মা টেরিজা: সেবা কার্যের দ্বারাই হয়ে ওঠেন ‘বিশ্বজননী’
Mother Teresa: She became a 'Mother of the World' through her service

Truth Of Bengal:
‘হেথায় আর্য, হেথা অনার্য
হেথা দ্রাবিড়, চীন–
শক-হুন-দল পাঠান মোঘল
এক দেহে হল লীন।’
–রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ভারতবর্ষের মতো দেশে বিদেশিরা বার বার এসেছেন, এই দেশকে ভালবেসেছেন, বসবাস করেছেন এবং ভারতকে নিজের দেশ বলে মনে করেছেন। ভগিনী নিবেদিতা, ডিরোজিও এবং মাদার টেরিজা তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। এঁরা নিজেদের স্বার্থ ত্যাগ করে দেশের মানুষের কল্যাণের জন্য বার বার জীবন উৎসর্গ করেছেন। এ রকমই কর্মমুখর জীবনের উজ্জ্বল আলোকশিখায় দীপ্ত এক রমণী মাদার টেরিজা। তাঁর জীবনের পথটা খুব একটা সহজ-সরল ছিল না। এক সময় তাঁকে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের হাতে লাঞ্চিত এবং নিগৃহীত হতে হয়। তবে সাধারণ মানুষ তাঁর পাশে সব সময় থেকেছে।
প্রচণ্ড পরিশ্রমী এই রমণী হার মানতে জানতেন না কখনওই। অসম্ভব শব্দটিকে নিজের জীবনের অভিধান থেকে বাদ দিয়েছিলেন। কখনও অন্যায়ের সঙ্গে আপস করেননি। তাঁর কর্তব্যবোধ এবং ন্যায় পরায়ণতা ছিল অসাধারণ। জীবনের প্রায় প্রতিটি প্রহর পথের ধারে শুয়ে থাকা মানুষের কল্যাণে নিজেকে উৎসর্গ করেছেন। কাটিয়েছেন অসংখ্য ক্লান্তিহীন রাত। একটার পর একটা অনাথশ্রম স্থাপন করে এমন এক দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন যা বিশ্বের মানুষ আজও অনুসরণ এবং অনুকরণ করতে বাধ্য হয়। পৃথিবীর সমস্ত দেশের রাষ্ট্রনায়কদের সঙ্গে ছিল তাঁর ব্যক্তিগত সখ্যের সম্পর্ক। তাঁর প্রয়াণকে কেন্দ্র করে কলকাতায় সারা পৃথিবীর রাষ্ট্রনায়করা এসেছিলেন। কলকাতা শহরের বুকে যা ছিল ঐতিহাসিক ঘটনা।
ভারতবর্ষে জন্ম হয়নি তাঁর। জন্মেছিলেন সুদূর যুগোস্লোভিয়ার স্কপিও শহরে এক ধর্মপ্রাণ দম্পতির গৃহে। বাবা আদর করে নাম রেখেছিলেন অ্যাগনেস। বাবা-মা দু’জনেই ছিলেন অ্যালবেনিয়ান। বাবা ছিলেন সামান্য এক ব্যবসায়ী। তিনি দয়ালু, সৎ এবং দানশীল। সমাজের গরিব-দুঃখী মানুষের জন্য তিনি অকাতরে দান করতেন। বাবার এই গুণগুলি বাল্যকালেই অ্যাগনেসের মনে নিদারুন প্রভাব ফেলে। অন্যদিকে অ্যাগনেসের মা ছিলেন ধর্মভীরু। বাল্যকালে অ্যাগনেস তাঁর ধার্মিক মায়ের সংস্পর্শে থেকেই জীবনের নিয়মশৃঙ্খলা শিখেছিলেন। মায়ের মতোই ছোটবেলা থেকে ঈশ্বরকে ভালবাসতে শিখেছিলেন। আর শিখেছিলেন ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের ভালবাসতে।
