হেমন্তই হোন আর দেবেন্দ্র,মমতার দেখানো পথেই লক্ষ্মী লাভের চাবি কাঠি
Be Hemanta and Devendra, the path shown by Mamata is the key to gaining Lakshmi.

Truth of Bengal,তন্ময় সিংহ: ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনের ফলে উজ্জীবিত কংগ্রেস এবং ইন্ডিয়া অ্যালায়েন্স সবচেয়ে বড় ঝটকার সম্মুখীন হল নির্বাচনের ফলাফলে। লোকসভা নির্বাচনে অসাধারণ ফল করা দুটি রাজ্য মহারাষ্ট্র এবং হরিয়ানায় তাদের জোটকে ধরাশায়ী হতে হল। বিশেষ করে দেশের বাণিজ্যিক রাজধানীতে পরাজয় প্রিয়াঙ্কা গান্ধির ৪ লক্ষাধিক ভোটে জিতে সাংসদ হয়ে আসার আনন্দকে মাটি করে দিল।
২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনকে সংবিধান রক্ষার লড়াই বলে বিজয়ীর জয় তিলক পরায় মহারাষ্ট্রে বিরোধী জোটকেউদ্ধব ঠাকরে ও শরদ পাওয়ার সহানুভুতির ভোট পেলেও বিধানসভা নির্বাচনে মানুষের আশীর্বাদ থেকে বঞ্চিত হল। অন্যদিকে মহারাষ্ট্রে বাজিমাত করল সরকার পক্ষের মহিলা সম্মান যোজনা। ঝাড়খণ্ডেও জেলযাত্রার পরেও ফিরে এসেদলের প্রথম সারির নেতৃত্বের বিজেপিতে যোগদানের পরেও সফলভাবে মহিলা সম্মান যোজনা চালু করে ঝাড়খণ্ডের ক্ষমতা ধরে রাখলেন হেমন্ত সরেন।
লোকসভা এবং বিধানসভার প্রেক্ষাপট অবশ্যই আলাদা এবং স্থানীয় প্রার্থীর পরিচিতি, ব্যক্তিগত ক্যারিশমা, আঞ্চলিক নেতৃত্ব এবং সংগঠনের সঙ্গে স্থানীয় ইস্যু ও জনগণের চাহিদা পরিলক্ষিত হয় জয় পরাজয়ের নির্ণায়ক ভূমিকায়। লোকসভায় যে জনগোষ্ঠী সম্পূর্ণভাবে বিজেপির বিরুদ্ধে ভোট দেয় তারাই আবার মহারাষ্ট্র বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি জোটের পক্ষে এলাকা ভিত্তিতে ভোট দেয়। বালাসাহেব ঠাকরের দলেরসঙ্গেগদ্দারির হাওয়ার সহানুভূতির ভোট লোকসভা ভোটে সম্পূর্ণভাবে ঘরে উঠলেও বিধানসভা ভোটে মুম্বই পেরোনোর পরেই আরব সাগরের শুষ্ক হাওয়া উদ্ধব ঠাকরের দলের জন্য।
বৃহত্তর মুম্বইয়ের থানে ও কোঙ্কন এলাকায় বিধানসভায় নির্বাচনের ফলাফলে মানুষের সরাসরি সাপোর্ট একনাথ শিন্ডের দিকেই গেল। আবার অজিত পাওয়ার বারামতী এলাকায় তাঁর নিজস্ব উন্নয়নের জন্য বিধানসভা ভোটে মানুষের সাপোর্ট পেলেন যদিও লোকসভায় ওইভোটাররাইছিলেন শরদ পাওয়ারেরসঙ্গে। তবে বিধানসভা নির্বাচনে মহারাষ্ট্রে সবচেয়ে বড় ইউএসপি ছিলেন অধুনা আরএসএস-এর পোস্টারবয় দেবেন্দ্র ফড়নবিস।
একবারের মুখ্যমন্ত্রী দেশের বাণিজ্যিক রাজধানীর বিজেপির প্রধান মুখ দেবেন্দ্র অতি সহজেই কম গুরুত্বপূর্ণ উপমুখ্যমন্ত্রী পদ সামলে গিয়েছেন কোনও ইগো ছাড়াই। উদ্ধব ঠাকরে ও শরদ পাওয়ারের দলের মধ্যে ফাটল ঘটিয়ে বিধানসভাতে বিজেপিকে পুনরায় ক্ষমতায় নিয়ে আসার জন্য দেবেন্দ্র ফড়নবিস প্রশংসার থেকে সমালোচিত হয়েছেন বেশি। কিন্তু তিনি জানতেন, সরকারে থাকলেই মানুষের জন্য কাজের সুযোগ সবচেয়ে বেশি পাওয়া যাবে।
