সম্পাদকীয়

স্যাপিওসেক্সুয়াল: যৌনতায় যেখানে বুদ্ধিমত্তা প্রথম ও শেষ কথা

Sapiosexual: In sex where intelligence is the first and last word

Truth Of Bengal: সত্যগোপাল দে: উইকিপিডিয়া অনু্যায়ী মানুষের জীবনে যৌনতা হল মানুষের কামোদ্দীপক অভিজ্ঞতা এবং সাড়া প্রদানের ক্ষমতা। কোনও ব্যক্তির যৌন অভিমুখতা অন্য ব্যক্তির প্রতি তার যৌন আগ্রহ ও আকর্ষণকে প্রভাবিত করতে পারে। বিভিন্ন পন্থায় যৌনতা প্রকাশ বা উপভোগ করা যায়। মানুষের যৌন আকর্ষণের কারণ ও ধরন বহু বৈচিত্র্যময়।

শারীরিক সৌন্দর্য, ব্যবহার, সামাজিক অবস্থান— সব কিছুই কারও প্রতি আকৃষ্ট হওয়ার পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তবে কিছু মানুষ প্রধানত বুদ্ধিমত্তাকে যৌন আকর্ষণ এবং অন্যান্য আকর্ষণের প্রধান মানদণ্ড হিসেবে দেখে। এই প্রবণতাকে বলা হয় ‘স্যাপিওসেক্সুয়ালিটি’। এই প্রবন্ধে স্যাপিওসেক্সুয়ালদের বৈশিষ্ট্য, কারণ, মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ এবং সমাজে এর প্রভাব নিয়ে আলোচনা করার চেষ্টা করছি।

আমরা স্বাধারবত প্রেম বলতে যা বুঝি তা নয় অর্থাৎ রূপ কিংবা গুণ কিংবা ক্যারিয়ার কিংবা অর্থ-বিত্ত কিংবা সামাজিক স্ট্যাটাস, কিন্তু এখানে রসায়নটা অন্যরকম! ব্যক্তির বাইরের রূপ না বরং বুদ্ধিমত্তার প্রেমে পড়ে যায়। অদ্ভুত শোনালেও এটাই আসল কথা, স্যাপিওসেক্সুয়ালিটি এমন একটা গভীর অনুভূতি যেখানে মানুষ প্রেমে পড়ে মেধা, বুদ্ধিদীপ্ততা, নৈতিকতা, সামাজিকতা, প্রজ্ঞা, রুচি, বিবেক, বোধশক্তি কিংবা পড়াশুনোর গভীরতা দেখে।

যারা স্যাপিওসেক্সুয়াল তাদের প্রেম ও যৌনতার অনুভূতি আবর্তিত হয় মস্তিষ্ককে ঘিরে। চেহারার কিছু ভূমিকা অবশ্য থাকে, কিন্তু তা নেহাতই সাময়িক। শারীরিক সৌন্দর্য বা সামাজিক অবস্থানের চেয়ে তাঁদের কাছে অনেক বড় হয়ে দাঁড়ায় বিপরীত মানুষটির বুদ্ধিমত্তা।

স্যাপিওসেক্সুয়ালিটির সংজ্ঞা ও বৈশিষ্ট্য আলোচনা করলে জানা যাবে, স্যাপিওসেক্সুয়াল শব্দটি এসেছে ল্যাটিন শব্দ ‘sapiens’ যার অর্থ জ্ঞানী বা বুদ্ধিমান এবং ‘sexual’ যা যৌন আকর্ষণের সাথে সম্পর্কিত। এটি এমন একটি প্রবণতা যেখানে একজন ব্যক্তি মূলত অন্যের বুদ্ধিমত্তা দ্বারা যৌনভাবে আকৃষ্ট হন। শারীরিক সৌন্দর্য, বিষয় আশয় এখানে গৌণ বিষয় বরং তীক্ষ্ণ যুক্তিবোধ, সৃজনশীল চিন্তা, জ্ঞান অর্জনের ইচ্ছা এবং গভীর আলোচনার ক্ষমতা প্রধান যৌন আকর্ষণীয় গুণ হিসেবে বিবেচিত হয় সঙ্গী কিংবা সঙ্গিনীর কাছে।

