
Truth Of Bengal: আশরাফুল মণ্ডল (লেখক: প্রাবন্ধিক): গাগী কথাটা শুনে খুব অবাক হয়ে গিয়েছিল। কলেজে পড়ছে যে মেয়ে, তার এই বোধ! গাগীর খুব কাছের বন্ধু সোহিনী। অথচ সোহিনীর মুখ থেকে সেদিন ওই কথা শোনার পর সে হতভম্ব। আচ্ছা সোহিনী তো সুনামগঞ্জ শহরের বেশ শিক্ষিত অভিজাত পরিবারের মেয়ে! সে ওইরকম ধারণা লালন করে কী করে? সোহিনীর শিক্ষা ও তাদের পরিবারের সামাজিক অবস্থানের সঙ্গে সোহিনীর ওই ধারণাকে মেলাতে পারছে না গার্গী।
সেদিন কলেজে ক্লাসের ফাঁকে গার্গী, সোহিনী ও অন্যরা বকুলতলায় বসেছিল। ওদেরই ক্লাসমেট উর্মিলা সেদিন কলেজে আসেনি। উর্মিলার দাদার বিয়ে কয়েকদিন পরেই। সে গত সপ্তাহে তার ফোর্থ সেমিস্টারের পল সায়েন্স অনার্সের বন্ধুবান্ধবীদের কাছে তার দাদার বিয়ের একটা নিমন্ত্রণ পত্র দিয়ে গিয়েছে। আজ তাদের বন্ধু কুশল সেই কার্ডটি সবাইকে দেখায়। কার্ডটি হাতে নিয়ে নাকি সোহিনীর চক্ষু ছানাবড়া। সে দেখে কার্ডের প্রথমেই লেখা রয়েছে ‘এলাহি ভরসা’। সে তৎক্ষণাৎ বলে, “দু-বছর উর্মিলার সঙ্গে পড়ছি। জানতাম না ও বাঙালি নয়। উর্মিলা তাহলে মুসলমান!’
হ্যাঁ মুসলমানই তো। ওর নাম উর্মিলা খাতুন। তাতে কী? অনেকেই বলে সমস্বরে।
আরে বাবা, আমি সে জন্যে কিছু বলিনি। কোনও ধর্মীয় ঠুনকো সেন্টিমেন্ট আমার নেই। আমাদের পরিবারে ওসব কিছু ভাবা হয় না। জাস্ট আমার মনে হওয়ার কথা বললাম। বাঙালিই তো ওরা। জাতিতে মুসলমান। আমরা তো হিন্দু, তা বলে কি আমরা বাঙালি নই? সেরকম ওরা মুসলমান কিন্তু বাঙালি। বলে ওঠে গাগী।
তোকে আগে বুঝতে হবে বাঙালি কারা? শোন্ যারা বাংলার ভূখণ্ডে বাস করে, বাংলা ভাষায় কথা বলে, বাংলার পালা-পার্বণ, উৎসব, অনুষ্ঠান, ভালোমন্দ সব কিছুর সঙ্গে একাত্ম হতে পারে, বাংলার সঙ্গে যার নাড়ির টান সেই তো বাঙালি। বলে কুশল।
কথাগুলো এইভাবে খুব গুছিয়ে বলে কুশল। গার্গী ও অন্যান্যরা কুশলকে সমর্থন করে।
আসলে সোহিনীর মতো এমন কেউ কেউ আছে যাদের ধারণায় এমন ভুল আছে। গার্গী বলে- আচ্ছা দেখেছিস উর্মিলা কী অসাধারণ বাংলা কবিতা আবৃত্তি করে? রাষ্ট্রবিজ্ঞানে অনার্স নিয়ে পড়ছে, অথচ ওর প্রাণের বিষয় রবীন্দ্রনাথের কবিতা। নিজেও কবিতা লেখে।
সোহিনী সকলের উদ্দেশ্যে বলে- দেখ আমি এত কিছু ভাবিনি।
তবে মুসলমানেরাও যে বাঙালি হতে পারে তা আমি বুঝিনি। ঠিকই তো, আমার ধারণা হয়তো ভুল ছিল। তোদের কাছে শিখলাম।