মহারাষ্ট্র বিজেপি একক সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়ার জন্য সবচেয়ে বেশি কৃতিত্বের দাবিদার ২০২৪-এর বিধানসভা নির্বাচনে দেবেন্দ্র ফড়নবিসই। জোট রাজনীতির বাধ্যবাধকতায় যদি তিনি এবারও মুখ্যমন্ত্রী নাও হন, তাহলেও আরএসএস ও মোহন ভাগবতের আশীর্বাদ বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি পদে পৌঁছে দিতেই পারে। আবার অনেকে বলেন উচ্চাকাঙ্ক্ষী দেবেন্দ্র ফড়নবিস আসলে পাখির চোখ করেছেন নরেন্দ্র মোদির পরবর্তীতে দেশের প্রধানমন্ত্রীর চেয়ার।
ঝাড়খণ্ডের ক্ষমতার জন্য বিজেপির তরফ থেকে হেমন্ত সোরেনকে জেলে পাঠিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত ব্যুমেরাং হিসেবে ফিরে এল বিধানসভা নির্বাচনে। লোকসভা নির্বাচনের পরে আবার বিধানসভায় তাঁর প্রতি মানুষের ভালবাসা জন্ম দিল কল্পনা সরেন বলে নতুন এক নেত্রীর। যে রাজ্যের প্রতি চারজনের একজন আদিবাসী সেখানে একজন আদিবাসী মুখ্যমন্ত্রীকে ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় জেলে দেওয়া মেনে নিতে পারেনি আদিবাসী মানুষ।
রাঁচি, জামশেদপুর, ঘাটশিলা, ডালটনগঞ্জের মতো শহরাঞ্চলে বিজেপি ভোটের ফল ভাল করলেওহেমন্ত বিশ্বশর্মার মতো হিন্দুত্বের পোস্টার বয়কে নিয়ে এসে ঝাড়খণ্ডের দখল করে নিচ্ছে পূর্ববঙ্গের লোকেরা– এই প্রচার বিশ্বাস করেনি জনতা। পশ্চিমবঙ্গের প্রতিবেশী রাজ্যেও চম্পাই সোরেনকে বিজেপির ক্যাম্পে ক্ষমতার জন্য ভোটের আগে চলে যেতে দেখে আদিবাসী ভোট আরও ঘনীভূত হয়েছে কল্পনা ও হেমন্ত সোরেনের জন্য।
তবে এসবের পরেও এই বিধানসভা নির্বাচনে কিং মেকার হিসেবে থেকে গেলমহিলা সম্মান যোজনা। দুই রাজ্যের শাসক দল ভোটের আগে মানুষের কাছে পৌঁছনোর অন্তিম চাল হিসেবে মহিলা সম্মান যোজনা চালু করেছিল। নিজেরব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে টাকা পৌঁছনোর পাশাপাশি বাড়ি বাড়ি গিয়ে শাসক দল জানিয়ে দিয়েছিল যে মহিলা সম্মান নিধি তারাই চালু করেছে। বিরোধী দল কোনও প্রতিশ্রুতি দিয়েই এই নগদ টাকা পাওয়ার যোজনার বিকল্প তুলে ধরতে পারেনি।
ভোটের দিন মহিলাদের ঢল নামে ভোট কেন্দ্রগুলিতে এবং দেখাযায় দিনের শেষে সমস্ত কিছুর ওপরে মহিলাদের সম্পূর্ণ সমর্থন পেয়েছে শাসক দল এবং নির্বাচনে জয়লাভ করেছে তারা। পশ্চিমবঙ্গের উপনির্বাচনেও ৬টি সিটের মধ্যে বিজেপির শক্ত কেন্দ্রগুলি পুনরুদ্ধার করতে পেরেছে তৃণমূল কংগ্রেস। এই মহিলা সম্মান নিধি পশ্চিমবঙ্গের প্রথম সফলভাবে চালু হয়েছিল ‘লক্ষীর ভাণ্ডার’ নাম দিয়ে।
