বিস্মৃতির অন্তরালে রয়ে যাওয়া দুই বাংলার কবি বন্দে আলী মিয়া
Two poets of Bengal who remain in oblivion are Bande Ali Mia

Truth of Bengal, রাজু পারাল: তাঁর লেখা কবিতা পড়লে মন এক অনন্ত ভালো লাগায় ভরে ওঠে। এই বঙ্গে তাঁর চর্চা বড়ই কম। খ্যাতিমান কবি হিসেবে ব্রাত্য থেকে গেছেন দিনের পর দিন। অথচ কবিতা, গান, নাটক, উপন্যাস, প্রবন্ধ, রূপকথা, জীবনী সব কিছুতেই তিনি ছিলেন অমর এক কথাসাহিত্যিক। তবুও তিনি রয়ে গেলেন বিস্মৃতির অন্তরালে। কবি ও সাহিত্যিক বন্দে আলী মিয়া জন্ম নেন বাংলাদেশের পাবনার অন্তর্গত রাধানগর গ্রামে। বাবা মুনশি উমেদ আলী ও মা নেকজান নেসা দু’জনেই ছিলেন শিক্ষানুরাগী।
বন্দে আলী মিয়া পরবর্তীকালে সাহিত্যিক হিসাবে যে উচ্চতায় পৌঁছেছিলেন , তার জন্যে তিনি মনে করতেন তাঁর মায়ের অবদান সবচেয়ে বেশি। বেড়ে ওঠার দিনগুলিতে তিনি মায়ের মুখে শুনতেন নানা গল্প ও রূপকথা’র কাহিনী। যা তাঁকে পরবর্তী জীবনের ভীত গড়তে সাহায্য করে। জীবনের প্রারম্ভে বাড়িতেই শুরু হয়েছিল তাঁর প্রাথমিক শিক্ষার হাতেখড়ি। পরে পাবনা শহরের মজুমদার একাডেমিতে ভর্তি হয়ে প্রথাগত শিক্ষা শুরু করেন।
১৯২৩ সালে এখান থেকেই মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। পরে চিত্রবিদ্যা শিক্ষার জন্য ভর্তি হন কলকাতার ইন্ডিয়ান আর্ট একাডেমিতে। এই চিত্রকলা বিদ্যাই পরবর্তীকালে তাঁকে উৎসাহিত করে বিভিন্ন গ্রন্থের প্রচ্ছদপট বানাতে। পাশাপাশি পেশাদারি ছবিও এঁকেছেন তিনি অঢেল। বন্দে আলী মিয়া তাঁর কর্মজীবন শুরু করেন কলকাতা কর্পোরেশনের স্কুলে শিক্ষকতা দিয়ে। ১৯২৫ সালে ছাত্র থাকাকালীনিই ইসলাম দর্শন পত্রিকায় সাংবাদিক হিসেবে কাজ করেন কিছুদিন।
সাহিত্য সাধনায় নিজেকে উজাড় করে দেন সে সময় থেকেই। ১৯২৭ সালে তাঁর প্রথম শিশুতোষ গ্রন্থ ‘চোর জামাই’ প্রকাশ পায়। এরপর চার বছরের মাথায় প্রকাশ পায় তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘বসন্ত জাগ্রত দ্বারে’। ১৯৩২ সালে তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘ময়নামতির চর ‘ প্রকাশ পায়। এই কাব্যগ্রন্থের সব কবিতাই পাঠকদের মুগ্ধ করেছিল। সাহিত্য আলোচকদের মনেও বিশেষ দাগ কাটে এই কাব্যগ্রন্থ। বন্দে আলী মিয়া এ সময় থেকেই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে উঠে আসেন।
‘ময়নামতির চর’ কাব্যগ্রন্থটি পড়ে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর উচ্চ প্রশংসা করেন। তখন থেকেই বন্দে আলী মিয়া লেখালেখির জীবনে ভীষণভাবে উৎসাহিত হন। নিজের জীবনকালে যে অজস্র উপন্যাস, গল্প ও কবিতা লিখেছেন তাঁর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কতকগুলি – অরণ্য গোধূলি, ঝড়ের সংকেত, নীর ভ্রষ্ট, জীবনের দিনগুলো, শেষলগ্ন ইত্যাদি। তাঁর কাব্য গ্রন্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ময়নামতির চর, অনুরাগ, পদ্মা নদীর চর, ধরিত্রী, স্বপ্নসাধে, মৃগপরী ইত্যাদি।
তবে ছোটদের জন্যেও তিনি লিখেছেন অজস্র, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য – চোর জামাই, মেঘকুমারী, হাজী মহম্মদ মহসিন, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, বিজ্ঞানচার্য জগদীশচন্দ্র বসু, ছোটদের কলম্বাস, হিটলার, শরৎচন্দ্র ,বোকা জামাই, নীল অন্ধকার, ছোটদের নজরুল প্রভৃতি গ্রন্থ। সাহিত্যিক বন্দে আলী মিয়া মনে করতেন এসব গ্রন্থ পাঠ করলে শিশুরা এবং পথভ্রষ্ট মানুষ আদর্শ মানুষ হওয়ার রসদ খুঁজে পাবে। তাঁর রূপকথার বইগুলি পাঠ করলে আমরা সমৃদ্ধ না হয়ে পারি না।
বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী বন্দে আলী সংগীত রচনাতেও ছিলেন বিশেষ পারদর্শী। তাঁর রচিত সংগীতের বইগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ‘কলগীতি ‘, সুরলীলা’ প্রভৃতি। তাঁর গানের বিষয়গুলি ছিল পল্লীগীতি, দেশের গান, হাসির গান। শিশু সাহিত্যে উল্লেখযোগ্য অবদানের জন্যে ১৯৬২ সালে তিনি পান ‘বাংলা একাডেমি’ পুরস্কার। ১৯৬৫ তিনি চাকরি করা কালীন প্রেসিডেন্সি পুরস্কার পান ।
১৯৪৭ সালের দেশভাগ কবিকে দারুন কষ্ট দেয়। সে সময়ে কলকাতা ছেড়ে তিনি চলে যান গ্রামের বাড়িতে। বাংলাদেশে ফিরে গেলেও তিনি বেকার হয়ে পরেন। সে সময়টায় তিনি বই লিখে, ছবি এঁকে জীবিকা নির্বাহ করেন। দেশভাগ কবি মেনে নিতে পারেননি। গভীর বেদনায় তাই ভেঙে পড়েন কবি। তিনি চেয়েছিলেন দুই বাংলাকে এক সূত্রে বাঁধতে।
কবি বন্দে আলী মিয়া ১৯৭৯ সালের ২৭ জুন রাজশাহীতে পরলোকগমন করেন। তাঁর মৃত্যুতে সাহিত্য জগতের অপূরণীয় ক্ষতি হয়। বলা বাহুল্য, সারা বিশ্বজুড়ে কবি বন্দে আলী যে ভাবে ছড়িয়ে পড়েছেন তাঁর লেখার গুনে তা সত্যই বড় গর্বের। কবি হিসেবে বিখ্যাত হলেও সাহিত্যের প্রায় সব শাখাতেই তিনি বিচরণ করেছেন অবাধে।