স্যাপিওসেক্সুয়াল ব্যক্তিদের মধ্যে কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্য দেখা যায়, যে কোনও বিষয়ে তারা গভীর আলোচনায় আগ্রহ প্রকাশ করে, তারা বুদ্ধিদীপ্ত আলোচনা, সাহিত্য, বিজ্ঞান, দর্শন এবং নতুন বিষয় শেখার প্রতি আকৃষ্ট হন এবং এদের যৌনতা বুদ্ধিকে ঘিরে আবর্তিত হয়।  তার যুক্তিবাদী মনোভাবসম্পন্ন, সহজে তর্কে জড়িয়ে পড়তে পছন্দ করেন এবং জীবন সঙ্গীর সঙ্গে সুসংগঠিত চিন্তাভাবনা তাদের যৌন আকর্ষণ বাড়ায়।

অতিরিক্ত চিৎকার করে, মেজাজ দেখিয়ে যাঁরা নিজেদের মত প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেন, তাঁরা স্যাপিওদের নেক নজরে পড়েন। বোকামিও তাদের নপছন্দ। যাঁরা নিজেদের অনুভূতিকে যুক্তির সাহায্যে ব্যাখ্যা করতে পারেন, যাঁরা চট করে মেজাজ হারান না, জটিল পরিস্থিতিকেও শান্তভাবে সমাধান করার চেষ্টা করেন, সেরকম সঙ্গী পছন্দ করেন যারা স্যাপিওসেক্সুয়াল।

শুধু বাহ্যিক শারীরিক সৌন্দর্যে তারা আগ্রহী নন, সাধারণত তারা বাহ্যিক আকর্ষণের চেয়ে মনের সৌন্দর্য এবং চিন্তাধারার গভীরতাকে বেশি গুরুত্ব দেন। তারা প্রতিনিয়ত নতুন জ্ঞান অর্জনের তীব্র ইচ্ছা প্রকাশ করে থাকেন, জ্ঞানের প্রতি আগ্রহী ব্যক্তিদের প্রতি তারা সহজেই যৌনভাবে আকৃষ্ট হন। কিন্ত কেন কেউ কেউ স্যাপিওসেক্সুয়াল হয়? মানব মনের যৌন আকর্ষণের ধরন বিভিন্ন কারণের ওপর নির্ভরশীল। স্যাপিওসেক্সুয়ালিটির পেছনে কয়েকটি মনস্তাত্ত্বিক ও সামাজিক কারণ থাকতে পারে।

শিক্ষা ও পরিবেশ উচ্চশিক্ষিত বা জ্ঞানপিপাসু পরিবেশে বেড়ে ওঠা ব্যক্তিরা সাধারণত বুদ্ধিমত্তাকে বেশি মূল্য দেন এবং এটি তাদের যৌন আকর্ষণের প্রধান ভিত্তি হয়ে ওঠে। ব্যক্তিত্বের গঠন, ইন্টেলেকচুয়াল কৌতূহল ও চিন্তার গভীরতা এদের স্বভাবগত বৈশিষ্ট্য হতে পারে। সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রভাব, আধুনিক সমাজে বুদ্ধিবৃত্তিক ব্যক্তিদের উচ্চ মর্যাদা দেওয়া হয়, যা এই যৌন আকর্ষণকে উৎসাহিত করতে পারে। আত্মবিশ্বাস ও মানসিক সংযোগের অংশ হিসেবে বুদ্ধিমান ব্যক্তি সাধারণত আত্মবিশ্বাসী হন এবং মানসিক সংযোগ গড়ে তুলতে পারদর্শী হন, যা স্যাপিওসেক্সুয়ালদের কাছে অত্যন্ত যৌন আকর্ষণীয়।

বিপরীত লিঙ্গ ও সমলিঙ্গের প্রতি যৌন আকর্ষণ এবং যৌনতা উভয় ধরনের মানুষ হতে পারে। স্যাপিওসেক্সুয়ালিটি শুধুমাত্র বিপরীত লিঙ্গের প্রতি যৌন আকর্ষণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। এটি যে কোনও লিঙ্গের মানুষের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হতে পারে। একজন স্যাপিওসেক্সুয়াল ব্যক্তি পুরুষ, নারী বা তৃতীয় লিঙ্গের কারও প্রতি যৌনভাবে আকৃষ্ট হতে পারেন, যদি সেই ব্যক্তি বুদ্ধিমত্তা ও চিন্তার গভীরতায় সমৃদ্ধ হন।