বাল্যকাল থেকেই অ্যাগনেসের ছিল বই পড়ার বিরাট আগ্রহ। গির্জার লাইব্রেরিতে তিনি পড়ে নিয়েছিলেন বহু বই। ফলে অল্প বয়সেই তিনি প্রভূত জ্ঞানের অধিকারী হন। অল্প বয়স থেকেই তিনি নির্জনতা পছন্দ করতেন এবং বাইবেল ও সাধু-পুরুষদের জীবনী আগ্রহ নিয়ে পাঠ করতেন। স্থানীয় সরকারি স্কুলের পাঠ সমাপ্ত করে একসময় তিনি স্বদেশেই উচ্চশিক্ষা গ্রহণে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। এই সময়েই তিনি স্থানীয় ধর্ম সংগঠনের কাজে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত হয়ে পড়েন এবং এক বিশেষ সম্প্রদায়ের সেবামূলক কাজে আত্মনিয়োগ করেন। আঠারো বছর বয়সে অ্যাগনেস যুগোস্লোভিয়ার লোরেটোর মাদার সুপিরিয়রকে সন্ন্যাস ধর্ম গ্রহণ করার জন্য আবেদন করেন। আবেদনপত্রে তিনি নিজের পরিচয় দিয়ে লেখেন, ‘আমি হাই স্কুলের পঞ্চম শ্রেণি পাস করেছি। ভাষার মধ্যে আমি জানি আমার মাতৃভাষা আলবেনীয় এবং সার্বিয়া। কিছুটা ফরাসি জানি। কিন্তু ইংরেজি একদমই না। আশা করি দয়াময় প্রভু আমার ভাষা শিক্ষায় সাহায্য করবেন। তাই এখুনি ওই ভাষাটা শেখার জন্য নেমে পড়েছি।’
বিস্ময়ের ব্যাপার, কিছুদিনের মধ্যেই অ্যাগনেস ইংরেজি ভাষা রপ্ত করে ফেললেন। নিজের কর্মময় জীবনে অজস্র লেখা লিখেছিলেন এবং তার বেশিরভাগটাই ইংরেজিতে। মিশনারিদের মুখে অ্যাগনেস কলকাতার মানুষের দুঃখ-দারিদ্রের কথা শুনে মনস্থির করেন মানব সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করবেন। শেষ পর্যন্ত তিনি সেবার কাজে নিজেকে উৎসর্গ করার মহান সংকল্প নিয়ে তিনি সুদূর ভারতবর্ষে পাড়ি দিলেন।
১৯২৯ সালে কলকাতায় আসেন অ্যাগনেস। এইসময় তিনি এখানকার লোরেটো সংঘের কর্মী রূপে যোগ দেন। প্রথমে তিনি সেন্ট মার্গারেট স্কুলে ভূগোলের শিক্ষয়িত্রী হিসেবে এখানকার সকলের শ্রদ্ধা অর্জন করেন। এই সময় তাঁর উপর দায়িত্ব পড়ে ভারতীয় সন্ন্যাসিনীদের নিয়ে গড়া ‘ডটার্স অব সেন্ট অ্যান’-এর মেয়েদের পরিচালনার। তিনি তাঁদের নিয়ে কলকাতার পথে-ঘাটে, বস্তিতে দুঃস্থ-শীর্ণ মানুষদের সেবা কাজে নিরন্তর ব্যস্ত থাকতেন। এইসময় লক্ষ লক্ষ গরিব বস্তিবাসী মানুষের দুঃখ-দুর্দশা তাঁর কোমল হৃদয়কে গভীরভাবে নাড়িয়ে দিয়েছিল। ১৯৪৮ সালে তিনি ভারতবর্ষের নাগরিকত্ব গ্রহণ করেন। লোরেটোর পোশাক ত্যাগ করে পড়লেন ভারতীয় নারীর পোশাক। নীলপাড় সাদা সুতির শাড়ি। বাম কাঁধে পবিত্র ক্রুশ। ‘অ্যাগনেস’ হয়ে উঠলেন সন্ন্যাসিনী ‘টেরেসা’। চোখে মুখে ফুটে উঠল সেবকার্যের ব্যাকুলতা।
