সম্পাদকীয়

বিজেপির অন্দরে আরও বাড়বে গৃহযুদ্ধ

The civil war within the BJP will increase further

ইন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় (প্রাবন্ধিক): বঙ্গ বিজেপির অভ্যন্তরে এখন ঝড় বইছে। দিল্লি নেতৃত্বের কাছেও সেই ঝড় ধাক্কা মারছে। একেবারে তোলপাড় বঙ্গ রাজনীতি। নায়ক দিলীপ ঘোষ। বঙ্গ বিজেপির নেতৃত্বের অভিযোগ, তিনি কেন দিঘার জগন্নাথ মন্দিরের উদ্বোধনে গেলেন? শুধু গেলেন না, সস্ত্রীক মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে সময় কাটালেন। দু’জনের ভাল-মন্দ কথা বিনিময় হল।

এতেই ভুইফোড় বিজেপি নেতৃত্বের পেটে ব্যথা শুরু। তাঁকে বিধানসভার বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী ও তাঁর অনুগামীরা, বিষ্ণুপুরের সাংসদ সৌমিত্র খাঁ, ব্যারাকপুরে প্রাক্তন সাংসদ অর্জুন সিং-এর মতো নেতারা একের পর এক ঢিপ্পনি করে যাচ্ছেন। কিন্তু তাঁর অপরাধটা কোথায়? তিনি তো তৃণমূল বা অন্য কোনও দলের রাজনৈতিক সম্মেলনে যাননি, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর ডাকে সাড়া দিয়ে একটি উন্নয়নমূলক ভাল কাজের শরিক হয়েছেন মাত্র। সত্যি কথা বলতে কী এটাকে তো রাজনীতির সঙ্গে গুলিয়ে ফেললে হবে না।

ওড়িশার পুরীতে এই বাংলা থেকে মানুষ যান বেড়াতে। মনের খিদে মেটাতে। প্রতিবছর লক্ষ লক্ষ মানুষ পুণ্যার্জনের জন্য পুরীর জগন্নাথ দেবের মন্দিরে পুজা দিতে যান। আর বাঙালি পর্যটকদের জন্য সেখানকার মানুষের অর্থনীতি অনেকটাই বদলে গিয়েছে। রাজস্ব মিলছে সরকারের। পুরীর ব্যবসায়ী থেকে সাধারণ মানুষ এটা স্বীকার করতে বাধ্য যে, বাংলার মানুষ তাঁদের আর্থিক ভাবে লাভবান করে চলেছে। পুরীতে যেমন রয়েছে সমুদ্র, সঙ্গে জগন্নাথদেবের মন্দির– ভ্রমণ পিপাসু মানুষকে আকর্ষিত করে। ঠিক তেমনই দিঘার এই জগন্নাথ দেবের মন্দির এক নতুন ইতিহাসের জন্ম দিল।

বাংলার পর্যটনে শুধু নতুন মাত্রা নয়, মানুষের জীবন যাত্রার মান, কর্মসংস্থানের মান বৃদ্ধি আরও শীর্ষে নিয়ে গেল। এক নতুন ইতিহাস সৃষ্টি হল বাংলার পর্যটন শিল্পের। পাশাপাশি সরকারি কোষাগারও পরিপূর্ণতা পাবে এই সহজ কথাটা বোঝেন দিলীপ ঘোষ। আর বাকিদের মতো তিনি মাথা মোটা নন। তবে মৌচাকে ঢিল মারলে মৌমাছির হুলের যন্ত্রণা সহ্য তো করতে হবেই। এখন দিলীপবাবুর কথাগুলো তো তেতো লাগবেই। পাঁচিলে বসে থাকা ওই নেতাদের (শুভেন্দু অধিকারী, সৌমিত্র খাঁ, অর্জুন সিং) মতো নেতারা শুধু নিজেদের কথা ভাবেন, মানুষের কথা নয়। প্রকৃত অর্থে যাঁরা রাজনীতি করেন তাঁদের একটা আদর্শ থাকে। দল জিতলেও থাকেন, হারলেও থাকেন, গর্বও করেন

নদীতে জোয়ারও থাকে, আবার ভাঁটাও হয়। নদীর এপার ভাঙে, ওপার গড়ে। কেউই অজেয় নয়। আর ওঁরা পাঁচিলে বসে দু’পাশে দেখেন, প্রয়োজনে ঝাঁপ মারার জন্য। শুভেন্দু অধিকারী ও তাঁর পরিবারবার তৃণমূল কংগ্রেসে থেকে সুখ ভোগ করেছেন, রাজনীতিতে পরিবারতন্ত্রের জন্ম দিয়েছেন। রাজা-বাদশার মতো চলেছেন। শুধুমাত্র নিজের স্বার্থে আরও বেশি কিছু পাওয়ার আশায় বিজেপি দলে যোগ দিয়েছেন। হয়তো অনেক কিছু পেয়েছেনও, তাই তাতে মানুষের কোনও লাভ হয়নি। তিনি এখন সব সময় কেন্দ্রীয় বাহিনীর ঘেরাটোপে থাকেন, মানুষের সঙ্গে নয়।

২০১৯ সালে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে শুভেন্দু অধিকারী ও তাঁর বাবা শিশির অধিকারী দিঘার জগন্নাথ মন্দিরের শিলান্যাস অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। আজ বিরোধী দলনেতা হয়ে মন্দিরের বিরোধিতা করছেন। এহেন দ্বিচারিতা কেন? প্রশ্ন তো উঠবেই। আর এই প্রশ্ন বিরোধীদের নয়, তাঁর দলেরই নেতার, তবে এ ডাল, ও ডাল করা কোনও নেতা নয়। সৌমিত্র খাঁ তিনিও তৃণমূল কংগ্রেসের ছত্রছায়ায় অনেক সুখভোগ করেছেন, আর অর্জুন সিং, তিনি নির্বাচনে টিকিট না পেলেই ঘণ্টায় ঘণ্টায় এ দল, ও দল করেন।

মানুষ তো তাঁকে জানেই, তাঁর বিষয়ে সহজ এই খাঁটি কথাটা দিলীপবাবুই বলেছেন। দিলীপবাবু তাঁর বাক্যবাণে এহেন নেতাদের যেভাবে বিধ্বস্ত করেছেন, এরপর এঁদের মুখে কুলুপ আঁটা ছাড়া কোনও গতি থাকবে না। এতো কেঁচো খুড়তে গিয়ে সাপ বেরনোর মতো অবস্থা। দিলীপবাবুর রাগ হওয়ারই কথা, তারই দৌলতে সাজানো ঘর, পাতা উনুন, আর সেখানে মাতব্বরি করছেন ওই নেতারা। ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে তাঁর নেতৃত্বেই বিজেপি ১৮ আসনে জিতেছিল। আর ২০২৪ সালে ১৮ থেকে কমে হয়েছে ১২। নতুন নেতাদের উপর ভরসা করে অনেকটাই ডুবতে হয়েছে বিজেপিতে। তারপরও পুরনো নেতারা নানাভাবে টিপ্পনির শিকার হচ্ছেন। ঠিক সেই সময় দিলীপ ঘোষের বাক্যবাণ! মুখ্যমন্ত্রীর আহ্বানে সাড়া দিয়ে দিঘার জগন্নাথ মন্দিরের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়া। বিজেপির অন্দরে কার্যত গৃহযুদ্ধের আরও বড় সূচনা হয়ে গেল।

Related Articles