রাজ্যেরশাসকদলযার সুফল পেয়েছেআগের বিধানসভা,লোকসভা-সহ সমস্ত ভোটে। অন্যদিকে, পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে বিকল্প মুখ হওয়ার জন্য বিজেপিকে অনেক পথ পেরোতে হবে।সংগঠনের বিস্তারেরসঙ্গেসঙ্গে দিলীপ ঘোষের মতো সকলকে জায়গা করে কাজের সুযোগ দিতে হবে। সারা বাংলায় জননেতা হিসেবে গুরুত্ব থাকার পরেও শুভেন্দু অধিকারীর কপালে ভাঁজ ফেলতে পারে এই ফলাফল। পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে কোনও ভাল নেতৃত্বের তত্ত্বাবধানে কংগ্রেস থাকলে আগামী দিনে বিকল্প হিসেবে সিপিএমের থেকে গ্রহণযোগ্যতা বেশি হওয়ার সম্ভাবনা।
ফেসবুক ও শহরাঞ্চলের পার্টি হিসেবে সফল আন্দোলন কলকাতার বুকে রূপায়ন করলেওসিপিএমের ৩৪ বছরে অত্যাচারের ক্ষত গ্রামবাংলায় এখনও দগদগে। যে লক্ষীর ভাণ্ডারকে কেন্দ্র করে এবারের সমস্ত বিধানসভার ফলাফলগুলি রূপায়িত হল, সে সম্পর্কে সিপিএমের মনোভাব তাদের জনবিচ্ছিন্নতার পরিচয় বহন করে।একটু পিছিয়ে গেলেই দেখা যেত সাধারণ মহিলাদের মধ্যে এর জনপ্রিয়তা।
২০১৯ সালেলোকসভা নির্বাচনে বিজেপি ও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বিপুল জয়ে পশ্চিমবঙ্গ বিজেপির রাতারাতি ২ জন সাংসদ বেড়ে হয়ে গেল ১৮ জন। ব্যক্তিগত ক্যারিশমায় চলতে থাকা তৃণমূলেরবড়ক্ষতিহয়। মানুষের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটে একশ্রেণির নেতার বিরুদ্ধে। আর অন্য দল ঠিক করে বিধানসভা নির্বাচনের আগে বিজেপিতে গিয়ে নিজেদের ভবিষ্যৎ সুনিশ্চিত করার।
সেই সময় অভিষেকবন্দ্যোপাধ্যায়েরহাত ধরেপশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে প্রথম আগমন ঘটে নির্বাচনী স্ট্র্যাটেজিস্ট প্রশান্ত কিশোরের। মানুষের ক্ষোভকে সরাসরি প্রফেশনালদের মাধ্যমে ‘দিদিকে বলো’ কর্মসূচির মধ্যে সংগ্রহ করেপ্রশাসনকে নিয়ে যাই গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে ‘দুয়ারে সরকার’-এর মাধ্যমে। এই সময়েই ঠিক ২০২১-এর নির্বাচনের আগে মমতাবন্দ্যোপাধ্যায়ঘোষণা করেন,‘লক্ষীর ভাণ্ডার’ প্রকল্প।
সরাসরি বাংলার সমস্ত মা-বোনেদের হাতে ৫০০-১০০০ টাকা পৌঁছে দেওয়াহয়। প্রকল্পটিযারই মস্তিষ্কপ্রসূত হোক না হোক না কেন, ক্ষমতার স্বপ্ন দেখতে থাকা বিজেপি বিষয়টিকে গুরুত্ব দেয়নি এবং জনবিচ্ছিন্ন বামপন্থীরা বিষয়টিকে ভিক্ষা হিসেবেই ধরে নিয়েছিল। ফলাফল প্রায় হারা বাজি ২০২১-এ ঐতিহাসিক তৃণমূলের জয়। ২০২৪-এর লোকসভা পর্যন্ত বারংবার এই প্রকল্পটি পশ্চিমবঙ্গে সফলভাবে রূপায়িত হয়েছে।
বিজেপিরসঙ্গেমমতাবন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজনীতির ফারাক যাই থাকুক না কেন, লক্ষীর ভাণ্ডার জনপ্রিয় হওয়ারসঙ্গেসঙ্গে সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পারদর্শী দেশের প্রধান রাজনৈতিক দল বুঝতে পারে পশ্চিমবঙ্গে তাদের হারের প্রধান কারণ এই লক্ষীর ভাণ্ডার। হারতে বসা মধ্যপ্রদেশের শিবরাজ সিংহ চৌহানের হাত দিয়ে ‘লাডলি বহেনা’ নাম দিয়ে দিদির লক্ষ্মীর ভাণ্ডার মধ্যপ্রদেশে চালু করে সুফল তোলেন তাঁরা।
