
ডক্টর সুজীব কর (ভূবিজ্ঞানী): ভারতবর্ষ ক্রান্তীয় মৌসুমি জলবায়ুর দেশ। কিন্তু বর্তমানে ভারতের জলবায়ুতে মৌসুমি বায়ু অত্যন্ত অনিয়মিত, যে কারণে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে জলবায়ুগত বৈশিষ্ট্যগুলি অত্যন্ত দ্রুত গতিতে পরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছে। স্বাভাবিকভাবে যে কারণে জলবায়ুর প্রকৃতি এবং তার পূর্বাভাস দেওয়া অত্যন্ত কঠিন একটি বিষয়ে পরিণত হচ্ছে। এর কারণ স্বরূপ বলা যেতে পারে, বিগত বেশ কিছু বছর ধরে সমগ্র পৃথিবীর জলবায়ুগত পরিমণ্ডল অত্যন্ত দ্রুতগতিতে পরিবর্তিত হচ্ছে। বিশ্ব উষ্ণায়ন এবং জলবায়ুগত পরিমণ্ডলের পরিবর্তনের ফলে বাস্তবিক ক্ষেত্রে অধিকাংশ সময়ে ভারতের জলবায়ুতে যে মৌসুমি ছন্দ ছিল তা বাস্তবিক ক্ষেত্রে বর্তমানে অদৃশ্য হতে বসেছে। তাই মৌসুমি অত্যন্ত অনিয়মিত এবং মৌসুমি দুর্দশায় ভারতবর্ষ জর্জরিত।
তা ছাড়া অপর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, ভারতবর্ষে মৌসুমি বায়ু আসার ক্ষেত্রে উত্তর-পশ্চিম ভারতে অবস্থিত থর মরুভূমিতে নিম্নচাপ সৃষ্টি হওয়া অত্যন্ত প্রয়োজনীয় একটি বিষয়। কিন্তু বিগত বেশ কিছু বছর ধরে মরু অঞ্চলে ক্রমান্বয়ে সবুজায়নের ফলে এই নিম্নচাপ বাস্তবিক ক্ষেত্রে সক্রিয় হতে পারছে না। যে কারণের জন্য নিম্নচাপের অবস্থান স্থানান্তরিত হয়ে যাচ্ছে মধ্য ভারতের মূলত মধ্যপ্রদেশ এবং ছত্রিশগড়ের প্রান্ত বিশেষে। তাই স্বাভাবিকভাবে যখন মৌসুমি বায়ুর আগমন ঘটার কথা তখন মধ্য ভারতে অবস্থিত নিম্নচাপ সেই বায়ুকে আকর্ষণ করে নিচ্ছে। বঙ্গোপসাগরের উপর থেকে যে কারণেই জলীয় বাষ্পপূর্ণ বায়ু সমগ্র মধ্য ভারত এবং দক্ষিণ ভারতের ওপর অতিরিক্ত মাত্রায় সক্রিয় হয়ে পড়ছে। কিন্তু উত্তর-পশ্চিম ভারতে নিম্নচাপ তৈরি না হওয়ায় স্বাভাবিকভাবে পাঞ্জাব, হরিয়ানা, উত্তর প্রদেশ, বিহার, ঝাড়খন্ড এবং দক্ষিণবঙ্গের বিস্তীর্ণ পরিসর স্থানে মৌসুমি বায়ু কোনভাবেও তার প্রভাব বিস্তার করতে পারছে না। তাই এই অঞ্চল তীব্র খরার কবলে চলে যাচ্ছে দীর্ঘদিন ধরে।
এই কারণে উত্তর ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে কৃষিকাজ ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এবং শুধুমাত্র ধানের চাষ নয়, তার সঙ্গে সঙ্গে অন্যান্য যে সমস্ত ফসলগুলি এই অঞ্চলে উৎপাদিত হয় তা সবই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই ভারতবর্ষের অর্থনীতির ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড়সড় বিপর্যয় নেমে আসতে পারে। এখন স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে যে, উত্তর ভারতের ক্ষেত্রে এই ধরনের পরিস্থিতি তৈরি হল কেন? এর উত্তরে বলা যেতে পারে, ১৯৮৩ সালে ভারতবর্ষের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন যে রাজস্থানে সবুজায়ন ঘটানো হবে। বাস্তবিক ক্ষেত্রে এই সিদ্ধান্ত যে কত বড় ভুল ছিল তা আজকে আমরা সুস্পষ্ট ভাবে বুঝতে পারছি।
