
পর্ব-১: অলক মণ্ডল (লেখক – বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক): বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ তাঁর পূর্ববর্তী ও পরবর্তী কয়েক প্রজন্ম যেমন সাহিত্য সঙ্গীত ও চিত্রকলা শিল্পে নিজেদের প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন, তেমনই ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহলের মেয়েরা গান-বাজনা, নৃত্য, অভিনয়, সাহিত্যচর্চা এমনকি রন্ধনশিল্পেও নৈপুণ্য দেখিয়েছিলেন। পূর্ণিমা ঠাকুর ও প্রজ্ঞা সুন্দরী দেবীর রান্নার বইগুলোতে তার প্রমাণ রেখেছেন। বাস্তবিকই রান্না এবং রান্নাঘর নিয়ে কেতাবী ভাষায় রন্ধনতত্ত্ব বিদ্যা নিয়ে যত মাথা ঘামিয়েছেন প্রজা সুন্দরী দেবী অন্য কোনও মহিলা তা সম্ভবত করেননি।
রবীন্দ্রনাথ যে বহুমুখী সাহিত্য সৃষ্টির মধ্যেই নিজের সমস্ত সত্তাকে ডুবিয়ে রেখেছিলেন তা নয়। খাদ্যরসিক রবীন্দ্রনাথের বাহারি রকমারি খাদ্যদ্রব্যের প্রতি প্রবল আকর্ষণ ছিল। ঠাকুরবাড়িতে নানা রকম পদের রান্নার পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলত বরাবরই। রবীন্দ্রনাথও এই পরীক্ষা-নিরীক্ষায় অংশ নিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ রন্ধন প্রিয় ছিলেন, ভোজন-বিলাসীও ছিলেন। রীতিমতো রান্নাঘরে আসন নিয়ে বসে স্ত্রীকে তিনি যেমন সঙ্গ দিতেন, তেমনই রান্না করতেও পরামর্শ দিতেন, নতুন নতুন রন্ধন প্রণালীর কথা বলতেন।
ঠাকুর বাড়িতে সাধারণত ভাজাভুজি তো হতই, বড়ো ফর্দ থেকে ছাঁটকাট করে আলুভর্তা, কোর্মা, বেগুনভর্তা, মাখন মারা-ঘি ছাড়াও মেটে ভাজা, শুঁটকি মাছ পোড়া দিয়ে জমিয়ে খিচুড়ি খেতেন রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর পরিবারের অন্যান্যরা। সকলেই পছন্দ করতেন খিচুড়ি। এর সঙ্গে থাকত ধনে শাকের টক, চাটনি, এছাড়া কখনও থাকতো নানান টক-মিষ্টি চাটনি। রবীন্দ্রনাথের ভ্রাতুষ্পুত্রী ছিলেন প্রজ্ঞা সুন্দরী দেবী। তিনি বলতেন, ‘দই দিয়া খিচুড়ি খাইতেও মন্দ লাগে না।’
যশোরের মেয়ে ছিলেন কবি পত্নী মৃণালিনী দেবী। তিনি ছিলেন রন্ধন পটিয়সী। রন্ধন প্রিয়তা মেয়েদের সহজাত প্রবৃত্তি। তাতে কবিপত্নী মৃণালিনী দেবীর নৈপুণ্যের কথা উল্লেখ করে রবীন্দ্রনাথের বড় দাদা দ্বিজেন্দ্রনাথের পুত্র দ্বিপেন্দ্র নাথের স্ত্রী হেমলতা দেবী জানিয়েছেন যে, কবি পত্নীর রান্নার হাত ছিল চমৎকার। ব্যঞ্জনাদির স্বাদ ও মিষ্টান্নাদির পাক তাঁর হাতে উৎকৃষ্ট হয়ে উঠত। কবির জন্য প্রায়ই তিনি ঘরে নানা ধরনের মিষ্টি তৈরি করতেন নিজের হাতে। একবার যাঁরা তাঁর হাতের চিড়ের পুলি, দইয়ের মালপো, পাকা আমের মিঠাই খেয়েছেন তাঁরা আর ভোলেননি। নাটোরের মহারাজা স্বর্গীয় জগদীন্দ্রনাথ রায় কবি পত্নীর হাতের তৈরি মালপোর ভূয়সী প্রশংসা করতেন।
