, যে পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতা দখল করে ফেলতে পারবেন। আর এই ক্ষমতা দখলের জন্য তাঁদের প্রধান সহায় ছিল ‘বাজারি’ মিডিয়া, ‘বাজারি’ মিডিয়ার সংবাদপত্র এবং সন্ধেবেলায় টেলিভিশনে বসানো ‘খাপ পঞ্চায়েত’। সন্দেশখালি থেকে আর জি করের পরবর্তী ঘটনা প্রমাণ করে দেয়, যে বামেরা কতটা শহরকেন্দ্রিক এবং কতটাই বা ‘আসলে মানুষ কী ভাবছেন’ সেই সম্পর্কে উদাসীন। এই ‘ফেসবুকীয় বিপ্লবী’রা পুজো বয়কটের ডাক দেন, তারপর শপিং মলে তাঁদের দেখা যায় এবং পুজোপ্রাঙ্গনে কবিতা বলতে ডাকলেও তাঁরা সাগ্রহে চলে যান। এই ‘ফেসবুকীয় বাম’-এদের নিয়ে আপনি কী-ই বা করবেন? আর জি কর গেল তো তাঁরা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসুর গাড়ির উপরে হামলার ঘটনাকে কেন্দ্র করে রে রে করে নেমে পড়লেন। অতি-বাম, যাঁরা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কথা বলেন, যাঁরা ‘কাশ্মীর মাঙ্গে আজাদি’ বলেন, তাঁদের সমর্থনে দেখা গেল আলিমুদ্দিন স্ট্রিট থেকে দীনেশ মজুমদার ভবন সবাই একেবারে সাগ্রহে, সোৎসাহে তৎপর। যখন কাশ্মীরে পহেলগাঁওতে নৃশংসভাবে হিন্দু পর্যটকদের মারা হল, তখন কিন্তু তারা সেই অতি-বামেদের প্রশ্ন করল না, যে এখনও কি তাঁরা ‘কাশ্মীর মাঙ্গে আজাদি’ বলবেন? প্রশ্ন করলে দেখা যেত হয়তো তখনও মাওবাদীদের সমর্থকরা তাও বলবেন! পহেলগাঁওয়ে জঙ্গি হামলার প্রত্যাঘাতে ভারতবর্ষ যখন পাকিস্তানের জঙ্গি ঘাঁটি গুঁড়িয়ে দিচ্ছে, তখন এই অতি-বামেরা কলকাতার রাস্তায় মিছিল করলেন এবং মিছিল করে ভারত রাষ্ট্রের বিরুদ্ধেই স্লোগান তুললেন! তখন কোথায় গেল আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের তৎপরতা? অতি-বামেদের কেন তারা নিয়ন্ত্রণ করতে পারল না?

পহেলগাঁও থেকে ছত্তিশগড়ে শীর্ষ মাওবাদী নেতার মৃত্যু, সবেতেই আমরা এই বাম এবং অতি-বামেদের আসলে কোন দিকে ঝুঁকে থাকা, সেটা আমরা দেখতে পেয়েছি। এঁরা ‘কাশ্মীর মাঙ্গে আজাদি’ বলতে চান, এঁরা সিআরপিএফ মারা গেলে খুশি হন, এবং নকশাল নেতা সিআরপিএফের গুলিতে মারা গেলে কেঁদে ভাসান। প্রশ্ন উঠবেই, তাহলে সেনাবাহিনী, সিআরপিএফ, আধা-সামরিক বাহিনী— এখানে যাঁরা চাকরি করেন, তাঁদের জীবনের কোনও গুরুত্ব নেই? গুরুত্ব আছে যদি তাঁদের ‘বাজারি’ মিডিয়া সন্ধেবেলার ‘খাপ পঞ্চায়েত’-এ ডেকে পাঠায়। তখন তাঁরা আবার ‘দেশভক্ত’ও হয়ে যেতে পারেন। কিন্তু যতক্ষণ না ‘বাজারি’ মিডিয়া বা টেলিভিশন চ্যানেলে ডাক পড়ছে, ততক্ষণ ‘বিপ্লবীকুল’ অবশ্যই রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে চিৎকার করতেই বেশি স্বচ্ছন্দ। সেই রাষ্ট্রের প্রতীক হিসেবে আপাতত তাঁদের নিশানা কবিতা অ্যাকাডেমি এবং সুবোধ সরকার। কেন নিশানা, তা কেউ জানে না। বিভিন্ন ‘বাজারি’ মিডিয়াও তো বিভিন্ন কবিদের পুরস্কার দিয়ে থাকেন, কোনওদিন জিজ্ঞেস করা গিয়েছে, যে কোন ‘বাজারি’ মিডিয়া কোন কবিকে কেন তুলে ধরছেন বা কেন পুরস্কার দিচ্ছেন? কারণ সেটা ‘বাজারি’ মিডিয়ার সিদ্ধান্ত’। ‘বাজারি’ মিডিয়াই তো ঠিক করে দেয়, যে পশ্চিমবঙ্গে কে কবি হবেন, কে শিল্পী হবেন, কে সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব হবেন! শুধু ‘বাজারি’ মিডিয়াকে এদের জিজ্ঞেস করবার সাহস হয়নি ভোডাফোনের যে সিইওকে এক দশক আগে তাঁরা ডেকে এনে ‘সেরা বাঙালি’ শিরোপা দিয়েছিল, সেই ভোডাফোন কোম্পানি কেন লাল বাতি জ্বালতে বসেছে? ‘বাজারি’ মিডিয়া তো! যে ‘বাজারি’ মিডিয়াতে সামান্যতম উল্লেখ পেলে, টেলিভিশনে একবার ডাক পেলে, ‘বাজারি’ মিডিয়ায় ছবি ছাপা হলে ‘বিপ্লবের বরপুত্র’রা ধন্য হয়ে যান।
এই ‘বাজারি’ মিডিয়াকে উপেক্ষা করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বা নরেন্দ্র মোদি চলতে পারেন বলেই বিপ্লবীদের যাবতীয় অসূয়া। বিশেষ করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পর্কে, কারণ তিনি তো ‘বাজারি’ মিডিয়ার ডিকটেশন বা ‘বাজারি’ মিডিয়ার বেঁধে দেওয়া লক্ষ্মণরেখার মধ্যে থেকে নিজের রাজনীতি চালান না।

