‘একলা’ বৈশাখ আর পঁচিশে বৈশাখ দুটি ইভেন্ট হয়ে গিয়েছে!
There have been two events, 'Ekla' Baishakh and Panishe Baishakh!

Truth Of Bengal: জয়ন্ত চক্রবর্তী: দোহাই, এই প্রজন্মের কেউ আমাকে ভুল বুঝবেন না। কাউকে আঘাত দেওয়াটা এই কলমচির উদ্দেশ্য নয়। এই প্রজন্মের ছেলে-মেয়েদের আমি শ্রদ্ধা করি। তাদের সব বিষয়ে আগ্রহের আমি তারিফ করি। শুধু বাস্তব ছবিটি তুলে ধরার জন্যই এই প্রতিবেদন। হলফ করে বলুন তো—‘একলা’ বৈশাখ আর পঁচিশে বৈশাখ দিন দুটি কি ইভেন্টে পর্যবসিত হয়ে যায়নি?
পয়লা বৈশাখ ফি বছর ঘুরে ফিরে আসে। পয়লা বৈশাখ যেদিন থেকে ‘একলা’ বৈশাখ হয়ে গেছে সেদিন থেকে বাঙালির বর্ষবরণের দিনটি কেমন যেন ইভেন্ট ইভেন্ট হয়ে গেছে। আগে বাবার হাত ধরে পয়লা বৈশাখে হালখাতা পালনের দিন গিয়েছে। বাঙালির ঘরে সেদিন ভাল মন্দ দুটি পদের রান্নার দিন গিয়েছে। পয়লা বৈশাখ নতুন ধোপদুরস্ত জামা-কাপড় পরার দিন গিয়েছে। আজকের প্রজন্মের কাছে পয়লা বৈশাখ একটা ইভেন্টের দিন।
সেদিন আমাজন কিংবা ফ্লিপকার্ট কত ডিসকাউন্ট দিচ্ছে, বাঙালি তরুণ-তরুণী তাই নিয়ে যতটা ব্যাস্ত থাকে ততটা কি থাকে বছরের প্রথম দিনটি উদযাপনে? নিউ ইয়ার্স ইভ কিংবা ইংরেজি নতুন বছর পালনে আমরা যতটা নিজেদের নিয়োজিত করি ততটা করি কি বাংলা নতুন বছর উদযাপনে? একবার এক তরুণ বন্ধু প্রশ্ন তুলেছিলেন– কেন বাংলা নতুন বছরের প্রথম দিনটি পয়লা বলে পরিচিত হবে, কেন ‘একলা’ বৈশাখ বলা হবে না? তরুণ বন্ধুটি বোধহয় ঠিকই বলেছিলেন– পয়লা বৈশাখ বড় একা হয়ে গেছে!
ওই দিনটিকে একলা বৈশাখ নামে ডাকাই সঙ্গত। আজ মা-ঠাকুমার মোচার ঘণ্ট আর পোস্তর বড়ার সন্ধানে আমরা রেস্তোরাঁয় ছুটি। ফি বছর পয়লা বৈশাখ উপলক্ষে রেস্তোরাঁগুলিতে বাঙালি রান্নার উৎসব শুরু হয়ে যায়। বাঙালি এই দিনটির জন্য অপেক্ষা করে থাকে– ইটিং আউটে যেতে হবে না! পাড়ায় পাড়ায় আজও নববর্ষ উদযাপনের অনুষ্ঠান হয়, কিন্তু সেখানে পাড়ার ছেলের দেবতার গ্রাসের থেকে বেপাড়ার কণ্ঠীদের ভিড় বেশি। আগে পয়লা বৈশাখ এর দিন পাড়ার যে ছেলেটি প্রথম বিয়ারে হাতেখড়ি হতো সেই ছেলে আজ এসপ্ল্যানেডে কোনও পানশালায় বসে বাঙালি নববর্ষ উদযাপন করছে– চিয়ার্স বলে পানীয়র পাত্র মুখে তুলে।
বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে তো হ্যাপি আওয়ার্স-এর ব্যবস্থা করেছে পানশালা। আজ বাঙালির নিউ ইয়ার। তাই একটা কিনলে তো আর একটা ফ্রি! আগেকার দিনে একটা কথা প্রায় প্রবীণরা বলতেন, বছরের প্রথম দিনটা যেমন যাবে তেমনই নাকি যাবে বছরের বাকি দিনগুলো। আজকের দিনে কেউ কি আর তোয়াক্কা করে প্রবীণদের সেই আপ্তবাক্যের? বছরের প্রথম দিন বেপথু হতে তাই মানা নেই।
খাও পিও অউর মস্তি করো– বাঙালির নতুন বছরের সিগনেচার বোধহয় এটাই। ঠিক একই ভাবে পঁচিশ বৈশাখ একটি ইভেন্ট হয়ে দাঁড়িয়েছে। রবি ঠাকুরের জন্মদিন বলে দিনটির আর আলাদা অস্তিত্ব নেই। বলা হয়ে থাকে যে রবি ঠাকুরের রচনা সামগ্রী পড়লে নাকি জীবন দর্শনের পাঠ নেওয়া হয়ে যায়। কিন্তু আজকের তরুণ-তরুণী সিডনি শেলডন কিংবা হারোল্ড রবিনস পড়ে যে সুখ পান তার ছিটেফোঁটাও জোটে না রবি ঠাকুরের রচনায়। তাই এই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মদিনও ইভেন্ট ছাড়া আলাদা কোনও মাত্রা বহন করে না আজকের প্রজন্মের কাছে।
পাড়ায় পাড়ায় নাছোড় কিছু লোকের চেষ্টায় আজও রবীন্দ্র জয়ন্তী হয়। পঁচিশে বৈশাখ দিল ডাক… এখনও রিচুয়ালি আউড়ে যায় মানুষ জন। কিন্তু সবটাই কেমন যেন যান্ত্রিক। পঁচিশে বৈশাখ রাজ্য সরকারের ছুটি থাকে। যে কোনও ছুটির দিন বাঙালি যেমন কাটায় সেদিনও তাই। মাংসের দোকানে লম্বা লাইন পড়ে।
দুপুরে ভাল-মন্দ খেয়ে বাঙালি এদিন বউ নিয়ে ‘বই’ দেখতে যায়। রবি ঠাকুরের জন্মদিন বলে দিনটাকে রাবীন্দ্রিক করতে হবে এমন কথা বলছি না। কিন্তু, এই দিনটি আর পাঁচটি ইভেন্টের দিনের মত তো নাও হতে পারত! আসলে আমরা বাঙালিরা ইভেন্টের জাঁতাকলে পড়ে গেছি। এর থেকে বোধহয় মুক্তি নেই!