যে দেশের জলবায়ুতে মৌসুম বায়ুই প্রধান প্রাণস্বরূপ সেই দেশে মৌসুমি বায়ু বর্তমানে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। শুধুমাত্র এই বায়ুকে টেনে জলভাগ থেকে ভূমিভাগে তুলে নেওয়ার মতো কোনও শক্তি বর্তমান ভারতীয় উপমহাদেশে তৈরি হতে পারছে না। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, রাজস্থানের বৃক্ষরোপণ রাজস্থানের জলবায়ুকে যেমন পরিবর্তন করেছে তেমনই রাজস্থানের কৃষিজ ফসলের উৎপাদনের মাত্রাকে উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি করেছে। কিন্তু এর ফলে ধীরে ধীরে উত্তর ভারতের প্রধান প্রধান রাজ্যগুলি বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই অবস্থা প্রকট থেকে প্রকটতর হয়ে যাচ্ছে। সুতরাং, অদূর ভবিষ্যতে সমগ্র উত্তর ভারতের মৌসুমি বায়ু পুরোপুরিভাবে নিম্নচাপের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতে শুরু করবে এবং আমাদের বর্ষাকালে বৃষ্টিপাত পাওয়ার জন্যে বঙ্গোপসাগরে সৃষ্টি হওয়া নিম্নচাপের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। নতুবা কোনও ভাবেও জলীয়বাষ্প বঙ্গোপসাগর থেকে উত্তর ও উত্তর-পূর্ব ভারতের দিকে প্রবেশ করতে পারবে না।
দীর্ঘ প্রায় ১২ বছর পরে এই বছর মৌসুমি বায়ু এল নিনো এবং লা নিনার প্রভাবমুক্ত। প্রশান্ত মহাসাগরের উপর লা নিনা খানিকটা স্থিতাবস্থায় অবস্থান করছে। অপরদিকে এল নিনো সক্রিয় অবস্থায় নেই। যে কারণে মৌসুমি বায়ুর আগমন এবং মৌসুমি বায়ুর প্রভাব ভারতবর্ষের ওপর সঠিকভাবে পড়ার কথা এবং স্বাভাবিকভাবে পর্যালোচনায় বলা যায়, মোট বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ১২০ থেকে ১২৫ শতাংশের কাছাকাছি সম্পন্ন হতে পারে। কিন্তু এ তো গেল সমগ্র ভারতবর্ষের চিত্র, কিন্তু যদি আমরা উত্তর ভারত এবং দক্ষিণবঙ্গের কথা ভাবি। তা হলে দেখা যাবে আমাদের ওপর মৌসুমির প্রভাব সেই অর্থে যথেষ্ট ক্ষীণ হয়ে পড়বে। তার কারণ যেহেতু উত্তর-পশ্চিম ভারতে নিম্নচাপ সক্রিয় হতে পারছে না সেই কারণের জন্য মৌসুমি বায়ুকে টেনে উত্তর ভারতে নিয়ে আসার মতো ক্ষমতা স্থানীয় বিচ্ছিন্ন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নিম্নচাপ কক্ষের নেই।
যে কারণে মৌসুমি বায়ু আমাদের দক্ষিণবঙ্গের ক্ষেত্রে এবং সমগ্র উত্তর ভারতে সক্রিয়তা সেই অর্থে লাভ করতে পারবে না। যার ফলে উত্তর ভারতে মৌসুমি বায়ু সামগ্রিকভাবে নিয়ন্ত্রিত হবে নিম্নচাপের দ্বারা। তাই যখন নিম্নচাপ সক্রিয় হবে তখন স্বাভাবিক অবস্থার থেকে তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি বৃষ্টিপাত সংঘটিত হবে এর ফলে উত্তর ভারতের বিস্তীর্ণ পরিসর স্থানে বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে। দক্ষিণবঙ্গও এই একইভাবে বন্যার দ্বারা প্রভাবিত হবে। অপরদিকে যেহেতু মধ্য ভারতে নিম্নচাপ অত্যন্ত সক্রিয় অবস্থায় রয়েছে তাই বঙ্গোপসাগর থেকে জলীয়বাষ্পপূর্ণ বায়ুকে মধ্য ভারতে অবস্থিত নিম্নচাপ আকর্ষণ করে তুলে নেবে তার ফলের সমগ্র মধ্যভারত এবং দক্ষিণ ভারতে অতিরিক্ত পরিমাণে বৃষ্টিপাত সংঘটিত হবে এবং অধিকাংশ স্থানই বন্যার কবলে চলে আসবে। অর্থাৎ এল নিনো এবং লা নিনার প্রভাব না থাকলেও ভারতবর্ষে কিন্তু মৌসুমি বায়ু তার স্বমহিমায় বিকশিত হতে পারবে না। অর্থাৎ, আমরা ভারতবাসীরা মৌসুমি দুর্দশার হাত থেকে রক্ষে পাবে না।
