ছাত্র-শিক্ষকের সম্পর্কে আজ এসেছে পেশাদারিত্ব
বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থায় গুরুকুলের অস্তিত্ব বিলুপ্ত, এখন বিদ্যালয় শিক্ষা নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হচ্ছে।
রথীন কুমার চন্দ, চন্দননগর, হুগলি: কচিকাঁচা থেকে কলেজ, সকল স্তরের ছাত্রছাত্রী শিক্ষকের কাছে সমান। শিক্ষকদের অর্জিত জ্ঞান গুরুকুলে ছাত্ররা লাভ করে। রামায়ণ ও মহাভারতে ছাত্ররা গুরুকুলের শিক্ষালাভ করতে গৃহত্যাগ করে, গুরুকুলের পরিবেশে নিজেদের সমস্ত ধরনের বিদ্যায় পারদর্শী হয়ে ঘরে বা রাজগৃহে ফিরে আসতো।
বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থায় গুরুকুলের অস্তিত্ব বিলুপ্ত, এখন বিদ্যালয় শিক্ষা নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হচ্ছে। টোলের শিক্ষায় নিমাই পণ্ডিত সমাজের একজন বিদগ্ধজন হয়ে উঠেছিলেন। তৎকালীন সমাজের নামকরা পণ্ডিতের শিক্ষার দর্প চূর্ণ করেছিলেন, টোল শিক্ষার ছাত্র হয়ে।
আজকের যুগে টোল শিক্ষা অস্তাচলে গেছে। গুরু গৃহের শিক্ষা বিলুপ্ত। বিদ্যালয় শিক্ষা পদ্ধতি আমাদের মজ্জাগত। শিক্ষকরা তাদের সাধ্যমতো দেওয়ার চেষ্টা করেন। খমতি রাখেন না তাদের শিক্ষাদানের চেষ্টায়। শিক্ষাদান করা যায়, বিক্রি করা যায় না। বর্তমান সমাজব্যবস্থায় শিক্ষা দান নয়, শিক্ষা বিক্রি করার পর্যায় চলে এসেছে। প্রাইভেট টিউশন ছাত্রছাত্রীদের সেই শিক্ষা গ্রহণে বাধ্য করাচ্ছে।
বিদ্যাসাগর রামমোহন রায় থেকে শুরু করে প্রফুল্ল চন্দ্র রায়, জগদীশচন্দ্র বসু প্রত্যেকেই প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষিত হয়েছেন। এমনকী নন্দদুলাল বসু, রামকিঙ্কর বেজ এরাও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মুক্ত শিক্ষাঙ্গন নীতিতে ছাত্রদের শিক্ষিত করে তুলেছেন। ছাত্রদের সেই শিক্ষা ব্যবস্থায় কোনও ত্রুটি বা গলদ ছিল না। বদ্ধ ও পুঁথিগত শিক্ষার বাইরে শিক্ষাব্যবস্থা কথাটা গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেই শিক্ষা পদ্ধতি আজও অবিচল এবং অমলিন হয়ে রয়েছে বিশ্বভারতীর শিক্ষাঙ্গনে। সেই প্রাঙ্গণে শিক্ষা দিয়ে নন্দদুলাল বসু, রামকিঙ্কর বেইজের মতো শিক্ষকরা শিক্ষক সমাজে আদৃত হয়েছিলেন।
কাজ পণ্যেতে পর্যবসিত হয়েছে, গুরুকুল শিক্ষার সঙ্গে ও টোলের শিক্ষার সঙ্গে আজ বিস্তর ফারাক রয়েছে। শিক্ষাগত যোগ্যতাতেও অনেক পার্থক্য। শিক্ষা ক্ষেত্রে প্রযুক্তির ব্যবহার বেড়েছে ঠিকই কিন্তু মান ক্রমশ নিম্নমুখী হয়েছে। শিক্ষক ও ছাত্রের মধ্যে সম্পর্ক আজ তলানিতে এসে ঠেকেছে। বিগত শতাব্দীগুলিতে শিক্ষা কখনওই পূর্ণ ছিল না। এবং ছাত্রদের কাছে শিক্ষকরা ছিলেন শিক্ষাগুরু এবং ছাত্ররা ছিল সন্তানতুল্য।
বর্তমানে শিক্ষককে শিক্ষাগুরু থেকে অনেকটাই পদস্খলন করা হয়েছে, সন্তানসম ছাত্ররা শিক্ষকদের সেই সম্ভ্রমের সীমারেখা রাখতে পারছে না। শিক্ষক ও ছাত্রের মধ্যে সম্পর্ক আজ সামাজিক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। ছাত্র একদিন পড়া না করে এলে শিক্ষক মহাশয় তাকে শাসন করতেন তার পড়াশোনার জন্য এবং তাকে সঠিক দিশায় পরিচালিত করার জন্য, কিন্তু আজ ছাত্র চলে যাবে বলে এবং ছাত্রদের কাছে অপমানিত বা অপদস্ত হওয়ার ভয়ে ছাত্রকে কোনও কিছু না বলা থেকে ধনুক ভাঙা পণ করে রেখেছেন। ছাত্র-শিক্ষকের সম্পর্কে আন্তরিকতার বদলে পেশাদারিত্ব বেশি করে দেখা যাচ্ছে।
ছাত্রদরদি শিক্ষকের সংখ্যা আজ বিলুপ্তির পথে। ছাত্রকে নিজের ঘরে রেখে শিক্ষাদান করার মহান ব্রত অনেক শিক্ষককেই আমাদের জীবনে দেখেছি। শিক্ষা যাতে কোনও রকম ব্যাঘাত না ঘটে অথবা যাতায়াতের সমস্যার কারণে ছাত্রকে নিজের ঘরে আশ্রয় দান করার মহানুভবতা একমাত্র বোধহয় শিক্ষকরাই ভাবতে পারেন। শর্টহ্যান্ড শিখতে গিয়ে শিক্ষক মশায়ের সেই অনুভূতির পরিচয় সেখানেই। শরীর খারাপ থাকা অবস্থায় ছাত্রকে শর্টহ্যান্ড শিক্ষাদান থেকে তিনি বিরত থাকেননি, বরং দ্বিগুণ উৎসাহে তার কর্তব্য পালন করেছেন। নিজের স্বার্থকে তুচ্ছ মনে করে ছাত্রদের স্বার্থকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছেন। সারাদিন অক্লান্ত পরিশ্রম করেও রাত্রিবেলাতেও তিনি রাত সাড়ে এগারোটা পর্যন্ত ছাত্রদের জন্য ক্লাস করাতে কসুর করতেন না। ছুটির দিনেও তিনি ছাত্রদের নিয়ে ক্লাস করাতে দ্বিধাবোধ করতেন না।
শিক্ষাকে নিয়ে তিনি ব্যবসায়িক সাধনার ক্ষেত্র করেননি বরং তার শিক্ষার অঙ্গনে শিক্ষাদান এবং তাকে পেশা করে জীবনে সাফল্য লাভ করে ছাত্ররা প্রতিষ্ঠিত হোক এই তার স্বপ্ন ছিল। তার শিক্ষকসুলভ আচরণ এক অন্যমাত্রায় নিয়ে গিয়েছিল। শিক্ষাদানের মহত্ব কোথায় কোথায় বিস্তৃত হয়েছিল তার প্রমাণ ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানগুলিতে তার অগণিত ছাত্রদের প্রতিষ্ঠিত ভাবে পদাশীন হওয়া থেকে বোঝা যায়।


