সম্পাদকীয়

বিপন্ন বসুন্ধরা: বিশ্ব পরিবেশ সঙ্কট ও মানব সমাজের দায়

Endangered Bashundhara: The global environmental crisis and the responsibility of human society

মহম্মদ মফিজুল ইসলাম:

“এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি,

নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।”

কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের এই উচ্চারণ শুধু কবিতার পংক্তি নয়, আজকের পৃথিবীতে পরিবেশ রক্ষার অঙ্গীকারেও এক প্রতিজ্ঞা। প্রকৃতি আমাদের জন্মদাত্রী, পরিবেশ তার প্রাচীন বাহন। আমরা তার বুক থেকে নিই আলো, হাওয়া, জল ও অন্ন। অথচ যেই পরিবেশ আমাদের প্রতিদিন বাঁচিয়ে রাখে, আজ তাকেই মানুষের লোভ, ঔদ্ধত্য ও অজ্ঞতার ফলে প্রাণঘাতী সংকটের মুখে পড়তে হয়েছে। মানুষের কার্যকলাপের ফলে বিশ্ব পরিবেশের অবনমন আজ এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে, যেখানে শুধু প্রকৃতি নয়, বিপন্ন মানবসভ্যতাও।

পরিবেশের সংকট— পরিসংখ্যান বলছে যা

বর্তমানে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা শিল্প-বিপ্লব পূর্ববর্তী সময়ের তুলনায় ইতিমধ্যে প্রায় ১.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে গেছে। জাতিসংঘের IPCC (Intergovernmental Panel on Climate Change)-এর রিপোর্ট অনুযায়ী, এই হারে উষ্ণতা বাড়তে থাকলে ২০৫০ সালের মধ্যে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়বে অন্তত ৩০ থেকে ৭০ সেন্টিমিটার, যার ফলে বহু উপকূলবর্তী অঞ্চল বিলুপ্ত হবে।

বিশ্বজুড়ে প্রতিবছর প্রায় ৭০ লাখ মানুষ মারা যায় বায়ুদূষণের কারণে। পরিবেশ দূষণের ফলে ওজোনস্তরের ক্ষয়, কৃষিজ উৎপাদন কমে যাওয়া, পানীয় জলের সংকট, প্রাণীবৈচিত্র্যের বিলুপ্তি— সব মিলিয়ে এক বহুমাত্রিক সংকট সৃষ্টি হয়েছে।

অপর দিকে, বন উচ্ছেদও এক ভয়ঙ্কর রূপ নিয়েছে। জাতিসংঘের রিপোর্ট অনুযায়ী, প্রতি বছর পৃথিবী থেকে হারিয়ে যাচ্ছে প্রায় ১০০ কোটি গাছ। এমনকী আমাজনের মতো বর্ষাবনও আজ ধ্বংসের মুখে।

শিল্পোন্নত দেশ বনাম উন্নয়নশীল দায়

পরিবেশ বিপর্যয়ের ক্ষেত্রে সব দেশের দায় এক নয়। যুক্তরাষ্ট্র, চিন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ভারত— এই চারটি দেশ বা অঞ্চলের জন্য মোট কার্বন নির্গমনের ৬০ শতাংশ-র বেশি দায়ী। শিল্পোন্নত দেশগুলি দীর্ঘকাল ধরে অতিমাত্রায় জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার করে গ্লোবাল ওয়ার্মিং-এর কারণ হয়েছে।

১৯৯২ সালের রিও ডি জেনেইরো পরিবেশ সম্মেলন থেকে শুরু করে ২০১৫ সালের প্যারিস চুক্তি, এবং সর্বশেষ ২০২৩ সালের COP28 (দুবাই) পর্যন্ত বিশ্বের বিভিন্ন দেশ জলবায়ু পরিবর্তন রোধে চুক্তি করেছে। তবে বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বড় বাধা রয়ে গেছে— বিশেষত ধনী দেশগুলির অনীহা ও রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব।

প্যারিস চুক্তি অনুযায়ী ২০৩০ সালের মধ্যে কার্বন নিঃসরণ ৪৩ শতাংশ হ্রাস করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হলেও, বাস্তবে অনেক দেশ তা পূরণে ব্যর্থ হচ্ছে। ২০২৩ সালে জারি করা UNEP-এর “Emissions Gap Report” জানিয়েছে— এখনকার নীতিতে অব্যাহত থাকলে ২.৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত উষ্ণতা বৃদ্ধি অবশ্যম্ভাবী।

