এডিএইচডি: একটি ভিন্ন মানসিক বিকাশের চিত্র
ADHD: A picture of a different mental development

মনোবিদ অনন্যা ভট্টাচার্য: এডিএইচডি বা Attention Deficit Hyperactivity Disorder একটি স্নায়ুবিক বিকাশজনিত অবস্থা, যা ব্যক্তির মনোযোগ, আচরণ নিয়ন্ত্রণ এবং আবেগ নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতাকে প্রভাবিত করে। অনেক সময় একে রোগ বলা হলেও, একে নিছক ‘রোগ’ বললে এর জটিলতা ও প্রয়োজনীয় সহানুভূতির ঘাটতি দেখা দিতে পারে। এটি মূলত শিশুদের মধ্যে দেখা গেলেও প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যেও থাকতে পারে বা বয়ঃপ্রাপ্তির পর প্রথম প্রকাশ পেতে পারে।
ADHD কী ধরনের অবস্থা?
এডিএইচডি এমন একটি অবস্থা যা শিশুদের মধ্যে সাধারণত ৩-৭ বছর বয়সে প্রথম চিহ্নিত হয়। এটি স্নায়ুবিক কার্যক্রমের এক ধরনের ব্যতিক্রম। শিশু বা প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি দীর্ঘ সময় মনোযোগ ধরে রাখতে পারেন না, অস্থির বোধ করেন এবং আচরণগত সমস্যা প্রদর্শন করতে পারেন।
কেবল শিশুদেরই হয়, না কি প্রাপ্তবয়স্করাও আক্রান্ত হতে পারেন?
একটি সাধারণ ভুল ধারণা হলো ADHD শুধুমাত্র শিশুদের হয়। প্রকৃতপক্ষে, শিশুকালে শুরু হলেও অনেক ক্ষেত্রেই এটি বড় হওয়ার পরও থাকে, আবার কারও ক্ষেত্রে প্রাপ্তবয়স্ক বয়সে গিয়ে লক্ষণ প্রকট হয়ে ওঠে এবং তখনই সঠিকভাবে ধরা পড়ে। তাই ADHD শুধুমাত্র শিশুরাই নয়, বড়রাও আক্রান্ত হতে পারেন।
শিশুদের ক্ষেত্রে ADHD-এর লক্ষণ কী কী?
শিশুদের মধ্যে ADHD-এর প্রধান তিনটি লক্ষণ হল–
১. মনোযোগের ঘাটতি-– পড়ালেখা বা কোনও কাজে দীর্ঘ সময় মনোযোগ ধরে রাখতে না পারা।
২. অতিরিক্ত চঞ্চলতা (Hyperactivity)-– এক জায়গায় স্থির হয়ে বসতে না পারা, ঘন ঘন নড়াচড়া।
৩. আচরণে তাড়াহুড়ো (Impulsivity)-– চিন্তা না করে কাজ করা বা কথা বলা।
স্কুলে ADHD আক্রান্ত শিশুদের আচরণ কেমন হয়?
স্কুলে এদের আচরণ প্রায়ই নিয়মভঙ্গের মতো মনে হয়। শিক্ষকরা বুঝে উঠতে পারেন না যে এটা অভ্যাসগত নয় বরং মানসিক অবস্থা। তারা পড়ার সময় ঘন ঘন মনোযোগ হারায়, প্রশ্নের উত্তর দেয় অপ্রস্তুতভাবে, নিয়ম মানতে কষ্ট হয়, বন্ধুদের সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ে। ফলাফলস্বরূপ, তাদের পড়াশোনায় পিছিয়ে পড়া, আত্মবিশ্বাস হ্রাস এবং মানসিক চাপ বৃদ্ধি পায়।
প্রাপ্তবয়স্ক ADHD কী?
প্রাপ্তবয়স্কদের ADHD-এর লক্ষণগুলো কিছুটা ভিন্ন। চঞ্চলতা কমে গেলেও মনোযোগের ঘাটতি, কাজের পরিকল্পনায় সমস্যা, সময় ব্যবস্থাপনায় দুর্বলতা, এবং আবেগ নিয়ন্ত্রণে অসুবিধা স্পষ্ট থাকে।
প্রাপ্তবয়স্ক ADHD-এর লক্ষণ কী কী?
১. কাজ শুরু করে শেষ করতে না পারা
২. সময়মতো কাজ না করতে পারা
৩. অতিরিক্ত ভুল হওয়া
৪. সামান্য কারণে মেজাজ খারাপ হওয়া
৫. সম্পর্ক ও অফিসে সমস্যা হওয়া
৬. চিন্তা বা কথার মধ্যে লজিক্যাল ধারা বজায় না রাখা
কর্মক্ষেত্রে ADHD কী কী অসুবিধা সৃষ্টি করতে পারে?
১· নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ করতে না পারা
২· একাধিক কাজ সামাল দিতে না পারা
৩· সহকর্মীদের সঙ্গে সমন্বয় করতে না পারা
৪· সহজে মনোযোগ হারানো
৫· ছোটখাটো ভুল হওয়া
৬· মিটিং বা দায়িত্ব ভুলে যাওয়া
ADHD কোন কোন রোগের সঙ্গে সহ-অবস্থান (Comorbidity) করতে পারে?
১· ডিপ্রেশন বা বিষণ্নতা
২· অ্যাংজাইটি বা উদ্বেগজনিত রোগ
৩· শেখার অসুবিধা (Learning Disability)
৪· আচরণগত সমস্যা যেমন ODD (Oppositional Defiant Disorder)
৫· আসক্তিজনিত সমস্যা (Substance Use Disorders)
কো মর্বিডিটি অবস্থায় লক্ষণগুলো আরও জটিল হয়ে ওঠে, তবে সঠিক চিকিৎসা ও সহানুভূতিশীল ব্যবস্থাপনায় উন্নতি সম্ভব।
এডিএইচডি কি পুরোপুরি নিরাময়যোগ্য?
এডিএইচডি পুরোপুরি সারানো সম্ভব না হলেও, এটি নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। মূলত দীর্ঘমেয়াদি ব্যবস্থাপনা, ওষুধ এবং থেরাপির মাধ্যমে ADHD-এর প্রভাব অনেকটাই কমানো যায়।
চিকিৎসা অন্তর্ভুক্ত করে–
১· Stimulant ও non-stimulant ওষুধ
২· Behavioral therapy (বিশেষত শিশুদের জন্য)
৩· CBT (Cognitive Behavioral Therapy) – প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য কার্যকর।
স্কুলে ADHD শিশুদের সঙ্গে কেমন আচরণ করা উচিত?
১· ধৈর্য সহকারে বোঝা
২· নিয়মিত রুটিন তৈরি করা
৩· ক্লাসে বসার সঠিক জায়গা নির্ধারণ করা
৪· দায়িত্বে ছোট ছোট অংশ ভাগ করে দেওয়া
৫· ইতিবাচক প্রশংসা ও পুরস্কার প্রয়োগ করা
অফিসে ADHD আক্রান্ত প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য উপযুক্ত কৌশল কী?
১· লিখিত To-do list ও সময়সূচি ব্যবহার
২· অপ্রয়োজনীয় distraction কমানো
৩· বড় কাজগুলোকে ছোট ছোট অংশে ভাগ করে নেওয়া
৪· নির্ধারিত বিরতি নেওয়া
৫· সহায়ক প্রযুক্তি ব্যবহার (জানালার apps বা রিমাইন্ডার)
৬· প্রয়োজনে কাউন্সেলিং গ্রহণ
বাড়িতে ADHD শিশুর প্রতি মনোভাব কেমন হওয়া উচিত?
১· ভালোভাবে শুনে বোঝা
২· রাগ বা শাস্তির বদলে বোঝানোর পদ্ধতি
৩· ঘরের নিয়ম সহজভাবে নির্ধারণ করা
৪· খেলাধুলা, ঘুম, খাওয়া— সবকিছুতেই নিয়ম
৫· শিশুর ছোট ছোট সাফল্য উদযাপন করা
৬· বাবা-মার ADHD বিষয়ক প্রশিক্ষণ নেওয়া
ADHD আক্রান্তদের সামাজিক অন্তর্ভুক্তি কেমন হওয়া উচিত?
সমাজকে বোঝা উচিত ADHD মানে ‘অযোগ্যতা’ নয়।
১· স্কুলে ইনক্লুসিভ শিক্ষা
২· কর্মক্ষেত্রে সহায়ক পরিবেশ
৩· বন্ধু ও আত্মীয়দের সমর্থন
৪· আত্মবিশ্বাস গড়ে তুলতে সাহায্য করা
৫· ADHD সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ানো
ADHD একটি সাধারণ কিন্তু ভুল বোঝাবুঝিতে পরিপূর্ণ অবস্থা। যথাযথ চিকিৎসা, সহানুভূতিশীল মনোভাব এবং সামাজিক সহায়তা ADHD আক্রান্ত ব্যক্তি বা শিশুকে সার্থক, স্বাধীন এবং সফল জীবন গঠনে সহায়তা করতে পারে।