বিনোদন

এখানকার রুটি-তড়কার টানে ছুটে গিয়েছিলেন উত্তম-সুচিত্রা, তারপর যা ঘটল……

Uttam and Suchitra had rushed here, attracted by the taste of bread and crackers, and what happened next...

Truth Of Bengal: ইন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়: স্বাধীনতার ঠিক পর-পরই হবে, সালটা ১৯৫০-৬০-এর মধ্যে। নদিয়ার বিরহী গ্রামে মুষ্টিমেয় মানুষের বসবাস। অবশ্য খুব প্রাচীন এলাকা। বয়ে গিয়েছে যমুনা। যমুনার ধারে মদন গোপালের মন্দির। বাজার বলতে দু’একটি চায়ের দোকান, একটা জামা-কাপড়ের দোকান, সবেধন নীলমণি একটি মুদি দোকান।

হ্যারিকেন অথবা মোমবাতি ভরসা। সন্ধ্যে হতে না হতেই ঝাঁপ বন্ধ। বিরহীর বুক চিরে যাওয়া কলকাতা-বহরমপুর ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়ক দিয়ে গাড়ির বিরাম নেই। বর্তমানে যা ১২ নম্বর জাতীয় সড়ক। দুপাশে ধূধূ করছে মাঠের পর মাঠ। জনপদহীন এহেন পরিবেশে রাতের ঘন আঁধারে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক আর জোনাকির আলো। মাঠের মাঝখান থেকে ভেসে আসা শিয়ালের হুক্কা হুয়া ডাক, গাছের আড়ালে অন্ধকারের বুক চিরে উঁকি দিচ্ছে হুতুম পেঁচার জ্বলজ্বলে চোখ।

বিরহী গ্রামের এহেন পরিবেশের মধ্যেই ভিনরাজ্য উত্তরপ্রদেশ থেকে আসা কিছু মানুষ মাথা গোঁজার ঠাঁই করে নিয়েছিলেন। বাংলায় তাঁরা রুজি-রুটির খোঁজে এসে আর ফিরে যাননি, স্থায়ীভাবে তাঁরা বসবাস শুরু করেন। ভিন রাজ্যের ছবিলা চৌধুরী, হংসনাথ চৌধুরী, কুবের চৌধুরী, বিরছা চৌধুরী, জোটেলাল চৌধুরী নিজেদের জীবন-জীবিকার স্বার্থে গরু-মোষ পালনের পাশাপাশি শুরু করেন হোটেল ব্যবসা।

জাতীয়, সড়কের গা-ঘেঁষে সারি সারি চটি হোটেল। হোটেলে ভিড় জমাতো রাস্তা দিয়ে যাতায়াত করা লরির ড্রাইভাররা। হ্যাজাকের আলো আর কয়েকটা পাতা খাটিয়া, তাই দিয়েই চলতো সারারাত ব্যবসা। খাওয়া-দাওয়ার পর চালকরা খাটিয়াতে বিশ্রামও নিতেন। মাছ, মাংস ভাত, তরকারি, রুটি সবই মিলতো। কিন্তু স্পেশাল মেনু তড়কা। এখানকার সুস্বাদু তড়কার নাম বাংলা জোড়া।

তড়কার উৎপত্তি পঞ্জাবে হলেও উত্তর প্রদেশের এই নাগরিকদের হাতের তৈরি তড়কার স্বাদ কম কিছু ছিলনা। গরম রুটির সঙ্গে তড়কা, সঙ্গে কাঁচা পেঁয়াজ, কাঁচা লঙ্কা আর আচার, খাদ্যরসিকদের ভোজন করার আগেই এহেন সুস্বাদু মুখরোচক খাবারের গন্ধ জিভে জল আনবে সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। অতীতে বিরহীর এই রাস্তার ওপর দিয়ে আসা যাওয়ার পথে এই তড়কার স্বাদ গ্রহন করে তৃপ্তিলাভ করেছেন বহু বিখাত মানুষ।

এসব বিখ্যাত মানুষদের মধ্যে যে নাম প্রথমেই উঠে আসে তাঁরা হলেন মহানায়ক উত্তম কুমার ও সুচিত্রা সেন। এছাড়াও অভিনেতা রবি ঘোষ, সঙ্গীত শিল্পী অমৃক সিং অরোরা, যাত্রাজগতের প্রখ্যাত অভিনেতা শেখর গাঙ্গুলীর মতো বিশিষ্ট বহু মানুষও এখানকার এই সুস্বাদু তড়কা খেয়ে আপ্লুত হয়েছিলেন। উত্তম-সুচিত্রাকে নিয়ে অনেক গল্প মুখে মুখে ছড়িয়ে ছিল সেই সময়।

