দলের জন্য দলের সঙ্গে মতান্তরে আলাদা রেজ্জাক
Rezzak separates from party due to differences of opinion

Truth Of Bengal: বিকাশ ঘোষ: ‘হেলে ধরতে পারে না কেউটে ধরতে এসেছে’ – এ ধরনের উক্তি সম্ভবত রাজনীতির অঙ্গণে আর কেউ কোনওদিন বলবেন না। রাজনীতির ময়দানে অনেক বিতর্ক হবে, অনেক বিতর্কিত মন্তব্য সোরগোল তুলবে, রেজ্জাক সাহেব যে বিতর্ক সৃষ্টি করেছিলেন তা অক্ষত থেকে যাবে। নিজের দলের সরকার তখন রাইটার্সে। মধ্য গগনে তখন বামফ্রন্টের দম্ভ ও অহমিকা।
সেই সরকারের মুখ্যমন্ত্রী, শিল্পমন্ত্রীকে নিয়ে এমন বিতর্কিত মন্তব্য একমাত্র তিনিই করতে পেরেছিলেন। কথায় কথায় বলতেন, ‘আমি চাষার ব্যাটা।’ গলায় গামছা ঝুলিয়ে মেঠো মাটির গন্ধে মাখা পোশাক পড়ে গটগট পায়ে এগিয়ে আসতেন আলিমুদ্দিন স্ট্রিটে। সিঙ্গুর ও নন্দীগ্রাম ইস্যুতে তখন রাজ্য রাজনীতি সরগম। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আন্দোলনে অনেকটাই কোণঠাসা বামফ্রন্ট সরকার।
বামফ্রন্টের অভ্যন্তরেও সরকারের জমিনীতি নিয়ে নানান প্রশ্ন সামনে উঠে আসছে। বিশেষ করে তিন ফসলি জমি শিল্পের জন্য দিয়ে দেওয়ায় তখন ফুঁসছেন কৃষকরা। ফুঁসছেন বামফ্রন্টের অভ্যন্তরে অনেক নেতাও। তবে দলের কঠোর বিধি নিষেধের কারণে মুখ খুলতে পারছিলেন না অনেকেই।
সেই সময় আলিমুদ্দিন স্ট্রিটে সংবাদ সংগ্রহের জন্য নিয়মিত যেতে হতো। বিশেষ করে দলের সম্পাদকমণ্ডলীর বৈঠকের দিন সকাল সকাল পৌঁছে যেতাম আলিমুদ্দিনের সদর দরজায়। এক এক করে দলের নেতারা দলের সদর দফতরে আসতেন। বৈঠকে যোগ দিতেন, বৈঠক শেষ করে এক এক করে বেরোতেন।
বৈঠকের ভিতরকার অনেক সূত্র অনেক সময় বেরিয়ে আসতো কথা বলতে বলতে। আর এই সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম পর্বে রাখঢাক রাখতেন না ‘চাষার ব্যাটা’ রেজ্জাক মোল্লা। দিনের ব্রেকিং নিউজটা বেরিয়ে আসতো রেজ্জাকসাহেবের সঙ্গে কথা বললেই। দলের শিল্পনীতির যে তিনি কট্টর বিরোধী তা গোপন রাখেননি তিনি। তৎকালীন বাম সরকারের মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য এবং শিল্পমন্ত্রী নিরুপম সেনকে তুলোধনা করতে ছাড়তেন না তিনি।
সরাসরি সংবাদ মাধ্যমের সামনে নিজের ক্ষোভ উগড়ে দিয়েছেন বহুবার। স্পষ্টবাদী নেতা হিসাবে পরিচিতি ছিল রেজ্জাকসাহেবের। বহুবার তাঁর মুখোমুখি হয়েছি। কখনও আলিমুদ্দিন স্ট্রিটে বা কখনও তাঁর হাউসিং-এ। গোপন রাখেনি তাঁর ক্ষোভের কথা। তিনি যে ‘চাষার ব্যাটা’ কৃষক স্বার্থে নিজের অবস্থান নিয়ে বারবার বুঝিয়ে দিয়েছেন।
আর এই প্রশ্নে আপোষ করেননি কারও সঙ্গে। নিজের দলের মুখ্যমন্ত্রী সঙ্গেও নয়। তখন রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ দফতরের মন্ত্রী তিনি। তোয়াক্কা করেননি পদের। দল যা খুশি শাস্তি দেয় দিক, নিজের অবস্থান থেকে এক ইঞ্চি সরেননি। তাই তাঁকে দলের বিরাগভাজন হতে হয়েছিল। সিপিএম থেকে বহিষ্কৃত হতে হয়েছিল রেজ্জাক মোল্লাকে।
