সম্পাদকীয়

মাইক্রো চিটিং

Micro cheating

অনন্যা ভট্টাচার্য (মনোবিদ):

মাইক্রো চিটিং কী?

মাইক্রো চিটিং হল সম্পর্কের মাঝে এমন সব সূক্ষ্ম, অদৃশ্য বা পরোক্ষ আচরণ যা প্রেমিক বা স্বামী-স্ত্রীর বাইরে অন্য কাউকে গোপনে গুরুত্ব বা ঘনিষ্ঠতা দেওয়ার ইঙ্গিত বহন করে। এটি কোনও সরাসরি শারীরিক সম্পর্ক না হলেও, মানসিকভাবে অন্য কাউকে জায়গা দেওয়া, লুকিয়ে যোগাযোগ করা, অতিরিক্ত ফ্লার্ট করা ইত্যাদি আচরণের মাধ্যমে সম্পর্কের প্রতি অসততা প্রকাশ পায়। মাইক্রো চিটিং-এর ১০টি সম্ভাব্য উদাহরণ—

১. গোপনে কারও সঙ্গে চ্যাট বা মেসেজ চালিয়ে যাওয়া, যার কথা সঙ্গীকে বলা হয় না।

২. সাবেক প্রেমিক/প্রেমিকার সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখা, সেটা বন্ধুত্বের নাম করে হলেও।

৩. কাউকে গোপনে ভাল লাগার কথা বলা বা ভাবা, অথচ সঙ্গীর সাথে তা শেয়ার না করা।

৪. সোশ্যাল মিডিয়াতে কারও ছবিতে অতিরিক্ত রকমের কমেন্ট বা রিঅ্যাকশন দেওয়া।

৫. আপনার সম্পর্ক গোপন রাখা, যেমন অফিস বা অন্যত্র বললেন আপনি ‘সিঙ্গেল’।

৬. কোনও বিশেষ মানুষের জন্য নিজের চেহারা বা পোশাকে অতিরিক্ত যত্ন নেওয়া।

৭. কারও সঙ্গে সময় কাটানোর জন্য ইচ্ছাকৃতভাবে প্ল্যান করা বা মিথ্যা বলা।

৮. কাউকে ‘ভাল বন্ধু’ বলে চালিয়ে একান্ত আলাপ চালিয়ে যাওয়া।

৯. অন্য কারও সঙ্গে ভবিষ্যতের পরিকল্পনা নিয়ে রোমান্টিক ভাবে কল্পনা করা।

১০. কাউকে গোপনে ‘ক্রাশ’ হিসেবে রাখা এবং সেটিকে নির্দোষ হিসেবে দেখা।

শারীরিক এবং মানসিক প্রতারণার সঙ্গে এর পার্থক্য

  • শারীরিক প্রতারণা স্পষ্ট ও দৃশ্যমান। এটি একজন ব্যক্তি অন্য কারও সঙ্গে শারীরিকভাবে ঘনিষ্ঠ হয়।
  • মানসিক প্রতারণা হল অন্য কারও প্রতি আবেগগত টান তৈরি হওয়া যা সঙ্গীর চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।
  • মাইক্রো চিটিং এই দুইয়ের মাঝামাঝি অবস্থানে থাকে— এটি সরাসরি প্রতারণা নয়, তবে ধীরে ধীরে সম্পর্কের আস্থা নষ্ট করতে পারে। একে অনেক সময় ‘চোখে দেখা যায় না, তবে মন বুঝে ফেলে’ এমন কিছু হিসেবে ধরা হয়।

কীভাবে বুঝবেন সঙ্গী মাইক্রো চিটিং করছেন কি না?

১. আচরণে হঠাৎ গোপনীয়তা বেড়ে গেলে (ফোন লুকিয়ে ব্যবহার, নতুন পাসওয়ার্ড)

২. আপনার সঙ্গে সময় কাটানোর আগ্রহ কমে গেলে

৩. অপ্রয়োজনীয়ভাবে অন্য কারও কথা বারবার বললে

৪. সোশ্যাল মিডিয়ায় অতিরিক্ত সক্রিয়তা, বিশেষ কারও প্রতি গুরুত্ব

৫. কথায় কথায় রেগে যাওয়া বা এড়িয়ে চলা

৬. নতুনভাবে চেহারা, পোশাক বা মেকআপে অতিরিক্ত মনোযোগ দিলে

৭. গোপন ফোন কল বা বার্তা পেলে দূরে গিয়ে কথা বলা

৮. নিজের ফোন বা ডিভাইস কাউকে ধরতে না দেওয়া

মাইক্রো চিটিং কি কোনও মানসিক রোগ?