লক্ষ্মীলাভ হয় মধ্যপ্রদেশের মেয়েদের। একই পথে হেঁটে হরিয়ানাতেও সমস্ত সমীক্ষায় পিছিয়ে পড়ার পরেও লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের স্থানীয় সংস্করণ ‘হর ঘর হর গৃহিণী’ চালু করে ক্ষমতায় ফিরেছেন নয়াব সিং সাহানি। এর সুফল পেয়ে হরিয়ানাতে বিজেপি সরকার বিপুল প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা সত্ত্বেও পুনরায়নির্বাচিত হয়।
একই পথের পথিক হিসেবে বিভিন্ন সময়ে এই প্রকল্প প্রয়োগ হয়েছে তামিলনাড়ুতে ও অন্ধ্রপ্রদেশে। ২০২৪-এর নির্বাচনে সুভদ্রা যোজনার হাত ধরে বিজেপি ক্ষমতায় এসেছে ওড়িশাতে। কংগ্রেস থেকে বিজেপিতে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রী হওয়া এবং বর্তমান হিন্দুত্বের পোস্টারবয় হিমন্ত বিশ্বশর্মাওমহিলাদেরজন্যঅসমে ঘোষণা করেছে অরুণোদয় স্কিম। হিমাচল প্রদেশে কংগ্রেস সরকার ঘোষণা করেছে মহিলাদের জন্য প্রত্যেক মাসে মাসিক সম্মান পেয়ারি বহেনা, আবার কর্নাটকে গৃহলক্ষ্মীর হাত ধরে ক্ষমতায় এসেছে কংগ্রেস।
তেলেঙ্গানাতেওকোনও শর্ত ছাড়াই মহিলাদের অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠানোর এই স্কিমটি জনপ্রিয় হয়েছে। এছাড়াও রাজস্থানে লাখপতি যোজনা এবংওড়িশায় সুভদ্রা যোজনা স্বল্প সঞ্চয় মেয়েদের লোন দেওয়ার প্রকল্প। আসন্ন দিল্লি নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে অরবিন্দ কেজরিওয়াল জানুয়ারির থেকেই চালু করেছেন এই প্রকল্প। আবার উত্তরপ্রদেশে যোগীর ঝুলির থেকেও এই প্রকল্প বেরহবে বলেও খবর।
২০২৪-এর বিধানসভা নির্বাচনে মহিলা সম্মান যোজনার সাফল্য প্রমাণ করল ঝাড়খণ্ড,মহারাষ্ট্র-সহ আজ পর্যন্ত যে রাজ্যেই এই প্রকল্পটি সফল রূপায়ণ হয়েছে কমপক্ষে ৭০ শতাংশ মহিলা ভোট পেয়েছে রূপায়নকারী দল। প্রবল প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা সত্ত্বেও এই একই পথে হেঁটে এবারের বাজি জিতলেন হেমন্ত সোরেন ও একনাথশিন্ডে।
মানুষের সেন্টিমেন্ট এবং প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা সত্ত্বেও রাজ্যের মহিলাদের অ্যাকাউন্টে সরাসরি টাকা ট্রান্সফার করে নির্বাচনী বৈতরণী পার করতে সক্ষম হলেন তাঁরা। তবে এত কিছুর মাঝেও আমাদের মনে রাখতে হবে, মাসিক নির্ভরযোগ্য আয়ের সুযোগ যে আমাদের দেশের মহিলারা পাচ্ছেন না,এই স্কিমগুলির ওপর তাদের দৃঢ় ভরসার সেটাই প্রমাণ করে।
এখন দেখার, আগামী দিনে কেন্দ্র ও রাজ্যের নির্বাচিত সরকারসমাজের প্রত্যেকের স্বশক্তিকরণ, শিল্প ও চাকরি তৈরির মৌলিক চাহিদা পূরণ করে আর্থিকভাবে জনগণকে স্বাবলম্বী করার প্রয়াস করে না সরাসরি এইভাবে বেনিফিট ট্রান্সফার করে জনপ্রিয় রাজনীতি করে ভোটব্যাঙ্ক নিশ্চিত করে।যাইহোক এই হেমন্তে মমতার পরশে ‘রেওড়ি পে চর্চা’-র বিষয় হবে দেবেন্দ্রের লক্ষ্মীলাভ।