শান্তিনিকেতন-বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আগে একবার রবীন্দ্রনাথ মৃণালিনী দেবী আর দ্বিপেন্দ্রনাথ-হেমলতা দেবীর যৌথ সংসার গড়ে উঠেছিল। শান্তিনিকেতন কুঠি বাড়িতে। গৃহস্থালির ভার থাকত কবি পত্নীর। তাঁকে গৃহকর্মে সাহায্য করার ভার নিয়েছিলেন হেমলতা দেবী। হেমলতা দেবী আরও বলেছেন, ‘সংসারে প্রয়োজনীয় জিনিস সরবরাহ, খাদ্যদ্রব্য সংগ্রহ, ব্যয়ের হিসাব রাখার ভার আমার স্বামীর। খাওয়া হতো চমৎকার।’ কবি পত্নীর রান্নার ও মিষ্টান্নদি প্রস্তুতের বিরাম ছিল না একদিনও। কবি থেকে থেকে পত্নীকে বলতেন, ‘নীচে বসে লিখতে লিখতে রোজ শুনি, চাই ঘি, চাই সুজি, চিনি, চিড়ে, ময়দা, মিষ্টি তৈরি হবে। যত চাচ্ছ তত পাচ্ছ, মজা হয়েছে খুব।’ আমার স্বামীর নাম করে বলতেন, ‘সে তো কখনও ‘না’ বলবে না। যত চাইবে ততই দেবে, তাই তার মতো কর্তা ও তোমার মত গিন্নি হলেই হয়েছে আর কী। দু-দিনে ফতুর।’ কবিপত্নী ভাসুর পুত্রের (আমার স্বামীর) নাম করে বলতেন, ‘সে সংসার বোঝে, তার সঙ্গে কাজ করে সুখ, তোমার এদিকে নজর দেওয়া কেন?’
হেমলতা দেবী লক্ষ্য করেছিলেন, রবীন্দ্রনাথের নুতুন নুতুন রান্না আবিষ্কারের শখ। তাঁর মতে পত্নীর রন্ধন কুশলতাই কবির ওই বিচিত্র ধরনের শখের পিছনে কাজ করত। এ প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন, ‘রন্ধনরতা পত্নীর পাশে মোড়া নিয়ে বসে নতুন রান্নার ফরমাস করেছেন কবি। দেখা গেছে অনেকবার। শুধু ফরমাস করেই শান্ত হতেন না, নতুন মালমশলা দিয়ে নতুন প্রণালীতে পত্নীকে রান্না শিখিয়ে কবি শখ মেটাতেন। শেষে তাঁকে রাগাবার জন্য গৌরব করে বলতেন, ‘দেখলে তোমাদের কাজ তোমাদেরই-ই কেমন একটা শিখিয়ে দিলুম।’
রবি ঠাকুরের আদরের ছুটি (ওই নামেই তিনি ডাকতেন স্ত্রী মৃণালিনীকে) সানন্দে কবির আবদার মেনে কবির পছন্দের সব পদ রান্না করে দিতেন। একবার কলকাতা থেকে শান্তিনিকেতনে ফেরার সময় স্ত্রী মৃণালিনী দেবী ও কবির সঙ্গে যাবেন বলে ঠিক হয়েছে। সেখানে গিয়ে স্বামীকে মনের মতো করে রেঁধে খাওয়াবেন বলে হাতা, খুন্তি, মাপ মতো কড়াই, পিঠের ছাঁচ ইত্যাদি গুছিয়ে নিচ্ছেন দেখে কবি চিৎকার করে বলে ওঠেন, ‘ওহে শান্তিনিকেতন হচ্ছে যাজ্ঞবন্ধ্য মুণির আশ্রম। সেখানে একান্ন হাবিস্যি খেয়ে দিন চলে যায়।’
কিন্তু মৃণালিনী দেবী চেনেন তাঁর স্বামীকে। কম খেলেও নানা পদ, মিষ্টি খেতে ও খাওয়াতে খুব ভালবাসতেন তিনি। স্ত্রীর হাতের চিড়ের পুলি খেতে পছন্দ করতেন রবীন্দ্রনাথ। তাই কলকাতা থেকে সব গুছিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। ভোজন রসিক অথচ স্বল্পাহারী ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। পরবর্তীকালে প্রতিমা দেবীর স্মৃতিকথা থেকে জানা যায়, তিনি প্রতিমা দেবীকে বলেছিলেন, ‘বউমা তোমার শাশুড়িকে আমি কত রান্নার মেনু জোগাতুম। আমি অনেক রান্না তাকে শিখিয়েছিলুম, তোমরা বিশ্বাস করবে না জানি।’ উপস্থিত অন্যান্য মহিলারা বলতেন, ‘তিনিও তো ভালো রাঁধিয়ে ছিলেন আমরা শুনেছি।’ কবি হেসে বলতেন, ‘তা ছিলেন, নইলে আমার মেনুগুলো এত উদরোতো কি করে?