যৌনতার ক্ষেত্রে, স্যাপিওসেক্সুয়াল ব্যক্তিরা শারীরিক আকর্ষণের চেয়ে মানসিক সংযোগকে বেশি প্রাধান্য দেন একথা আগেই বলা হয়েছে। এটি তাদের যৌন আকর্ষণের অভিজ্ঞতাকে অন্যদের তুলনায় ভিন্নতর করে তোলে। তাদের জন্য বুদ্ধিবৃত্তিক সংলাপই সবচেয়ে বড় যৌন উত্তেজনা এবং উদ্দীপনার  কারণ হতে পারে। তাই তারা সাধারণত এমন ব্যক্তিদের খোঁজ করেন যাদের সঙ্গে গভীর আলোচনা সম্ভব।

স্যাপিওসেক্সুয়ালিটির কিছু ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত আছে, ফরাসি দার্শনিক জাঁ-পল সার্ত্র এবং সিমোন দ্য বোভোয়ার— তাদের সম্পর্ক ছিল মূলত বুদ্ধিবৃত্তিক সংযোগের ওপর ভিত্তি করে। তারা একে অপরের দর্শন ও চিন্তাধারায় যৌন আকর্ষণ অনুভব করতেন। বিখ্যাত বিজ্ঞানী মারি কুরি ও পিয়েরে কুরি— তাদের সম্পর্কের মূল ভিত্তি ছিল বিজ্ঞান ও গবেষণার প্রতি পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও ভালবাসা, যা তাদের যৌন আকর্ষণকেও গভীর করেছিল।

কিছু সাহিত্য ও সিনেমায় উদাহরণ আমাদের চোখের সামনে আছে, জনপ্রিয় টিভি সিরিজ ‘Sherlock’-এ শার্লক হোমস ও আইরিন অ্যাডলার— আইরিন কেবলমাত্র শার্লকের প্রতিভা ও বুদ্ধিমত্তার জন্যই তার প্রতি যৌন আকর্ষণ অনুভব করেছিলেন। Good Will Hunting মুভিতে স্কাইলার ও উইল— স্কাইলার উইলের অসাধারণ বুদ্ধিমত্তা ও গণিতের প্রতি তার দৃষ্টিভঙ্গির কারণে যৌনভাবে আকৃষ্ট হন। স্বর্ণকেশী সৌন্দর্যের রানি মেরিলিন মনরো। মনোগ্রাহী হাসি, সুমিষ্ট কণ্ঠ আর তীক্ষ্ণ চাহনিতে তিনি ঝড় তুলেছিলেন, তাই তো মনরোর অকালমৃত্যু, যেটিকে অনেকে আত্মহত্যা হিসেবে চিহ্নিত করে থাকেন, মানুষের মনে ফেলেছিল ব্যাপক প্রভাব।

দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস এক প্রতিবেদন বলছে, মনরোর মৃত্যুর এক সপ্তাহ পর নিউ ইয়র্ক শহরে আত্মহত্যার সংখ্যা পূর্বের সকল রেকর্ডকে ছাপিয়ে গিয়েছিল। একই দিনে আত্মহত্যা করেছিল বারো জন, যাদের মধ্যে একজন তো সরাসরিই সুইসাইড নোটে লিখে গিয়েছিলেন, ‘যদি জগতের সবচেয়ে চমৎকার, সুন্দর সৃষ্টিটিই বেঁচে থাকার কোনও কারণ খুঁজে না পায়, তা হলে আমিই বা কীভাবে পাই!’

