মেলার আক্ষরিক অর্থ মিলন,মেলায় একে অন্যের সঙ্গে ভাব বিনিময় হয়
The literal meaning of Mela is meeting, and at the fair, people exchange ideas with each other

Truth of Bengal, মনীষা কর বাগচী: মেলা হল যখন একটি সামাজিক, ধর্মীয়, বাণিজ্যিক বা অন্যান্য কারণে একটি স্থানে অনেক মানুষ একত্রিত হয়। মেলা শব্দটি শোনার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের মনে আনন্দের অনুভূতি হয়। মেলার আক্ষরিক অর্থ মিলন। মেলায় একে অন্যের সঙ্গে ভাব বিনিময় হয়। বহু বছর ধরে প্রবাসী। বাংলার জল আবহাওয়া থেকে বহু দূরে কেটে গেল অনেক বছর। আর বাংলার বাইরে থাকতে থাকতে জীবন থেকে যেন ভুলতে বসেছিলাম ছোটবেলার সেই গ্রামীণ মেলা বা হাট। কয়েকদিনের জন্য এলাম বাংলায়। নিজের চেনা জায়গায়। নিজের সংস্কৃতির অঙ্গনে।
আর এসেই সুস্বাদ পেয়ে গেলাম আপন সংস্কৃতিকে। শীতের মিঠে কড়া রোদ্দুর গায়ে মাখিয়ে চলে গিয়েছিলাম মেলা দেখতে। নদিয়া জেলার মাঝেরগ্রামের পূর্বশিমুলিয়া পাড়ায় এই মেলা। এই মেলা কত বছর ধরে চলছে কেউ সঠিক বলতে পারে না। বর্ষীয়ান নাগরিকরা বললেন ছোট থেকেই তারা এই মেলা দেখে আসছেন। কেউ বলেন ১০০ বছর ধরে চলছে কেউ বলেন আরও বেশি। কেউ কেউ বলেন কয়েক যুগের।
নাজিম ফকিরের মেলা নামে মেলাটি পরিচিত। মেলাটি প্রতিবছর অঘ্রাহায়ন মাসের ৭ তারিখে শুরু হয়। সাতদিন ধরে মেলা চলে। কিন্তু সাত দিনেই শেষ হয় না, ভাঙা মেলা চলে আরও বেশ কিছুদিন। আমি এখানে থাকি না তাই মেলাতে আসার সৌভাগ্য খুব কমই হয়। এবার ভাগ্যক্রমে এখানেই ছিলাম তাই মেলা দেখার সুযোগ পেলাম। এখানে দূর দুরান্ত থেকে বিক্রেতারা আসেন। ক্রেতাও আসছে আশে পাশের সকল গ্রাম থেকে।
কলকাতা শহরের লোকজন আসছেন এখানে। এই মেলার প্রথম আকর্ষণ গ্রামীণ ঐতিহ্যবাহী মাটির হাড়ি পাতিল। বাঁশের আসবাবপত্র দেখে অবাক না হয়ে পারা যায় না। মোট কথা যত এগোবেন ততো অবাক হবেন। কি নেই? খাট, ড্রেসিং টেবিল থেকে শুরু করে ছোট বাচ্চাদের খেলনা পর্যন্ত। খাবারের দোকান যে কতো আছে গুনে শেষ করতে পারব না তাই গুনিনি। আমার মেয়ে জিলাপি খেয়ে বলছে মা এমন টেস্টি জিলাপি এর আগে খাইনি কখনও।
লোহার দোকানে গেলে সংসারে লোহার যা কিছু লাগবে সব পেয়ে যাবেন। একজন কৃষকের কৃষি কাজের জন্য যা কিছু প্রয়োজন সবই এখানে পাওয়া যায়। হরেক মাল দশ টাকা, সেই দোকান গুলোতে গেলে মনে হয় সবই কিনে নিয়ে যায়। জুয়েলারি দোকানে যা দেখি সেটাই কিনতে ইচ্ছে করে। সব থেকে বড় কথা এখানে সমস্ত জিনিস অনেক কম দামে পাওয়া যায়। আমরা মার্কেট থেকে যে জিনিসটি ৫০ টাকা দিয়ে কিনে আনি এখানে তার দাম ৩০ টাকার বেশি নয়।
বাংলার সংস্কৃতিকে ধরে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা দেখলাম মেলা কমিটির সদস্যদের মধ্যে। প্রতিদিন এখানে সুন্দর সুন্দর অনুষ্ঠান হচ্ছে। কখনো বাউল গান, কখনো পুতুল নাচ , কখনো গাজী গান, কখনো কালচারাল প্রোগ্রাম। নাগর দোলা, মিক্কিমাউজ, রেল গাড়ি বাচ্চাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছে। তাদের খুশির আর ঠিকানা নেই যেন। ছোট ছোট থালা বাসন দেখে আমার মেয়েও লোভ সামলাতে পারলনা। কিনেই ফেলল।
