কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ: চেনা মানুষের অচেনা কথা
Poet Rabindranath Tagore: Unknown words of known people

রাজু পারাল:
‘আমি পৃথিবীর কবি, যেথা তার যত ওঠে ধবনি/
আমার বাঁশির সুরে সাড়া তার জাগিবে
তখনি…’
প্রকৃতই তিনি পৃথিবীর কবি। তাঁর কাব্যবীণায় বিশ্বের শ্রুত-অশ্রুত সঙ্গীত ধ্বনিত হয়েছে। তাই বিশ্ববাসী কবিকে ‘বিশ্বকবি’ আখ্যায় ভূষিত করেছে।
মহাত্মা গান্ধী তাঁকে ‘গুরুদেব’ বলতেন। ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দের জুন মাসে ইংরেজ সরকার কবিকে ‘স্যর’ উপাধিতে ভূষিত করেন। এই মহাকবির অসামান্য প্রতিভা সকল দেশের, সকল কালের মানুষের কাছে এক পরম বিস্ময়।
জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি ছিল উনিশ শতকের নবজাগরণের প্রাণকেন্দ্র। রূপকথার মায়াপুরীর মতো রহস্যঘেরা এই বাড়িটি বহুদিন ধরেই সমস্ত বাঙালির কৌতূহলের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে আছে। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের পঞ্চম পুত্র জ্যোতিরিন্দ্রনাথের সাহচার্যে এবং পরিবারিক সদস্যদের সহায়তায় এক অসাধারণ সাংস্কৃতিক পরিবেশে রবীন্দ্রনাথের প্রতিভার বিকাশ হয়েছিল খুব সহজেই। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ কবিকে বহুমুখী প্রতিভাধর হতে ও নিজের কর্মকাণ্ডে অংশীদার হতে যথেষ্ট সাহায্য করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ সে কথা একাধিকবার স্বীকার করেছেন। ‘জীবন স্মৃতি’ রচনায় তার উল্লেখ করে কবি বলেছেন, ‘সাহিত্যের শিক্ষায়, ভাবের চর্চায়, বাল্যকাল হইতে জ্যোতিদাদা আমার প্রধান সহায় ছিলেন। তিনি নিজে উৎসাহী এবং অন্যকে উৎসাহ দিতে তাঁহার আনন্দ। আমি অবাধে তাঁহার সঙ্গে ভাবের ও জ্ঞানের আলোচনায় প্রবৃত্ত হইতাম– তিনি বালক বলিয়া আমাকে অবজ্ঞা করিতেন না। তিনি আমাকে খুব একটা বড় রকমের স্বাধীনতা দিয়াছিলেন; তাঁহার সংস্রবে আমার ভিতরকার সংকোচ ঘুচিয়া গিয়েছিল। এই রূপ স্বাধীনতা আমাকে আর কেহ দিতে সাহস করিতে পারিত না— সে জন্য হয়তো কেহ কেহ তাঁহাকে নিন্দাও করিয়াছে।– সে সময়ে এই বন্ধনমুক্তি না ঘটিলে চিরজীবন একটা পঙ্গুতা থাকিয়া যাইত।’
তবে রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য সৃষ্টির সমঝদার এবং উৎসাহদাতা ছিলেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথের স্ত্রী কাদম্বরী দেবী। রবীন্দ্রনাথের লেখার পাঠিকা তিনিই। যথার্থই তিনি সাহিত্য মনপ্রাণ দিয়ে উপভোগ করার চেষ্টা করতেন। কাদম্বরী দেবী কবিকে এমন ভাবে প্রশংসা করতেন না যাতে কবির মনে অহংকারের বীজ অঙ্কুরিত হয়।
জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির ছোট ছেলেটি একদিন বঙ্গসাহিত্যে নতুন জোয়ার এনেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যসাধনা চলেছিল সারাটা জীবনই। ক্ষণকালের জন্যও তা থেমে থাকেনি। আশি বছরের জীবনকালে পঁয়ষট্টি বছর লিখে গেছেন নিরলস ভাবে। তাঁর লেখার কল্পনাশক্তি ও ভাবময়তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল মনন শীলতা। রবীন্দ্রনাথের লেখা অনবদ্য দুটি গ্রন্থ– ‘ছেলেবেলা’ ও ‘জীবনস্মৃতি’। এ ছাড়াও কবিতা, গল্প, উপন্যাস ও নাটক রচনায় তিনি অসামান্য মৌলিকতা দেখিয়েছিলেন। রবীন্দ্র প্রতিভা বাংলা সাহিত্যের যে সকল দিক স্পর্শ করেছে ‘নাটক’ ও ‘উপন্যাস’ তার মধ্যে উল্লেখযোগ্যের দাবি রাখে। প্রবন্ধ ও বাংলা ছোট গল্পের যথার্থ রূপটিও গড়ে উঠেছিল তাঁরই হাতে।