আব্দুর রেজ্জাক মোল্লা বামফ্রন্ট শাসনে রাজ্যের ভূমি ও ভূমি সংস্কার দফতরের মন্ত্রী ছিলেন। প্রথম সারির একজন বামপন্থী নেতা হিসাবে রাজ্যে সুপরিচিত ছিলেন তিনি। ১৯৭২ সালে ভাঙড় বিধানসভা থেকে সিপিএমের টিকিটে জিতে প্রথমবার বিধায়ক হন রেজ্জাক মোল্লা।
১৯৭৭ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত একটানা ক্যানিং পূর্ব বিধানসভা আসন থেকে নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি। ২০১১ সালে রাজ্যে পালাবদল ঘটে। সিপিএমের ডাকসাইটে একাধিক নেতা পরাজিত হন। সেই বছরের লড়াইয়েও আব্দুর রেজ্জাক মোল্লা নিজের নির্বাচনী কেন্দ্র ধরে রেখেছিলেন। বিগত ৩৪ বছরের বামফ্রন্ট সরকারের পরাজয় ঘটলেও নিজের জনপ্রিয়তা জোরে জয়লাভ করেছিলেন ক্যানিং পূর্ব বিধানসভা কেন্দ্র থেকে।
১৯৭৭ সালে ক্যানিং পূর্ব বিধানসভা থেকে জিতে রাজ্যের মন্ত্রী হন। বাম আমলে মন্ত্রী হিসাবে ভূমি সংস্কার, সুন্দরবন উন্নয়নের মতো গুরুত্বপূর্ণ দফতরের দায়িত্ব সামলেছেন দীর্ঘদিন। ২০১৪ সালে দলবিরোধী কথা বলার কারণে তাঁকে বহিষ্কার করে সিপিএম। এরপর ২০১৬ সালে যোগ দেন তৃণমূলে। বিধানসভা নির্বাচনে ভাঙড় থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। সেবার ভোটে জয়ীও হন রেজ্জাক মোল্লা। তৃণমূলের শাসনকালে খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ দফতরের মন্ত্রীও ছিলেন তিনি।
অসুস্থ হওয়ার পর থেকে দক্ষিণ ২৪ পরগনার ভাঙড়ের বাঁকড়ি গ্রামে নিজের বাড়িতে থাকতেন তিনি। শুক্রবার সকালে প্রাতঃরাশ সেরে ওঠার পর কাশতে শুরু করেন। তারপর সবশেষ। হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয় তাঁর। পরিবার পরিজনের চোখের সামনেই মৃত্যু হয় তাঁর। তাঁর পিতার নাম করিম বক্স মোল্লা।
শিক্ষা জীবন থেকেই বামপন্থী আন্দোনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েন রেজ্জাক। প্রথম থেকেই এলাকার মানুষের কথা তুলে ধরেন। বিশেষ করে চাষিদের কথা। খেত মজুরদের কথা। নিজেও মাঠে গিয়ে চাষ করেছেন। ফলে চাষিদের দুঃখ-যন্ত্রণা খুব কাছ থেকে দেখেছেন। রাজ্যে মন্ত্রী হওয়ার পরেও তিনি তার পুরনো জীবনের কথা ভুলে যাননি। ভুলে যাননি চাষিদের কথা। গলায় গামছা নিয়ে চলে আসতেন বিধানসভায় বা আলিমুদ্দিনে। মন্ত্রী হওয়ার পরেও।
নিজেকে ‘চাষার ব্যাটা’ বলতেই বেশি পছন্দ করতেন। তাঁর সঙ্গে যখনই কথা হতো সহজ-সরল জীবনের কথা তুলে ধরতেন। মানুষের কথা বলতেন। রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে সাধারণের কথা বলতেন। দলের কঠোর বিধি-নিষেধকে তোয়াক্কা করতেন না। রেজ্জাক মোল্লা বলতেন, দল কীসের জন্য যদি মানুষের উপকারই না হল। জোর করে জমি দখল নিয়ে তাই সোচ্চার ছিলেন তিনি।
কৃষকদের মতের বিরুদ্ধে গিয়ে শিল্প স্থাপনের জন্য টাটাদের জমি দেওয়াকে তাই মেনে নেননি তিনি। একান্ত কথাবার্তায় তিনি বলতেন, শিল্পের জন্য তিন ফসলি জমি দেওয়া দলের সামনে বিপদ ডেকে আনবে। ২০১১ সালের চরম বিপর্যয় আগেই আঁচ করেছিলেন রেজ্জাক মোল্লা। তাঁর সেই আশঙ্কা সত্যি হয়। বামেদের ৩৪ বছরের শাসনের অবসান ঘটে রাজ্য।