সম্পাদকীয়

নিজের বিয়েতেও বিদ্রোহী ছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম

Kazi Nazrul Islam was a rebel even in his own marriage

Truth Of Bengal: প্রভাত কুমার মিত্র: স্বভাব-রোমান্টিক কবি নজরুলের প্রেম ও বিয়ে নিয়ে গল্পের শেষ নেই। কিন্তু সেই প্রেমকাহিনির আড়ালে বোধহয় চাপা থেকে যায় এক বিদ্রোহের গল্পও। বা হয়তো বিদ্রোহও নয়। এমনটাই তো আদতে স্বাভাবিক। কিন্তু সেই স্বাভাবিক ঘটনাই যখন প্রায় ঘটে না, তখন এই ঘটনাকে আলাদা করে গুরুত্ব দিতে হয় বৈকি।

এক হিন্দু নারীকে বিয়ে করেছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। কিন্তু সেই সম্পর্কে জড়ানোর জন্য তাঁদের কাউকেই নিজস্ব ধর্মপরিচয় ত্যাগ করতে হয়নি। ধর্ম পরিবর্তনের নির্দেশও চেপে বসেনি সেই হিন্দু নারীর উপরে। না, নজরুল যে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মকে কোনও দিনই খুব বড় করে তুলেছেন তা তো নয়। কিন্তু ইসলামি বিবাহের ক্ষেত্রে সাধারণত কনেকে বিয়ের আগে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে হয়, এমনটাই নিয়ম। সেই নিয়মকে অস্বীকার করা কোনও সময়েই মুখের কথা ছিল না। যেমন সহজ ছিল না ভিনধর্মে বিবাহের সিদ্ধান্ত নেওয়াও। কিন্তু সেই সিদ্ধান্ত নিয়েই অনায়াসে ঘর বেঁধেছিলেন দুই ধর্মের দু’জন মানুষ। ধর্মের তকমা সরিয়ে নিজেদের মানবতার পরিচয়টিকেই বড় করে তুলেছিলেন তাঁরা।

নজরুলের সঙ্গে তাঁর স্ত্রী প্রমীলা দেবীর পরিচয় হয়েছিল এক অদ্ভুত পরিস্থিতিতে। নজরুল সেখানে কলকাতা থেকে যাওয়া ‘বিয়ের বর’। তবে প্রমীলা নন, নার্গিস নামে এক কিশোরীর সঙ্গে নজরুলকে বিয়ে দিতে চেয়েছিলেন আলী আকবর খান নামে নজরুলের এক বন্ধু। উদ্দেশ্য ছিল নজরুলের যাবতীয় লেখালিখি প্রকাশ করার অধিকার পাওয়া। সেই সময়েই বন্ধু বীরেন্দ্রকুমার সেনগুপ্তের বাড়িতে নজরুলকে রেখেছিলেন আলী আকবর। বীরেন্দ্রকুমারের মা বিরজাসুন্দরী দেবীর অত্যন্ত স্নেহের হয়ে উঠেছিলেন নজরুল। কিন্তু আলী আকবরের উদ্দেশ্য ফাঁস হয়ে যাওয়ায় সেই বিয়ে ভেঙে যায়। তবে এই সূত্রে বীরেন্দ্রকুমারের পরিবার এবং প্রমীলার সঙ্গে বিশেষ সম্পর্ক গড়ে ওঠে নজরুলের।

বিয়ে ভাঙার মাস তিনেক পরে, ১৯২১ সালের অক্টোবর মাসে নজরুল আবার কান্দির পাড়ে বিরজাসুন্দরী দেবীর বা প্রমীলার বাড়িতে বেড়াতে আসেন। তারপর তিনি আবারও প্রমীলাদের বাড়িতে আসেন পরের বছর ১৯২২ সালের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে। প্রমীলার বয়স তখন ১৪ বছরের কাছাকাছি। একদিন তিনি প্রমীলাকে একটি কবিতা উপহার দেন যার প্রথম পংক্তি, ‘হে মোর রানী তোমার কাছে হার মানি আজ শেষে’। বোঝাই যায়, প্রমীলার প্রতি কবির মনের ভাব তখন কেমন ছিল।

কিন্তু নজরুলের এই বারবার যাওয়া আসাকে ভাল চোখে দেখেনি গোঁড়া হিন্দুদের একাংশ। এদিকে ‘ধূমকেতু’ পত্রিকায় ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ কবিতাটি লিখে গ্রেফতার হন নজরুল। এক বছরের সশ্রম কারাদণ্ড হয় তাঁর। অপেক্ষায় ছিলেন প্রমীলা।

অবশেষে ১৯২৪ সালের ২৫ এপ্রিল বিয়ের বাঁধনে বাঁধা পড়েন দু’জনে। হিন্দু সমাজ, এমনকী প্রমীলার পরিবার থেকেও বাধা এসেছিল। কিন্তু তাঁদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন প্রমীলার মা, গিরিবালা দেবী। ১৯২৪ সালের ১৭ মে গিরিবালা দেবী চিঠির মাধ্যমে পত্রিকায় খবর পাঠিয়েছিলেন, ১২ বৈশাখ নজরুল ও প্রমীলার বিয়ে সম্পন্ন হয়েছে। কিন্তু কন্যাকে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হইতে হয় নাই।

হ্যাঁ, বিয়ের পর নিজের পছন্দে স্ত্রীর একটি নাম রেখেছিলেন নজরুল। মাইকেল মধুসূদন দত্তের মেঘনাদবধ মহাকাব্যের অনুসরণে তিনি ‘আশালতা ওরফে দুলি’ নাম রেখেছিলেন প্রমীলার। কিন্তু স্ত্রীর ধর্ম পরিবর্তনের কথা ভাবেননি তিনি। ধর্মের তফাতকে তুচ্ছ করে পারস্পরিক সম্মান ও ভালবাসার বাঁধনেই একে অপরকে বেঁধেছিলেন তাঁরা।

নজরুল ছিলেন সাম্যবাদের একজন অগ্রদূত। তিনি তাঁর চার সন্তানের নাম হিন্দু এবং মুসলিম উভয় নামেই নামকরণ করেন। যেমন, কৃষ্ণ মুহাম্মদ, অরিন্দম খালেদ (বুলবুল), কাজী সব্যসাচী এবং কাজী অনিরুদ্ধ!

 

Related Articles