বাংলা উপন্যাসের ক্ষেত্রে তিনি প্রবর্তন করেছিলেন নতুন এক ধারার। মাত্র ষোলো বছর বয়সে তাঁর লেখা প্রথম উপন্যাস ‘করুণা’ ভারতী পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। তাঁর অন্যান্য উল্লেখযোগ্য উপন্যাসগুলি হল– বৌ ঠাকুরানীর হাট, চোখের বালি, নৌকাডুবি, গোরা, ঘরে বাইরে, যোগাযোগ, চার অধ্যায়, চতুরঙ্গ, শেষের কবিতা ইত্যাদি। পরিণত জীবনে তিনি চিত্রশিল্পেও মনোযোগী হয়েছিলেন। নিয়মমাফিক শিক্ষা না থাকলেও সত্তর বছর বয়স থেকে তিনি ছবি আঁকা শুরু করেন। কালি-কলম ও প্রাকৃতিক রঙের ব্যবহারে তিনি প্রায় আড়াই হাজার ছবি এঁকেছিলেন।
সংগীতের প্রতিও রবীন্দ্রনাথের আকর্ষণ ছিল আশৈশব। তিনি অজস্র গান রচনা করেছেন, সুর দিয়েছেন, অনেক সময় স্বকণ্ঠে গেয়ে শুনিয়েছেন সেই সব গান। তাঁর গানের কথা যেমন কাব্যগুণে সমৃদ্ধ, সুরও তেমনি আকর্ষণীয়।
সৃজনকর্মে সদামগ্ন এই মানুষটি কেবল সাহিত্য শিল্পের নন্দনকাননে নিজেকে ধরে রাখেননি। প্রথম জীবন থেকেই তিনি স্বদেশ ও সমাজের ভাবনাতেও ব্যাকুল ছিলেন। পদ্মা তীরবর্তী অঞ্চলে তিনি যখন জমিদারির কাজকর্ম দেখাশোনা করতেন তখন প্রজাদের দুর্দশামোচনের উপায় খুঁজেছেন পরম আন্তরিকতার সঙ্গে। প্রত্যক্ষভাবে স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে যুক্ত না থাকলেও পরাধীন ভারতবর্ষ সম্পর্কে তিনি বিন্দুমাত্র উদাসীন ছিলেন না। গানে-প্রবন্ধে এবং অন্যান্য রচনাতে তিনি সেই মনোভাবই ব্যক্ত করেছেন। তাঁর রচনা স্বাধীনতা সংগ্রামে বিশেষ অনুপ্রেরণা রূপে কাজ করেছিল। ১৯০৫ এর বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনে তিনি প্রত্যক্ষভাবে অংশ নিয়েছিলেন। ১৯১৯ সালে জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ জানাতে তিনি ব্রিটিশ সরকারের দেওয়া ‘নাইট’ উপাধি ত্যাগ করেছিলেন।
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ট কীর্তি ‘শান্তিনিকেতন’ ও ‘শ্রীনিকেতন’। ১৯০১ সালে তিনি শান্তিনিকেতনে ‘ব্রহ্মচর্য বিদ্যালয়’ প্রতিষ্ঠা করেন। কবিগুরু এই বিদ্যালয়টিকে প্রাচীন ভারতের গুরুগৃহের আদর্শে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। পরবর্তীকালে এই প্রতিষ্ঠানটি পরিণত হয় ‘বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে’। শান্তিনিকেতনের বিদ্যালয়ে শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে নিজেকে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত রেখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ।
১৯৪১ সালের ৭ আগস্ট (১৩৪৮ সালের ২২ শ্রাবণ) কবি চলে গেলেন মহাপ্রস্থানের পথে। কবিশূন্য হল ‘শান্তিনিকেতন’ ও ‘শ্রীনিকেতন’। তবে তিনি আজও আমাদের মধ্যে বিরাজমান তাঁর অমর সৃষ্টিকর্মের মধ্যে দিয়ে।
পঁচিশে বৈশাখ আজও বাঙালির সাংস্কৃতিক জীবনলিপির এক সুরভিত অধ্যায়। কবি স্বয়ং তাঁর জন্মদিন পঁচিশে বৈশাখকে জীবনের এক বিশেষ তাৎপর্যমণ্ডিত দিন বলে মনে করতেন। এই দিনটিকে অবলম্বন করে তিনি যে কত কবিতা, গান, প্রবন্ধ রচনা করেছেন তা ভাবলে বিস্মিত হতে হয়। নিতান্ত বাল্যাবস্থা থেকেই আর পাঁচটি সাধারণ বাঙালি পরিবারের মতো ঠাকুর পরিবারেও কবির জন্মোৎসব পালিত হতো। আনুষ্ঠানিক ভাবে রবীন্দ্রজন্মোৎসব পালনের প্রাথমিক কৃতিত্বের দাবি করেছিলেন সরলা দেবী চৌধুরানী, রবীন্দ্রনাথের ভাগ্নি। ‘জীবনের ঝরাপাতা’য় রবিমামার প্রথম জন্মদিবস পালনের স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেছিলেন—‘আজ দেশব্যাপী রবীন্দ্র জন্মদিন অনুষ্ঠান। তাঁর ঘরে তাঁর বিছানার কাছে গিয়ে বাড়ির বকুল ফুলের নিজের হাতে গাঁথা মালা ও বাজার থেকে আনানো বেলফুলের মালার সঙ্গে অন্যান্য ফুল ও একজোড়া ধুতি-চাদর তাঁর পায়ের কাছে রেখে প্রণাম করে তাঁকে জাগিয়ে দিলুম। তখন আর সবাই জেগে উঠলেন।’
হে ক্ষণজন্মা, মহামানব, মহাকবি, মহাপুরুষ রবীন্দ্রনাথ– তুমি লহ প্রণাম।
‘হৃদয় আজি মোর কেমনে গেল খুলি
জগৎ আসি সেথা করিছে কোলাকুলি।’