না, একে মানসিক রোগ বলা চলে না। তবে এটি আত্মনিয়ন্ত্রণের অভাব, আবেগ নিয়ন্ত্রণে দুর্বলতা, অতৃপ্তি এবং নিজের সম্পর্কের প্রতি অমর্যাদার ইঙ্গিত হতে পারে। কেউ কেউ নিজের অবচেতন মনেই মাইক্রো চিটিং করেন, আবার কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে করেন— একঘেয়েমি, উত্তেজনা খোঁজা কিংবা স্বীকৃতি পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা থেকেও এমন হয়।

মানুষ কেন মাইক্রো চিটিং করে?

১. সম্পর্কে একঘেয়েমি– দীর্ঘদিনের সম্পর্ক অনেক সময় ক্লান্তিকর মনে হয়, তখন মানুষ উত্তেজনা খোঁজে।

২. আত্মবিশ্বাসের অভাব– কেউ কেউ বাইরের স্বীকৃতি দিয়ে নিজের মূল্যবোধ যাচাই করেন।

৩. পুরনো অভ্যাস বা ফ্লার্ট করার স্বভাব

৪. প্রাক্তন সম্পর্কের আবেগ পুরোপুরি শেষ না হওয়া

৫. মনের মধ্যে অপরাধবোধ তৈরি না হওয়া—অনেকে মাইক্রো চিটিং-কে নির্দোষ ভাবেন।

৬. ডিজিটাল জগতে সীমাহীন সুযোগ– সোশ্যাল মিডিয়া, ইনবক্স— সবকিছু খুব সহজ করে দিয়েছে।

মাইক্রো চিটিং থেকে বের হওয়ার উপায়

১. আত্মজ্ঞান– প্রথমেই বুঝে নিতে হবে আপনি নিজে কোথায় দাঁড়িয়ে আছেন। নিজের আচরণ যাচাই করুন।

২. সঙ্গীর সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা– তার অনুভব বোঝার চেষ্টা করুন। অপরাধ স্বীকার করা কঠিন হলেও সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার মূল চাবিকাঠি।

৩. বিশ্বাস তৈরি করুন– গোপনীয়তা কমিয়ে আনুন, প্রয়োজন হলে নিজের ফোনে উন্মুক্ত রাখুন।

৪. সীমারেখা নির্ধারণ– সম্পর্কের ভিত শক্ত করতে হলে নিজেকে কিছু নিয়মে আবদ্ধ রাখতে হবে।

৫. কাউন্সেলিং গ্রহণ করা– অনেক সময় তৃতীয় পক্ষের সাহায্যে সমাধান পাওয়া যায়।

৬. সময় দিন ও মনোযোগ দিন– সঙ্গীর প্রতি যত্ন ও সময় দিন। সম্পর্ককে গুরুত্ব দিন।

৭. ডিজিটাল দূরত্ব তৈরি করুন—যে সব মাধ্যম আপনাকে মাইক্রো চিটিং-এর দিকে ঠেলে দেয়, সেগুলির ব্যবহার সীমিত করুন।

৮. নতুন করে সম্পর্ক গড়ুন– পুরনো দিনগুলির মতো সম্পর্ক আবার শুরু করুন, একসঙ্গে সময় কাটান।

উপসংহার

মাইক্রো চিটিং দেখতে নিরীহ মনে হলেও এটি সম্পর্কের ভিত নষ্ট করতে পারে। এটি ধীরে ধীরে একে অপরের উপর থেকে বিশ্বাস তুলে দেয় এবং মানসিক দূরত্ব তৈরি করে। তাই সচেতনতা, খোলামেলা আলোচনা, এবং একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধা ও যত্ন— এই তিনটি বিষয়ই মাইক্রো চিটিং  থেকে সম্পর্ককে রক্ষা করার মূল অস্ত্র।

যদি আপনি বা আপনার সঙ্গী এমন আচরণের মধ্যে পড়ে যান, তা হলে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া উচিত, কারণ ছোট ছোট ফাটলই একদিন সম্পর্কের দেওয়াল ভেঙে ফেলতে পারে। সম্পর্কের ভিত গড়ুন ভালবাসা, সম্মান ও বিশ্বাস দিয়ে— কারণ এই তিনটি না থাকলে কোনও সম্পর্কই দীর্ঘস্থায়ী হয় না।