অতএব, ‘বিপ্লবীকুল’ সোশ্যাল মিডিয়ায় ‘বিপ্লব’-এর বন্যা বইয়ে দিচ্ছেন। ইউনুসের পদত্যাগের নাটকের পর যখন কলকাতা থেকে ১০০ কিলোমিটারের মধ্যে যশোর, ঝিনাইদহের হিন্দুর বাড়িতে আগুন লাগানো হয়, তখন এঁদের কলমে কিছু আসে না। তখন এঁরা কোনও প্রতিবাদ জানান না; বরং ‘বিপ্লবীকুল’ ব্যস্ত থাকেন যদি জামাত নিয়ন্ত্রিত বাংলাদেশ হাইকমিশনের থেকে ডাক আসে। যদি সেখানে বর্ষায় ইলিশ আর পুজোর আগে জামদানী উপহার পাওয়া যায়। ফলে বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতন হলে তাঁদের কিছুই যায় আসে না। ঠিক যেমন তাঁদের যায় আসে না এই বিপ্লবী, অতি-বিপ্লবী বাম কবিকুলের বা তথাকথিত ‘বুদ্ধিজীবী’কুলের যদি কোনও নিরীহ মুসলিম ছেলে হরিয়ানায় কাজ করতে গিয়ে গো-রক্ষকদের কাছে পিটুনি খেয়ে মারা যান, তখনও তাঁদের ‘প্রগতিশীলতা’র মোমবাতি জ্বলে ওঠে না। কিন্তু তথাকথিত কবিতা অ্যাকাডেমি নিয়ে তাঁদের যাবতীয় উলম্ফন, লাফালাফি। যদি প্রতিভা থাকে এবং যদি সত্যিই নিজের মধ্যে বিন্দুমাত্র ‘কেপেবিলিটি’ থাকে, তাহলে কবিতা অ্যাকাডেমি নিয়ে ভাবনা-চিন্তা এত হবে কেন? সোশ্যাল মিডিয়ায় শুধুমাত্র নিজেদের বাণী ছড়িয়ে জীবন কাটবে কেন? কবিতা অ্যাকাডেমির বাইরে নিজের ভুবন বা নিজের বাজার দুটোই গড়ে নেওয়ার দক্ষতা এবং মানসিকতা থাকবে! আসলে এঁরা এতটাই পরজীবী এবং ফেসবুকজীবী যে সাধারণ মানুষের সঙ্গে এঁদের কোনও সংযোগই নেই। এঁদের মধ্যে অনেকেই সুযোগ পেলে তৃণমূল সরকারের যাবতীয় দাক্ষিণ্য চেটেপুটে নেন, কিন্তু সুবোধ সরকার যেহেতু পদে আছেন, তাই তাঁকে তো নিশানা করতেই হবে। এটা এঁরা বোঝেন না, যে এই ‘ফেসবুকীয় বিপ্লব’ দিয়ে আসলে তাঁরা নিজেদেরই ক্রমশ শূন্য থেকে মহাশূন্যের দিকে নিয়ে যাচ্ছেন।

Related Articles