সম্পাদকীয়

কে ভাবে পরিযায়ী শ্রমিকদের কথা?

Who cares about migrant workers?

Truth of Bengal, বিপ্লব চৌধুরী: ‘ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো’– এই পরিচিত প্রবাদটি আমরা সবাই জানি ও মাঝে মধ্যে বলি কখনও। কিন্তু এখানে পরিবারের খাবার জোগাড় করার জন্যই অসংখ্য মানুষকে নিজের বাড়ি ও প্রিয়জন ছেড়ে অর্থ উপার্জন হেতু দূরদূরান্তে যেতে হয়। ইউএন আন্তর্জাতিক লেবার অর্গানাইজেশনের পরিভাষায় পরিযায়ী শ্রমিক বলতে বোঝায় যারা রুজি-রোজগারের জন্য নিজের বাসস্থান থেকে দূরে বিদেশে বা দেশের মধ্যে অপেক্ষাকৃত উন্নত অর্থনৈতিক অঞ্চলে কাজে যায় তাদের।

এক রাজ্য থেকে অন্য রাজ্যে বা দেশে শ্রমিক নিয়ে যাওয়া ভারতের ইতিহাসে নতুন নয়। ১৯৪৯ সালের ‘পতাঙ্গা’ ছবির জনপ্রিয় হিন্দি গানটি ‘মেরি পিয়া গ্যায়া রেঙ্গুন, উহা সে কিয়া হ্যায় টেলিফুন’- সাক্ষ্য দেয় সেই সময়ের পরিযায়ী শ্রমিক ব্যবস্থার কথা।পৃথিবীর ইতিহাসের দাসব্যবস্থা বা ক্রীতদাস প্রথা হল আজকের পরিযায়ী শ্রমিকদের আদিম অবস্থা। যদিও উত্তরণের পথ এই পরিযায়ী শ্রমিকদের জানা নেই, তবু জীবনযুদ্ধের ওরা অপরাজেয় সৈনিক। ওরা কাজ করে নগরে বন্দরে।

২০১৯-এর তথ্য অনুযায়ী, সারা বিশ্বে প্রায় ১৬.৯ কোটি মানুষ পরিযায়ী শ্রমিক। ভারতের দিকে নজর ঘোরালে জানা যায় সারা ভারতে ২০১১ সালের জনগণনা অনুযায়ী, ৪কোটি ১৪ লক্ষ ২২ হাজার ৯১৭ জন পরিযায়ী শ্রমিক। বাস্তবে অনেক ক্ষেত্রেই সারা ভারতে ঠিক কত পরিযায়ী শ্রমিক আছে, তার রাজ্য-ভিত্তিক সঠিক তথ্য পাওয়া অসম্ভব। ভারতে মোট পরিযায়ী শ্রমিকদের ৮৩শতাংশ শ্রমিকই গ্রামীণ ভারত থেকে।

এর নেপথ্যে প্রধান কারণগুলি হল কৃষিতে ব্যর্থতা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও চরম দারিদ্র্যতা এবং দেশের ক্রমবর্ধমান বেকারত্ব। বিশেষজ্ঞরা পরিযায়ী শ্রমিকদের নিজ বাসস্থান ছেড়ে অন্যত্র কাজে যাওয়াকে ‘পুশ’ ও ‘পুল’ এই দুটি তকমা দিয়ে সংজ্ঞায়িত করেছেন। ‘পুশ’ অর্থাৎ চলতি ভাষায় ধাক্কা দেওয়া, এই ধাক্কা বলতে জনতাত্ত্বিক ও অর্থনৈতিক দারিদ্র্যকে বুঝিয়েছেন। অপরদিকে ‘পুল’ অর্থাৎ টেনে নেওয়া, এই ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক উপার্জন ও কাজের সুযোগকে বুঝিয়েছেন।

শহুরে ভারতে প্রতি তিন জনের মধ্যে একজন হল পরিযায়ী শ্রমিক। সহজেই অনুমেয় পরিসংখ্যানটা কতটা উদ্বেগের।  অর্থনৈতিক উপার্জনের জন্য এই পরিযায়ী শ্রমিকদেরকী পরিমাণ অমানুষিক পরিশ্রম করতে হয়, তাও আবার নায্য বেতন পায়না এবং চরম অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে একসঙ্গে অনেক শ্রমিকেরথাকতে হয়। প্রতি বছর কেন্দ্রীয় ব্যাজেট আসে যায়, কিন্তু খুব বেশি কথা থাকে না এই অসহায় পরিযায়ী শ্রমিকদের বিষয়ে।