কুশল বলে- ওকে ফ্রেন্ডস। চল্ এবার ওঠা যাক। ক্লাস আছে।
সেদিনকার মতো তাদের আড্ডা শেষ হয়। তারা উঠে চলে যায় জেনেরিকের ক্লাস করতে।
গার্গীর এসব ব্যাপারে কেমন যেন অবাক লাগে। গার্গীর বাবা আশুতোষ ভট্টাচার্য এই শহরে একটি উচ্চমাধ্যমিক স্কুলে শিক্ষকতা করেন। তাদের পাড়ায় অনেক মুসলিম আছে। মসজিদের কাছাকাছি গার্গীদের বাড়ি। তাদের বাড়িতে এতিম কাকা, সুবহান কাকা অনেকেই নিয়মিত আসা যাওয়া করেন। ইদে, বকরি ইদে, মহরমে বাড়ি বাড়ি তাদের নেমতন্ন থাকে। এই তো সে-বার তার বাবা বাইক অ্যাক্সিডেন্টে জখম হয়ে হসপিটালে ভর্তি ছিল, তখন বাবার কলিগরা আর পাড়ার এতিম কাকারা প্রায় সর্বক্ষণ হসপিটালে পড়েছিল।
সুবহান কাকা ওই কদিন বাড়ির হাটবাজার পর্যন্ত করে দিয়েছিল। ওদের বাড়ির মহিলারা বার বার এসে মাকে সান্ত্বনা দিয়েছিল। কয়েকবছর আগে তার অসুস্থ ঠাকুমার বিরল গ্রুপের রক্তের প্রয়োজন হয়েছিল, পাড়ার অনেকেই রক্ত দেওয়ার জন্য হসপিটালে উপস্থিত হয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত মনসুর কাকার রক্তে ঠাকুমা সুস্থ হয়েছিলেন। তার বাবাও তো হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে অনেকের বিপদে ঝাঁপিয়ে পড়েন। টোটো চালক সাদেক দাদু মারা গেলে বাবা তাঁর কাফন দাফনের খরচা দিয়েছিল। পুজোতে তাদের বাড়িতে পাড়ার প্রায় সকলেই এসে আনন্দ করে। প্রসাদ খায়। এই তো ভারতবর্ষ! ভেদ কীসের?
তবু ভেদাভেদ কি নেই? আছে। অনেক আছে। শ্রেণিবৈষম্য প্রবলভাবে আছে। তাছাড়া ধর্মের নামে অনেকে গোঁড়ামিকে লালন করে। গোঁড়ামি যে ধর্ম নয়, তা অনেকেই জানে না বা মানে না। সব থেকে অবাক লাগে যখন দেখা যায় দুই সম্প্রদায়েরই কিছু শিক্ষিত মানুষ এই ভেদাভেদে ইন্ধন দেয়। গার্গীর বাবা গার্গীকে বলেন, “শোন্ গার্গী, প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম নিজের নিজের। কিন্তু লৌকিকতায়, মনপ্রাণ খুলে একে অপরের সঙ্গে মেলামেশায় অসুবিধে কোথায়? ভারতের পবিত্র সংবিধান তো সকল ধর্মের মানুষকে নিজ নিজ ধর্মাচরণের ক্ষেত্রে কোনও অসুবিধার কথা বলেনি। হতে পারে কেউ ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাসী, আবার কেউ নাস্তিকও হতে পারে।
তাছাড়া কে নামাজ পড়বে, কে পুজো করবে, কে কী খাবে, কে কী পোশাক পরবে, তা তো একান্তভাবে কোনও মানুষের নিজের ব্যাপার। তাতে কার কী বলার আছে?”
