
The Truth of Bengal: কলকাতার রাস্তায় ঘোড়ার গাড়ি, বা টাট্টুঘোড়ার গাড়ি অনেকেই দেখেছেন, কিন্তু খাস মহানগরিতে দিনে দুপুরে জেব্রায় গাড়ি টেনে নিয়ে যাচ্ছে, আর সেই জুড়ি গাড়িতে বসে রয়েছে, কলকাতার নামজাদা ব্যবসায়ী এমন দৃশ্য হয়তো কস্মিনকালে দু চারবারই দেখা গিয়েছে। তখন ইংরেজ শাসনকাল, উত্তর কলকাতায় ইংরেজদের সঙ্গে বাণিজ্যের সুবাদে বেশ কিছু বাঙালি ব্যবসায়ীর উঠে এসেছিলেন, পাথুরিয়া ঘাটের যুদুলাল মল্লিক এমনই একজন ব্যবসায়ী। তাঁরই ছোট ছেলে মন্মথ মল্লিকের ট্রটিং গাড়ি টানতো জেব্রা। ওই যে কথায় বলে, ধনী লোকের আজব খেয়াল। ১৯৩৫ সাল। সেই সময়ে মন্মথ মল্লিকের আস্তাবলে, জাত কুল বিচারের দিক থেকে সেরা ঘোড়া ছিল। এবং একটা দুটো নয়, বেশ কয়েকটা। কিন্তু বোধহয় নিজের বাবুয়ানায় কিছুটা বৈচিত্রের রং লাগাতেই তিনি আলিপুর চিড়িয়াখানা থেকে ৬ হাজার টাকায় একজোড়া জেব্রা কিনেছিলেন। এমনকী তাদের দিয়ে গাড়ি টানানোর জন্য প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল। কারও কাছে শুনেছিলেন জেব্রা নাকি পোষ মানে না। হয়তো সেই জনশ্রুতিকে ভুল প্রমাণ করতেই তাঁর এই শখ পূরণ। কলকাতার রাস্তায় জেব্রা গাড়ি চলে যাচ্ছে এই দৃশ্য় দেখতে রাজপথের আশে পাশে কত মানুষ জমায়েত হয়েছিলেন, তার ইতিহাস বা রেকর্ড না মিললেও, পরের দিন কলকাতার স্টেটমেন্ট পত্রিকায় যে খবর প্রকাশিত হয়েছিল।
পাথুরিয়াঘাটার বনেদি পরিবারের মল্লিকবাড়ির কনিষ্ঠ সন্তান মন্মথনাথে বিলাসিতার কাহিনী এখানেই শেষ নয়। সেই সময়ে তিনি যে রলস রয়েস কিনেছিলেন, তারও প্রমাণ মেলে। যদিও বলে রাখা ভালো, সেই সময় রলস রয়েস গোটা ভারতে কয়েকজন রাজা মহারাজা ও লাটসাহেবেরই ছিল। মন্মথর কাছে মল্লিকা নামে এক বজ্রাও ছিল। মোটরলঞ্চে চেপে তিনি গঙ্গা বিহার করতে বেরোতেন।এমনকী তাঁর বড় পুত্র রাসবিহারীর বিয়েতে তিনি ফোর্ট উইলিয়াম থেকে শোভাযাত্রাও বের করেছিলেন করেছিলেন। সেই এই শোভাযাত্রায় খোলা তলোয়ার ধরা ঘোড়সওয়ার, 36টি পুলিশ ঘোড়সওয়ার, চারটি ঘোড়ায় টানা দুই গাড়ির কনসার্ট পার্টি ও ১৬ ঘোড়ায় টানা একটি গাড়ি ছিল। সেই শোভাযাত্রা ছিল কলকাতার বুকে এক ঐতিহাসিক উল্লেখযোগ্য ঘটনা। এই পরিবারেরই এক উততরসুরি, যদুলাল মল্লিক এর বড় ছেলে রায় বাহাদুর অনাথ নাথ মল্লিকের একমাত্র পুত্র প্রদ্যুন্ন কুমার মল্লিক অবশ্য শৌখিনতার দিক থেকে শ্রেষ্ঠ তকমা পেয়েছিলেন। তাঁরও শখ ছিল অদ্ভুত রকমের। কলকাতার সম্ভ্রান্ত বাড়িগুলো যে কোন দামে কিনে ফেলতেন। স্রেফ নিজেকে বাংলার শ্রেষ্ঠ ধনী প্রমাণ করার জন্য।
প্রসন্নকুমার ঠাকুরের নাপতেহাটার বাড়ি, শ্যাম মল্লিকের ৮৪ নম্বর আপার চিৎপুর রোডের বাড়ি, ৮৩ নম্বর আপার চিৎপুর রোডের হরেন্দ্র কৃষ্ণ শীলের বাড়ি তিনি কিনেছিলেন। এমনকী মহারাজা প্রদ্যুৎ কুমার ঠাকুরের প্রাসাদ কেনার জন্য তিনি বায়নানামাও করে ফেলেছিলেন। কিন্তু মহারানীর ভিক্টোরিয়ার হস্তক্ষেপে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তার আবেদন নামঞ্জুর করে দেয়। এছাড়াও অনেক বাড়ি তিনি কিনেছিলেন, পাশাপাশি বায়না দিয়ে রেখেছিলেন।
প্রদ্যুন্ন কুমারের মোটর গাড়ি ছিল মোট ৩৫টি। তার মধ্যে ১০ রলস রয়েস। আবার তার মধ্যে দুটি গাড়ির বডি ছিল অ্যালুমিনিয়াম ও পিতলের, যা সচরাচর রলস রয়েসে থাকে না। শুধু বাড়ি গাড়ি নয়, আভিজাত্যের পরিচয় দামী আসবাবপত্র দুর্লভ শিল্প সামগ্রী তিনি আনাতেন ইউরোপ থেকে। বিপুল অঙ্কের বাড়ি, গাড়ি কিনতে তিনি ব্যাঙ্ক থেকে বিপুল ঋণও নিতেন। পাশাপাশি বীমা কোম্পানির থেকে ওভারড্রাফ্টও নিতে হয়েছে তাঁকে। অবশেষে ঋণের দায়ে তাঁকে কলকাতা ছেড়ে মধুপুরে নিজের প্রাসাদপম মার্বেল প্যালেসে আশ্রয় নিতে হয়। নিজের স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়েছিলেন, পাশাপাশি নিয়ে গিয়েছিলেন একটি রিভলবার। সেখানেই তিনি নিজের স্ত্রীকে গুলি করে নিজে আত্মঘাতী হন।