ভারতে পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য আন্তঃরাজ্য পরিযায়ী শ্রমজীবী আইন ১৯৭৯ সালে তৈরি হয়। এই আইনে বলা আছে, পরিযায়ী শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি, তাদের সন্তানদের লেখাপড়ার বন্দোবস্ত-সহ তাদের সব দিক থেকে সুরক্ষা দেওয়ার কথা। কিন্তু  ঠিক তার বিপরীত ছবি দেখতে পাই। আপাতদৃষ্টিতে মনে হবে শ্রমিকদের জন্য সব রকম সুরক্ষা আছে কিন্তু কার্যত সবই কুহেলিকা। পরিযায়ী শ্রমিকদের অবস্থার উন্নতির জন্য আইন আছে প্রয়োগ নেই।

সরকার আছে কিন্তু পরিযায়ী শ্রমিকদের সমস্যার সুরাহা হয় কোথায় ? ১৯৪৭ সালের দেশভাগের সময় ছিন্নমূল মানুষের পথচলার সেই এক ছবি আরও একবার ফুটে উঠেছিল ২০২০ সালের ২৪ মার্চ কেন্দ্রীয় সরকার দ্বারা করোনাজনিত কারণে লকডাউন ঘোষণা করা হলে পরিযায়ী শ্রমিকদের অবস্থা হয় মর্মান্তিক। মুহূর্তে কাজ হাজার হারানো লাখ লাখ পরিযায়ী শ্রমিকদের পথচলা ও নিদারুণ কষ্টের সাক্ষী আমরা সবাই। ২০২০ সালের পর কেটে গিয়েছে অনেকটা সময়।

রাষ্ট্রীয়ব্যবস্থা, উৎপাদন সংস্থার মালিক সবাই অবগত পরিযায়ী শ্রমিকদের ছাড়া দেশের উৎপাদন ব্যবস্থা, নির্মাণশিল্প-সহ নানা কাজ বন্ধ হয়ে যাবে। তবুও তাদের অসহায়ত্ব দূর হয় না কেন? পরিযায়ী শ্রমিকরাও জানে গ্রামে, মফস্বলে কাজ নেই, তাই তারা শত কষ্ট সহ্য করেই কাজ করে যেতে বাধ্য হয়। একবিংশ শতাব্দীর নয়া দাসত্ববাদের শৃঙ্খলে ওরা আবদ্ধ।  ২০১৭ সালের ইকোনমিক সার্ভের তথ্য অনুযায়ী, ভারতে যে সমস্ত রাজ্য থেকে বেশি সংখ্যক মানুষ পরিযায়ী শ্রমিক হয়ে অন্যত্র যায়, সেই রাজ্যগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য বিহার, উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, হিমাচল, কেরল, তেলেঙ্গানা, ঝাড়খণ্ড, পশ্চিমবঙ্গ, ওড়িশা,অসম এবং উত্তর ভারতের কিছু রাজ্য।

আর যে সকল রাজ্যে অধিক পরিযায়ী শ্রমিকের দেখা মেলে তার শীর্ষে রয়েছে মহারাষ্ট্র, দিল্লি, কর্নাটক, গুজরাট। ২০২০ সালের তথ্য অনুযায়ী, আমাদের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গের পরিযায়ী শ্রমিকদের সংখ্যা আনুমানিক ১০লক্ষ। পশ্চিমবঙ্গ থেকে অধিকাংশ পরিযায়ী শ্রমিক মুম্বাই, দিল্লি, কর্নাটক, তামিলনাড়ুতে কাজের সূত্রে যায়। বেশিরভাগ বাঙালি পরিযায়ী শ্রমিকরা সেখানে নির্মাণ কাজে, কারখানায় উৎপাদনের কাজে, স্বর্ণশিল্পে, হোটেলে, ইলেকট্রিক্যাল কাজে, কাঠমিস্ত্রির কাজেরসঙ্গে যুক্ত।

আবার অন্য রাজ্যে থেকে আসা পরিযায়ী শ্রমিকদের দেখা মেলে আমাদের রাজ্যেও, বিশেষত বিহার, ওড়িশা, ঝাড়খণ্ড থেকে বহু শ্রমিকরা কাজ করতে আসে পশ্চিমবঙ্গে। কাজের সুযোগ কম থাকা, স্থানীয় কলকারখানা না থাকা, ন্যূনতম মজুরি না পাওয়া, বিকল্প কর্মসংস্থানের অভাব প্রভৃতি কারণে  এদের অন্যত্র কাজে  যেতে হয়। নয়া দাসত্ববাদের বে-আব্রু নগ্ন চেহারা বেরিয়ে পড়েছে করোনা আতঙ্কিত ও তার পরবর্তী সময়ে পৃথিবীর সর্বত্র। ভারতে শ্রমজীবী মানুষের লাঞ্ছনার একই ছবি বিরাজমান। ভারতে কেন্দ্র সরকারের দায়িত্ব এই সমস্যার সমাধানে অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করা।

Related Articles