গার্গী তার শিক্ষক বাবাকে খুব ভালোবাসে। বাবার এসব কথা সে খুব মন দিয়ে শোনে। বাবার আদর্শ তার ভালো লাগে। সে তো বাবা মায়ের কাছে মানুষ হওয়ার শিক্ষা পেয়েছে তার জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই।
গার্গীদের গ্রামের বাড়ি বাঁকুড়ার এক প্রত্যন্ত গ্রামে। তার ঠাকুরদা গ্রামের মাতব্বর গোছের মানুষ। খুব বনেদি ব্রাহ্মণ আর প্রচুর জমি জায়গা আছে। আশপাশের গ্রামের হিন্দু-মুসলমানরা তাঁকে খুব সম্মান করে। সবাই ‘ভটচাজ্ মশায়’ বলে সম্বোধন করে। এই তো গতবছর কালীপুজোয় তারা গ্রামের বাড়িতে গিয়েছিল। তাদের ঠাকুর দালানে সাড়ম্বরে কালীপুজো হল। একদিন কাঙালি ভোজন, আর একদিন গ্রামের হিন্দু-মুসলমান আনন্দ ভোজে মেতে ওঠে।
গ্রামের মানুষেরা ভেদাভেদের ঊর্ধ্বে উঠে এক পঙ্ক্তিতে ভোজন করে। খাওয়া দাওয়ার পর বেশ কয়েকজন মুসলমান পাড়ার মানুষ আশুতোষ অর্থাৎ গাগীর বাবার সঙ্গে গল্প করছিল। সেইসময় একজন মধ্যবয়সি লোককে দেখতে পেয়ে আশুতোষ বলেন, “কী রে হানিফ, কেমন আছিস?”
ভালো নাই আশুদাদা। বউটো ত আগের বছর জ্বরে ভুগে মরে গেইছে। ঘরে দুটো বিটি বিয়ের লায়েক হয়ে রইচে। আমার মা বিছেনে পড়ে আছে। হাগা মুতা বিছেনেই করে। আমার তেমন কুনু রুজকার নাই। ওই বিগে দুয়েক জমি চষি। তাও লুকের হাল-লাঙ্গল মেগে যেচে। রাতে দুশ্চিন্তায় নিদোতে লারচি। ঘরগুষ্টি নিয়ে মেহনত করে সুংসার চালাব না মায়ের স্যাবা করব, অখে খাওয়াবা জিনিসপত্তরের দাম যা চড়চড় করে পিতিদিন বাড়ছে, কী করে কিনব? লুকের ঘরে মুনিষ খেটে এতগুনো প্যাট ভরানা যায়?
কী বলবে আশুতোষ! সত্যিই তো জিনিসপত্রের দাম আগুন। চাকুরিজীবীরা সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছে। আর গরিব মানুষদের অবস্থা তো খুব শোচনীয়।
আশুতোষ স্নেহমিশ্রিত গলায় বলেন, “হানিফ, বেশি চিন্তা করিস না, দেখিস সব ঠিক হয়ে যাবে। দুঃসময় দীর্ঘস্থায়ী হয় না। তোরা তো আমাদের আপনজন রে। এই পাঁচশ টাকা রাখ।”
না আশুদাদা। টাকা লিবো নাই। এই শালার পুড়া প্যাট যতুই দাও ক্যানে, ভরবেক নাই। দিন এমনি করেই চলে যাবেক। তুমাদের মেহেরবানিত্যাই ত বেঁচে রইচি। মুখে বললে, ইয়াই অন্যাক। তুমার বাবা ভটচাইখুড়ো আমাদের বাপের পারা। বিপদে সাহস দেয়। অভাবে পড়লে উয়ার কাছে টাকা ধার লি। টাকা শুধু করতে দেরি হলেও কিছু বলে না। তাইলে বলো তুমাদের থিকে আপন কেউ রইচে?