বললাম কি করবি এসব দিয়ে? বলল সোকেসে সাজিয়ে রাখব মা। মেলার সঙ্গে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর কৃষ্টি ও সংস্কৃতির যোগাযোগ নিবিড় । বাংলার এই সংস্কৃতিতে থাকে সব ধর্মের মানুষের সংস্কৃতির সমন্বয় । কয়েকটি গ্রামের মিলিত এলাকায় বা কোন খোলা মাঠে আয়োজন করা হয় মেলার। মেলাকে ঘিরে গ্রামীণ জীবনে আসে প্রাণচাঞ্চল্য। গ্রামের মেলায় যাত্রা, পুতুল নাচ, নাগরদোলা, জারি-সারি, রামায়ণ, গম্ভীরা কীর্তন, পালার আসর, ষাঁড়ের লড়াই, মোরগের লড়াই, লাঠি খেলা, হাডুডু খেলা মুগ্ধ করে আগত দর্শনার্থীদের। এখনও নাগরদোলা সব বয়সীদের কাছে প্রধান আকর্ষণ।
মেলায় আবার বিভিন্ন নাটক বা যাত্রাপালারও আয়োজন করা হয়। কবিগুরু যথার্থই বলেছেন। উপলক্ষ যাই হোক না কেন, বাঙালির সকল উৎসবের মধ্যে একটা সার্বজনীন রূপ আছে। এতে ধর্ম, সম্প্রদায়, জাত-পাত বা ধনী-গরিবের সামাজিক বিভক্তি বাধা হয়ে দাঁড়ায় না বরং সকল শ্রেণির মধ্যে সেতুবন্ধন রচিত হয়। আর এ কারণেই কালের বিবর্তনের সঙ্গে আনুষ্ঠানিকতার ধরন পাল্টালেও আবহমান বাংলার সামাজিক উৎসব, পার্বণ বা গণমানুষের মেলবন্ধনের ঐতিহ্য-কৃষ্টিগুলো আজও হারিয়ে যায়নি।
মেলা মানেই মহামিলন। মানুষের উচ্ছ্বাস-উল্লাসের বহিঃপ্রকাশ ঘটে মেলার মধ্য দিয়ে। ধর্ম-বর্ণ-সম্প্রদায়ের উর্ধে উঠে মেলা মানুষের মধ্যে সম্প্রীতির বন্ধন গড়ে দেয়। গ্রাম-বাংলার মেলা তাই হাজার বছরের ঐতিহ্যের এক মহা সম্মিলন আঞ্চলিকভাবে বিখ্যাত বিভিন্ন গ্রামীণ মেলার সঙ্গে স্থানীয় মানুষের সম্পর্ক শুধু উৎসবকেন্দ্রিক নয়। শুধু শখের পণ্য কিনতে মেলায় যায় না, গ্রামবাসী মেলা থেকে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদিও সংগ্রহ করে।
শখের বশে মুড়ি, বিন্নি খই, চিনির তৈরি সাজ বা বাচ্চার জন্য খেলনা কিনলেও অনেক গ্রামের মানুষ সারা বছরের ভোগ্যপণ্য যেমন খাবার মসলা, রান্নার তৈজসপত্রসহ নানা পণ্য মেলা থেকে সংগ্রহ করে। সাম্প্রতিক দশকে গ্রামীণ বা মফস্বলের মেলায় আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে। মেলায় পণ্যের ধরন থেকে শুরু করে বিক্রেতা, বিক্রির ধরন পর্যন্ত অনেক বিষয়েরই পরিবর্তন ঘটছে।
ভাববার সময় এসেছে সনাতনী পেশায় নিয়োজিত এসব জনমানুষ কীভাবে আধুনিকতার সঙ্গে নিজেদের অভিযোজিত করছে। মেলায় দর্শকদের তাৎক্ষণিক মনোরঞ্জনের জন্যও থাকে নানান আয়োজন। নাগরদোলা, লাঠি খেলা, কুস্তিখেলা, পুতুল নাচ, যাত্রাগান, কবিগান, বাউল গান, ঘেটু গান, জারি গান, গাজীর গান, পীর-ফকিরদের গান, বায়স্কোপ, সং, সার্কাস, লটারি, কীর্ত্তন, নৌকা বাইচ, ষাঁড়ের লড়াই প্রভৃতি আয়োজন দর্শকদের বাড়তি আনন্দের খোরাক যোগায়। অষ্টমী, বারুনী বা বিভিন্ন পূণ্যস্থানের মেলাকে বাংলার মানুষ ধর্মীয় উৎসব বলেই মনে করে।
মূলত এসব লোকজ মেলাকে লক্ষ্য করেই দেশীয় সার্কাস ও যাত্রা শিল্পী গোষ্ঠীর বিকাশ ঘটেছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য মেলার নামে অনেক জায়গায় জুয়া-হাউজি-অশ্লীল নৃত্যসহ কিছু অপ-সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড হয়। এগুলো মেলার মূল সংস্কৃতি নয়। মূলত এর পেছনে থাকে অর্থলিপ্সা। মেলায় হাজারো মানুষের স্রোত পূঁজি করে এক শ্রেণির লোক এ ধরনের বেআইনি উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার চেষ্টা করে। এতে মেলার পরিবেশ শ্রীহীন হয়। তবে সর্বসাধারণ কখনও এ বিষয়গুলোকে মেলার আঙ্গিক হিসাবে মনে করেন না। তারা মেলাকে ধর্মীয় উৎসব, লোকাচার, আনন্দ-বিনোদন বা বছরের কোনো একটি বিশেষ দিন হিসেবেই বিবেচনা করে।