বিশ্বের জলবায়ুগত পরিবর্তন এবং বিশ্ব উষ্ণায়ন ধীর পদবীক্ষণে সমগ্র পৃথিবীর জলবায়ুগত পরিমণ্ডলকে বিপর্যস্ত করে ফেলছে এবং অস্বাভাবিকতা বর্তমানে জলবায়ুর একটি স্বাভাবিক অবস্থায় পরিণত হয়েছে। যদিও ভারতবর্ষের ক্ষেত্রে রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ এই জলবায়ুর উপর তুলনামূলকভাবে বেশি, তথাপি বলা যেতে পারে আজ বিশ্বের অধিকাংশ মরু অঞ্চল গুলি ধীরে ধীরে সবুজে পরিপূর্ণ হয়ে উঠছে। কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে এই মরু অঞ্চলগুলি জলবায়ুগত ভারসাম্যকে বজায় রাখে। তাই যেহেতু মরুভূমি হারিয়ে যাচ্ছে তাই স্বাভাবিকভাবে বায়ুর চাপ নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা কোন ভূখণ্ডে আর থাকছে না, যে কারণে জন্য এলোমেলো পরিস্থিতি। এছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল জল চক্রের অত্যন্ত দ্রুত গতিতে পরিবর্তন, যা ইতিমধ্যেই ঘটে গেছে। সুতরাং, এখন আমরা জলচক্রকে আর নতুন করে থামিয়ে ফেলার মতো অবস্থায় নেই।
আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারতাম ভূমিভাগের পরিমণ্ডলকে বা পরিস্থিতিকে যদি আমরা আরো অনেক আগে থেকে ভাবতাম, বর্তমানে কিন্তু ‘গোবি মরুভূমিতে গাছ হচ্ছে’ বা ‘সাহারা মরুভূমিতে গাছ হচ্ছে’ বর্তমানে এক বিশেষ বিশাল খবর, কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে একটি প্রাণীর শরীরে হৃদপিণ্ড যেমন তার সমগ্র শরীরের চাপকে নিয়ন্ত্রণ করে ঠিক একইভাবে মরুভূমিও সমগ্র ভূখণ্ডের বায়ুর চাপকে নিয়ন্ত্রণ করে। কিন্তু সেই মরুভূমি যদি সবুজ হয়ে পড়ে তা হলে স্বাভাবিকভাবে সেখানে কোনও নিম্নচাপ তৈরি হতে পারে না এবং তার প্রভাবে বায়ু প্রবাহের যে স্বাভাবিক পথ তা এলোমেলো হয়ে পড়ে এবং তার প্রভাবে জলবায়ুগত বিপর্যয় এত দ্রুতগতিতে শক্তভাবে তার থাবা বসিয়ে দিতে পারে মনুষ্য কার্যকলাপের উপরে। আজকে আমরা ঠিক এই অবস্থার দ্বারাই প্রভাবিত।
অর্থাৎ, জলবায়ু পরিবর্তনের করাল গ্রাসে আমরা ইতিমধ্যেই প্রবেশ করে গেছি এই অবস্থায় পৃথিবী আমাদের ওপর প্রতিশোধ নিচ্ছে এটা ভাবার কোনও কারণ নেই। পৃথিবী এবং তার সমস্ত উপকরণ প্রত্যেকে আমাদের ঘনিষ্ঠ বন্ধু কিন্তু দীর্ঘদিন যাবত আমাদের কাজের ফলে পৃথিবীর ওপর যে আবর্জনার বোঝা চেপেছে, যে বিষ বাষ্পে পৃথিবী জর্জরিত হয়ে পড়েছে সেখান থেকে পৃথিবী পুনরায় আবার নিজেকে ঠিক করে ফেলার চেষ্টা করছে। সেই চেষ্টার পদ্ধতিগত রূপ হলো সাইক্লোন, ভূমিকম্প, খরা, বন্যা প্রভৃতি এবং এগুলির মধ্যে দিয়েই পৃথিবী পুনরায় তার নিজস্ব ছন্দে ফিরে আসবে। তবে এই বাস্তুতন্ত্রের অস্তিত্ব পৃথিবী থেকে বিলীন হয়ে যাবে, আবার নতুন করে বাস্তুতন্ত্র তৈরি হবে এবং পৃথিবীতে নতুন প্রাণের সঞ্চার ঘটবে এই বিষয়টি শুধুমাত্র সময়ের অপেক্ষা মাত্র।