‘কবি প্রিয়া’র লেখিকা উর্মিলা দেবী রন্ধন কুশলতা প্রসঙ্গে স্মৃতিচারণ করে বলেছেন, মৃণালিনী দেবী রান্না করে মানুষকে খাইয়ে বড় তৃপ্তি পেতেন। তাঁর দাদা দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ যখন রবীন্দ্রনাথের জোড়াসাঁকো বাড়িতে যেতেন, তখন সিঁড়ি থেকেই বলতে বলতে উঠতেন, ‘কাকিমা, আজ কিন্তু এটা খাব, আজ কিন্তু ওটা খাব।’ মৃণালিনী দেবীও তক্ষুনি রান্নাঘরে গিয়ে সেটা তৈরি করতে বসতেন। রবীন্দ্রনাথও তাঁর স্মৃতিকথায় বলেছেন তাঁদের বাড়িতে যেদিন ‘খামখেয়ালি সভা’র অধিবেশন হত সেদিন রবীন্দ্রনাথ মৃণালিনী দেবীকে নতুন ধরনের রান্না তৈরির নির্দেশ দিতেন।
শিলাইদহ বাস কালে মৃণালিনী দেবী নিজে অমলা দাশের (দেশবন্ধু ভগিনী) কাছে মুখরোচক নানা রকম ঢাকাই রান্না শিখে তাঁকে যশোরের নিরামিষ ব্যঞ্জন রান্নার পদ্ধতি শেখাতেন সেকথাও জানিয়েছেন কবি পুত্র রথীন্দ্রনাথ। মায়ের সঙ্গে শান্তিনিকেতন বাসের স্মৃতি উল্লেখ করে তিনি লিখেছেন, ‘শান্তিনিকেতনে নিজেদের বাসের জন্য পৃথক বাড়ি তখন ছিল না, আমরা থাকতুম আশ্রমের অতিথিশালার দোতালায়। রান্নাবাড়ি ছিল দূরে। মা রান্না করতে ভালবাসতেন, তাই দোতলার বারান্দার এক কোণে তিনি উনুন পেতে নিয়েছিলেন। ছুটির দিনে নিজের হাতে বেঁধে আমাদের খাওয়াতেন। মা নানারকম মিষ্টান্ন করতে পারতেন। আমরা জানতুম, জালের আলমারিতে যথেষ্ট লোভনীয় জিনিস সর্বদাই মজুত থাকত সেই অক্ষয় ভাণ্ডারে সময়ে অসময়ে সহপাঠীদের নিয়ে এসে দৌরাত্ম্য করতে ত্রুটি করতুম না। বাবার ফরমাশ মতো নানারকম নতুন ধরনের মিষ্টি মাকে প্রায়ই তৈরি করতে হত। সাধারণ গজার একটি নতুন সংস্করণ একবার তৈরি হল, তার নাম দেওয়া হলো ‘পরিবন্ধ’। এটা খেতে ভালো, দেখতেও ভালো। কিন্তু একদিন বাবা যখন মাকে মানকচুর জিলিপি করতে বললেন, মা হেসে খুব আপত্তি করলেন, কিন্তু তৈরি করে দেখেন এটাও উৎরে গেল। সাধারণ জিলিপির চেয়ে খেতে আরো ভালো হল। বাবার এইরকম নিত্য নতুন ফরমান চলত, মাও উৎসাহের সঙ্গে সেই মতো করতে চেষ্টা করতেন।
কবিগুরুর নানান ধরনের খাবার মোটেই অরুচি ছিল না। পাউরুটির গুঁড়ো দিয়ে তৈরি ভেড়ার এবং চিকেন রোস্ট, চিংড়ির কাটলেট, টার্কির কাবাব, চিকেন কাবাব, মিঠা কাবাব, কষা মাংস। আর তাঁর বিশেষ পছন্দের খাবার ছিল আনারস দিয়ে খাসির মাংস। মাছের মধ্যে কাঁচা ইলিশের ঝোল ছাড়া চিতল মাছের পেটি এবং চিতলের মুইঠ্যা, চালতা দিয়ে মুগের ডাল, ভাপা ইলিশ, নারকেলের দুধ দিয়ে চিংড়ি। তিনি বিদেশ থেকে বিভিন্ন ধরনের রান্নার রেসিপি আনিয়ে বাড়ির বাবুর্চিকে দিয়ে বাঁধিয়ে খেতেন, এমনই ভোজন রসিক ছিলেন রবীন্দ্রনাথ।