
অমিত লাহা: বর্ষাকাল এলেই গ্রামবাংলার মানুষ সাপের আতঙ্কে কার্যত কাঁটা হয়ে থাকে। প্রতিবছর বর্ষাকালে বাংলার গ্রামে-গঞ্জে, বিশেষ করে সুন্দরবন সংলগ্ন গ্রামগুলিতে সাপের উপদ্রপ মারাত্মক ভাবে বেড়ে যায়। এবং এই অঞ্চলের বহু মানুষ প্রতিবছর সাপের কামড়ে প্রাণ হারায়। এখনও কিছু মানুষ আছে, যারা সাপে কাটা ব্যক্তিকে স্থানীয় হাসপাতাল অথবা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যাওয়ার পরিবর্তে ওঝা, গুনিনের ওপরেই বেশি নির্ভর করে। আবার অনেক সময় গ্রামীণ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে সাপে কাটা রোগীকে নিয়ে গিয়ে দেখা গেছে সেখানে অ্যান্টিভেনম সিরাম নেই।
এরপর রোগীকে শহরের হাসপাতালে আনতে যে সময় নষ্ট হয়, ততক্ষণে বেশিরভাগ রোগীই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। তবে এবার সাপের কামড়ের আতঙ্ক থেকে মুক্তি পাওয়ার সময় বোধহয় এসে গেছে। সাপের বিষের প্রভাবে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচাতে বিজ্ঞানীরা তৈরি করে ফেলেছেন একটি ট্যাবলেট যার নাম ‘ভ্যারেসপ্ল্যাডিব মিথাইল’। কলকাতার ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজে এই ট্যাবলেটের ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালও হয়েছে।
ইতিমধ্যে এই ট্যাবলেটের ফেজ ওয়ান ও ফেজ টু ট্রায়াল শেষ হয়েছে ইউরোপের দেশগুলিতে। ট্রায়াল শেষে এর ৮০ শতাংশ কার্যকারিতা প্রমাণিত হয়েছে। ভারতে ১১২ জনের ওপর এবং পশ্চিমবঙ্গে একমাত্র কলকাতার ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ২৫ জন সাপে কাটা রোগীর ওপর এই ট্যাবলেটের পরীক্ষামূলক ভাবে প্রয়োগ করা হবে। ভবিষ্যতে যদি এই ট্যাবলেট সাপে কাটা রোগীর চিকিৎসার ক্ষেত্রে কার্যকরী বলে প্রমাণিত হয়, তা হলে তা চিকিৎসা বিজ্ঞানের এক যুগান্তকারী আবিষ্কার হিসেবে গণ্য করা হবে।
আমাদের দেশে এই ট্যাবলেট বহু মানুষকে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরিয়ে আনবে। ই-লাইফ নামে একটি জার্নালে প্রকাশিত একটি গবেষণাপত্রে ভারতীয় ও আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞরা দাবি করেছেন, ২০০০ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত গত ২৪ বছরে ভারতে ১২ লক্ষ মানুষ মারা গিয়েছে সাপের কামড়ে। ভারতে সাপের কামড়ে প্রতিবছর মৃত্যু হয় গড়ে ৫৮ হাজার মানুষের। এর মধ্যে ৫০ শতাংশের বয়স ৩০ থেকে ৬৯-এর মধ্যে।
আমাদের দেশে বেশিরভাগ মানুষ মারা যায় কোবরা গ্রুপের গোখরো, কেউটে, কালাচ প্রভৃতি সাপের কামড়ে। ভারতে জুন থেকে সেপ্টেম্বর এই ৪ মাসের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সাপের কামড়ে মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রকের দেশব্যাপী সমীক্ষা ন্যাশনাল হেলথ প্রোফাইল-এ প্রকাশিত হয়েছে ২০১৭ সালে পশ্চিমবঙ্গে সাপের কামড়ে মৃত্যু হয়েছিল ২৩৫ জনের। এমন অবস্থায় সাপের কামড়ের চিকিৎসায় এই ট্যাবলেট একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ বলে মনে করছে বিশেষজ্ঞ মহল।
তবে এমনটা ভাবা ভুল হবে যে, সাপে কামড়ানোর চিকিৎসায় অ্যান্টিভেনম সিরামের প্রয়োজন ফুরোতে চলেছে। চিকিৎসক মহলের মতে, আমাদের রাজ্যে বর্তমানে অ্যান্টিভেনম সিরাম উৎপাদন বন্ধ আছে। এখন অ্যান্টিভেনম সিরাম দক্ষিণ ভারতের রাজ্যগুলি থেকে আমদানি করতে হয়। আর এখানেই তৈরি হয়েছে এক নতুন সমস্যা। দক্ষিণ ভারতের সাপের বিষের প্রোটিন আর পূর্ব ভারতের সাপের বিষের প্রোটিন সম্পূর্ণ আলাদা।
তাই আমাদের রাজ্যের সাপে কাটা ব্যক্তির উপর দক্ষিণ ভারতে তৈরি অ্যান্টিভেনম সিরাম সহজে কাজ করছে না। তাই এবার চিকিৎসকরা অ্যান্টিভেনম সিরামের সঙ্গে ভ্যারেসপ্লাডিব মিথাইল ট্যাবলেটও রোগীর উপর প্রয়োগ করার কথা ভাবছেন। এই ট্যাবলেটে রয়েছে মেটাজিনসিন গ্রুপের মেটালোপ্রোটিনেজ ইনহিবিটর যা সাপের বিষে থাকা মেটালোপ্রোটিনেজ এনজাইমকে শরীরে কাজ করতে দেয় না। ফলে মানব দেহে সাপের বিষের তীব্রতা হ্রাস পেতে শুরু করে। এবং রোগীর মৃত্যুর আশঙ্কাও কমে। তাই আশা করা যায়, খুব শীঘ্রই এই ট্যাবলেট সাপে কাটার চিকিৎসার প্রোটোকলে যুক্ত হবে এবং বাণিজ্যিক ভাবে এর উৎপাদনও শুরু হবে।