আশুতোষ জানে হানিফের মতো লোকদের বিষয় সম্পত্তি না থাকতে পারে, কিন্তু আত্মমর্যাদা আছে। এরা ভিক্ষা নিতে নারাজ। তাই আশুতোষ তাকে অর্থদান করা থেকে নিরস্ত হয়। আশুতোষ তাকে বলে, “আগামীকাল সকালে সুনামগঞ্জে ফিরতে হবে। কিছু দিন পর আবার আসব, দেখা করিস।”
ই দাদা, তুমি আইচ শুনলেই আইব। তুমাদের মতন লুক ইগাঁয়ে আর নাই। হিন্দু-মুসলমান সব কেমন হয়ে গেইচে। কেউ কারুর ভালো দেখতে লারে। সুদুই হিংসা। অ্যাগে সবারি সাথে সবারি কত ভাব ভালোবাসা ছিল।
হ্যাঁ রে, সেসব দিন কী আর আছে। এখন দিনকাল খুব খারাপ।
এমন শালার দিন আইচে, কী বলব দাদা! হিদুরা বলচে মুসলমান আমাদের দুষমন আর মুসলমান বলচে হিদু আমাদের দুষমন। উ শালারা জাত জাত করে মরবেক। জাতটো ধুয়ে ধুয়ে কী পানি খাবো!
আর অ্যাকটো কথা শুনো দাদা, আমার য্যা ভাইপোটো, অই য্যা উসমানের ছুটো ব্যাটা ফজিলত, যিটো কলেজে পড়ে। উত খ্যাপার মতন হিয়ে গেইছিল। কলেজে উয়ার বন্ধুদের কাছে নাকি শুনেছিল মুসলমানদের এই দ্যাশ থিকে তাড়িন দিয়া হবেক। আর যাই কুথা। কী ভয় উয়ার! ক্যা অখে বুঝোবেক দ্যাশ থিকে কাউকে তাড়ানা কী সুজা! কিন্তু উ বুজবেক নাই। ভয়ে না খিয়ে না নিদিনে শরীলটো শুকনো কাঠ হিয়ে গেইছিল।
গার্গী বাবার কাছে বসে শোনে এসব কথা। তার কেবলই মনে হয়, এরাই তো তাদের আপনজন! তার ঠাকুরদাকে এরাই ঘিরে থাকে। ঠাকুরদার কিছু হলে এরাই তাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবে। এরাই তো একান্ত কাছের মানুষ!
গার্গী বাবার কাছে শুনেছে শহরেও বস্তিবাসী মানুষদের ঘৃণা করে অনেকে। টাকা থাকলেই সমাজে সে গণ্যমান্য, আর টাকা না থাকলে সে ছোটলোক। কত শিক্ষিত যুবক-যুবতি চারদিকে! তাদের অনেকেই বহু চেষ্টা করেও চাকরি পায়নি। সে দোষ কি তাদের? এমনকি তারা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই প্রতারিত। গার্গী জানে এখনও সমাজে উঁচু জাত নীচু জাত- এই ভেদাভেদ ভয়ঙ্করভাবে রয়েছে। সবাই তো মানুষ! তবে কেন এই বিদ্বেষ? মানুষে মানুষে ঘৃণা ছড়ানো! এই ভূখণ্ডে সবাই তো বাঙালি! শত অভাবেও বাঙালির রঙ্গ-রসিকতা, খাদ্যলোলুপতা, আড্ডায় মশগুল হওয়া, আবার পরনিন্দা-পরচর্চা সবই তো বর্তমান।
ধর্মের ভেদে বাঙালি আলাদা কীসে?
ক্রমে বিকেল গড়িয়ে পশ্চিম আকাশটা লাল হয়ে ওঠে। দিনের সব দহন-পুড়ন শেষে সভ্যতার সব লজ্জা নিয়ে আজকের মতো সূর্য অস্ত যাবে। সেদিকে গার্গী অপলকে থাকিয়ে থাকে।