ভারতের চ্যালেঞ্জ ও পদক্ষেপ

ভারত একটি উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে একদিকে যেমন অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পথে এগোচ্ছে, অন্যদিকে পরিবেশ রক্ষার ক্ষেত্রেও বেশ কিছু কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। ‘International Solar Alliance’, ‘Lifestyle for Environment (LiFE)’ কর্মসূচি এবং নবায়নযোগ্য শক্তি উৎপাদনে ২০৩০ সালের মধ্যে ৫০০ গিগাওয়াট লক্ষ্যমাত্রা— এই সকল উদ্যোগ ভারতকে একটি দায়িত্বশীল পরিবেশ রক্ষাকারী দেশ হিসেবে উপস্থাপন করেছে।

তবুও দেশের অভ্যন্তরে দূষণ, জলসঙ্কট, বনাঞ্চল হ্রাস, ও নগরায়নজনিত সমস্যা পরিবেশকে প্রতিদিন দুর্বল করছে। বায়ুমান সূচকে দিল্লি-সহ বহু শহর আজ বিশ্বের অন্যতম দূষিত শহরের তালিকায়। ফলে উন্নয়ন বনাম পরিবেশ রক্ষার ভারসাম্য রক্ষা করাই ভারতের অন্যতম চ্যালেঞ্জ।

দায়ী কারা? সমাধান কোথায়?

পরিবেশ দূষণের কারণ শুধু শিল্প নয়, ব্যক্তিগত জীবনধারাও বড় ভূমিকা রাখে। প্লাস্টিকের অতিরিক্ত ব্যবহার, অপ্রয়োজনীয় ভোগবাদিতা, বিদ্যুৎ অপচয়, গাড়ি-নির্ভরতা— এসবই আমাদের প্রতিদিনের কর্মকাণ্ডের অংশ। অথচ, সমাধানও সেখানেই।

সাস্টেইনেবল ডেভেলপমেন্ট, অর্থাৎ এমন উন্নয়ন যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের চাহিদাকে বাধা না দিয়ে বর্তমান প্রজন্মের চাহিদা পূরণ করে— এটাই আজকের মূলমন্ত্র হওয়া উচিত। নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার, বর্জ্য পুনর্ব্যবহার, অর্গানিক কৃষির প্রসার, প্রাকৃতিক বনরক্ষা এবং পরিবেশ-সচেতন শিক্ষা–- এই সবই পরিবেশ রক্ষায় দীর্ঘমেয়াদি সমাধান হতে পারে।

সরকারের পাশাপাশি, সামাজিক সংস্থা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও নাগরিক সমাজের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছাড়া কোনও কার্যকর পরিবর্তন সম্ভব নয়।

পরিবেশ শিক্ষার প্রয়োজন

পরিবেশ রক্ষার প্রয়াস শুরু হতে হবে শিক্ষা থেকেই। স্কুল-কলেজে বাধ্যতামূলক পরিবেশ শিক্ষা, গণমাধ্যমে সচেতনতা প্রচার, সামাজিক আচার-অনুষ্ঠানে পরিবেশবান্ধব অনুশীলন— এসব ধাপে ধাপে সমাজকে গড়ে তুলতে হবে। যেহেতু দূষণ জাতীয় সীমানা মানে না, সেহেতু পরিবেশ রক্ষায়ও চাই আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ও আন্তর্জতিক আইন প্রয়োগের বাস্তব পদক্ষেপ।

আর কতবার শুনবো বসুন্ধরার আহ্বান?

জলে নামব অথচ বেণী ভিজবে না— এ যেমন অসম্ভব, তেমনই উন্নয়নের নামে পরিবেশ ধ্বংস করে সভ্যতা রক্ষা করা সম্ভব নয়। আমরা আজ যে সুবিধা ভোগ করছি, ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে তার মূল্য দিতে হবে— এমনটা চলতে পারে না।

একবিংশ শতাব্দীর এই মধ্যভাগে দাঁড়িয়ে আমাদের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে হবে— আমরা কি উন্নয়নের নামে পৃথিবীর ভবিষ্যৎ বন্ধক রেখে যাব, নাকি একটি বাসযোগ্য পৃথিবী রেখে যাব আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের জন্য?

উত্তর আমাদের হাতেই। পরিবেশ শুধুই প্রকৃতির নয়, আমাদের অস্তিত্বের রক্ষাকবচ। তাই আজ না জাগলে কাল কেঁদে ফিরলেও আর কিছু থাকবে না।