১৯৫০ সালে বারো জন সন্ন্যাসিনীকে সঙ্গী করে মাত্র পাঁচ টাকা সম্বল করে তৈরি করলেন ‘মিশনারিজ অব চ্যারিটিজ’। এই সংস্থাটির বহু শাখা-প্রশাখা বিভিন্ন নামে ছড়িয়ে রয়েছে বিভিন্ন স্থানে। যেমন- কালীঘাটের ‘নির্মল হৃদয়’, মৌলালির ‘শিশুভবন’, সোদপুরের ‘প্রেমনিবাস কুষ্ঠাশ্রম’ এবং দমদমের ‘নির্মলা কেনেডি সেন্টার’। মূলত কলকাতা ও পার্শবর্তী অঞ্চল তাঁর কর্মসাধনপীঠ হলেও ভারতের অন্যত্র ও বহির্বিশ্বেও মা টেরেসার কর্মক্ষেত্র বিস্তারলাভ করেছে। জাত-ধর্মের ঊর্ধ্বে অজস্র অসহায় মানুষকে তিনি যেভাবে তাঁর স্নেহনীড়ে সযত্নে আশ্রয় দিয়েছিলেন তা সত্যই বিস্ময়কর।
সেবা কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ সময় সময়ে বহু সম্মানে ভূষিতা হয়েছেন মাদার টেরেসা। পেয়েছেন বহু পুরস্কার। ভারত সরকার তাঁকে দিয়েছেন ‘পদ্মশ্রী’ খেতাব। ফিলিপাইনসে পান ‘ম্যাগসাইসাই’ পুরস্কার। এছাড়া পান পোপের শান্তি পুরস্কার, কেনেডি আন্তর্জাতিক পুরস্কার। ১৯৭৯ সালে তিনি পান বিশ্বের শ্রেষ্ঠ সম্মান ‘নোবেল পুরস্কার’ এবং ১৯৮০ সালে ‘ভারতরত্ন’ ও বিশ্বভারতীর ‘দেশিকোত্তম’ উপাধি।
আমাদের কাছে মাদার টেরেসা শুধু শ্রদ্ধার পাত্রী নন। তিনি আমাদের কাছে এক বিস্ময়। সারা পৃথিবী যখন ছুটে চলেছে স্বার্থের সংকীর্ণতার মধ্যে, তখন মাদার টেরেসা, সর্বশক্তি দিয়ে মানবতার বাণীকে সকলের ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছেন। টেরেসার গভীর বিশ্বাস ছিল যিশুখ্রিস্টের কৃপার ওপর। তবু সর্বধর্মের মানুষের প্রতি তাঁর ছিল অপরিসীম মমতা ও সহানুভূতি। সেবার মধ্যে দিয়েই তিনি জীবনের অর্থ খুঁজে পেয়েছিলেন। গভীর মানবতাবোধ থেকেই তিনি আত্মত্যাগের শান্তি লাভ করেছিলেন। ১৯৯৭ সালের ৫ সেপ্টেম্বর এই মহিয়সী নারীর মহাপ্রয়াণ ঘটে। আদর্শের ঔজ্জ্বল্যে, কর্মদক্ষতার সুচারুতায় মা টেরেসার অধিষ্ঠান আজ সকলের অন্তরের অন্তঃস্থলে। ভালোবাসার ব্রত নিয়ে যে নারী সুখের নীড় ত্যাগ করে অনিশ্চিতের পথে যাত্রা করেছিলেন, সেই মাদার টেরেসা সমানভাবে বিশ্বাস করতেন মানব ভালবাসাতেই মানুষের মুক্তি।