লোকমুখে শোনা যায়, উত্তরবঙ্গ থেকে শ্যুটিং সেরে ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়ক ধরে কলকাতায় ফিরছিলেন বাংলা চলচ্চিত্রের এই কিংবদন্তি জুটি। বহু রাস্তার ধকলে খিদে পেয়ে গিয়েছিল তাঁদের। কিন্তু রাস্তার দু’ধারে মনের মত একটিও হোটেল খুঁজে পাচ্ছিলেন না। কলকাতা তখনও ঢের দূরে।

অগত্যা অন্ধকারে ঢাকা নাম-গোত্রহীন এক অজ পাড়াগাঁয়ে গাড়ি থেকে নামলেন ছোট্ট একটা হোটেল দেখে। অর্ডার করলেন রুটি তড়কা। এদিকে হোটেলের একজন কর্মী তাদের দেখে অবাক! ওই নিশুতি রাতেও খবরটা ঝড়ের গতিতে যেন ছড়িয়ে গেল।

ওই গভীর রাতেও অনেকেই হ্যারিকেন জ্বালিয়ে ছুটে এসেছিলেন স্বপ্নের নায়ক-নায়িকাকে দেখেবার জন্য! শোনা যায় এখানকার রুটি-তড়কা খেয়ে আপ্লুত হয়ে উঠেছিলেন উত্তম-সুচিত্রা। পরবর্তীতে এই জাতীয় সড়ক ধরে যখন তাঁরা যাতায়াত করতেন এই তড়কার টানে নাকি গাড়ি থেকে নামতেন বিরহীতে।

কালো দেশি কলাই-এর ডাল, কাঁচা ডালডা দিয়ে তৈরি অপূর্ব স্বাদের এই তড়কার তুলনা হয়না। যাঁদের হাতের পরশে এর সৃষ্টি হল সেইসব মানুষগুলো আর বেঁচে নেই। বেঁচে আছে সুস্বাদু তড়কা প্রস্তুতির অনেক গল্প। ভিআইপি ক্রেতাদের উপস্থিতি। চেনা, অচেনা অনেক ছবি, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে হারিয়ে গিয়েছে অনেক কিছু। অনেক স্মৃতি, সবটাই হারানো গল্প, সবটাই অতীত।

তাছাড়া ভিন রাজ্যের মানুষদের গড়ে তোলা সেইসব হোটেলগুলো অনেক আগেই বন্ধ হয়ে গিয়েছে। নতুন নতুন অনেক হোটেল গড়ে উঠেছে জাতীয় সড়কের পাশে। আগের মতো খাটিয়াপাতা চটি হোটেল নয়, বেশ সাজানো, গোছানো, আধুনিকতার ছোঁয়ায় পরিপূর্ণতা পেয়েছে। জনবসতি বেড়েছে, রূপ পেয়েছে শহরের। ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়ক ১২ নম্বর হয়েছে। আরও চওড়া হয়েছে। রোডের দুপাশে পথবাতি বসেছে। রাতের বিরহী হয়ে উঠেছে মায়াবী।

এখন রাতও দিনের আলোর মত পরিষ্কার। আগের মতো রাতে শিয়ালের ডাক নেই, না আছে ঝিঁঝি পোকার শব্দ। তবে আগের মতোই জাতীয় সড়কে সারিবদ্ধ হয়ে ট্রাকের যাতায়াত, গাড়ির সংখ্যা বেড়েছে। ভিনরাজ্যের বাসিন্দারা যাঁরা হোটেল ব্যবসা শুরু করেছিলেন তাঁরা কেউ বেঁচে নেই।

তাঁদের সন্তান-সন্ততিরা এখন এখানকার বাসিন্দা। তবে অন্য পেশায়। সবকিছু অতীত হলেও সেইসব মানুষদের সৃষ্টি সুস্বাদু তড়কার নাম আজও আছে মুখে মুখে। স্মৃতির মনিকোঠায় জুড়ে রয়েছে মহানায়ক উত্তম কুমারের নাম, আছেন সুচিত্রা সেন। বিরহী র সঙ্গে তাঁরা মিশে রয়েছেন।

Related Articles