অর্থাৎ বেশিরভাগ মানুষ মনরোর বাহ্যিক রূপটাই দেখেছে, সেই রূপে হয়েছে মোহাবিষ্ট। তবে আজ আমরা মনরোর রূপ-সৌন্দর্য নিয়ে কথা বলব না, কেন না সেটি ইতিমধ্যেই প্রতিষ্ঠিত সত্য। বরং আমরা কথা বলব তার ব্যক্তিত্বের এমন কিছু দিক নিয়ে, যেগুলি অনেকেরই অজানা। চলচ্চিত্র জগতের অনেকেই আড়ালে মনরোকে ডাকত ‘ডাম্ব ব্লন্ড’ হিসেবে। তার চেহারাটাই কেবল সুন্দর, মাথায় কিছু নেই, এমনটিই ছিল তাদের ধারণা। সুতরাং, তাকে এমন একজন ব্যক্তি হিসেবে কল্পনা করা কঠিনই বৈকি, যে বিভোর হয়ে বইয়ের পাতায় ডুবে আছে, পাতার পর পাতা পড়ে চলেছে অপরিসীম বিস্ময়ে।

কিন্তু বিস্ময়কর হলেও সত্য, মনরো প্রকৃতপক্ষেই ছিলেন এমন একজন ব্যক্তি। তার ছিল ব্যক্তিগত বইয়ের মোটামুটি সমৃদ্ধ একটি সংগ্রহ, যেখানে ছিল প্রায় সাড়ে চারশোটি বই। প্রায় প্রতিটি বই-ই অরিজিনাল কপি, এবং বইগুলোর পাতায় পাতায় ছিল তার স্বহস্তে রচিত চিরকুট। মনরোর ভাললাগা কিংবা আকর্ষণ শুধু পুঁথিগত জ্ঞানেই সীমাবদ্ধ ছিল না। বরং তিনি সহজেই আকৃষ্ট হতেন জ্ঞানী ব্যক্তিদের প্রতিও। তাই অনেকে তাকে চিহ্নিত করে থাকে স্যাপিওসেক্সুয়াল হিসেবেও, অর্থাৎ যাদের মস্তিষ্কে প্রেম ও যৌনতার অনুভূতি আবর্তিত হয় বুদ্ধিমত্তাকে কেন্দ্র করে।

মনরোর ক্ষেত্রে এ ধারণা অনেকাংশেই সত্য, তার প্রমাণ পাওয়া যায় তার তৃতীয় স্বামী আর্থার মিলারকে দেখে। মিলার ছিলেন তৎকালীন সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের শ্রেষ্ঠ নাট্যকার। অনুমান করা যায়, মিলারের বুদ্ধিবৃত্তিরই প্রেমে পড়েছিলেন তিনি। স্যাপিওসেক্সুয়ালদের একে অপরের সম্পর্কে অনেক চ্যালেঞ্জ বিদ্যমান, স্যাপিওসেক্সুয়াল ব্যক্তিদের জন্য সম্পর্ক গড়ে তোলা এবং টিকিয়ে রাখা অনেক সময় সমস্যা জর্জরিত হতে পারে। কারণ তাদের সীমিত পছন্দ, তারা সাধারণত খুব কমসংখ্যক ব্যক্তির প্রতি আকৃষ্ট হন, যারা তাদের মানদণ্ড পূরণ করতে পারেন তাদের প্রতিই তারা আকর্ষিত।

বুদ্ধিবৃত্তিক প্রতিযোগিতা সম্পর্কের মধ্যে কখনও কখনও প্রতিযোগিতা সৃষ্টি হতে পারে, যা দ্বন্দ্বের কারণ হতে পারে। অন্যদের ভুল বোঝাবুঝি  অনেক সময় সমাজ তাদের পছন্দকে ভুলভাবে ব্যাখ্যা করতে পারে, বিশেষ করে যদি কেউ কেবলমাত্র জ্ঞানী ব্যক্তিদের প্রতি আকৃষ্ট হন।

স্যাপিওসেক্সুয়ালিটি এক অনন্য যৌন আকর্ষণের ধরন, যেখানে শারীরিক আকর্ষন থাকলেও বুদ্ধিমত্তা প্রধান ভূমিকা পালন করে, শরীর গৌণ। এটি কেবল শিক্ষাগত যোগ্যতার ভিত্তিতে নয়, বরং চিন্তাভাবনার গভীরতা, যৌক্তিক বিশ্লেষণ এবং মানসিক সংযোগের ওপর নির্ভরশীল। সমাজের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এই প্রবণতা আরও জনপ্রিয় হয়ে উঠছে, এবং এটি আমাদের সম্পর্কের ধরন ও যৌন আকর্ষণের সংজ্ঞাকে নতুন মাত্রা দিচ্ছে।

Related Articles