লোকশিল্পের বদলে যাওয়া দৃশ্যপট: মাটির সংস্কৃতি এখন ডিজিটালের ছোঁয়ায়
The changing landscape of folk art: Earthen culture is now under the digital touch

Truth of Bengal:মনিরুল ইসলাম, পূর্ব বর্ধমান: গ্রাম্য মাটির ঘ্রাণে মোড়া শিল্পে রাত্রির নিস্তব্ধতা চিরে, তাল-মাদলের তালে জেগে উঠত গ্রামের মাঠঘাট। আলোর অভাবে অন্তরে ফুটে উঠত গম্ভীরা, বহুরূপী, পটচিত্র, ছৌ, আলকাপ ইত্যাদি। শিল্প তখন কেবল বিনোদন নয়—লোকজ জীবনের প্রতিচ্ছবি, ধর্ম, প্রতিবাদ, প্রেম ও প্রকৃতির নিঃশব্দ ভাষা ছিল। কিন্তু সময় বদলেছে। বদলে গেছে গ্রাম, বদলেছে মানুষ, আর বদলে গেছে লোকশিল্পের মুখও। নব-প্রযুক্তির আলোয় লোকজ ধারার রূপান্তরে আজ মাদলের জায়গা নিয়েছে মিক্সার, ঢোলের সুর বদলে গেছে ডিজিটাল বিটে। পটচিত্র আর কেবল চটের কাপড়ে নয়—প্রিন্ট হয়ে আসছে টি-শার্ট, পোস্টার, ওয়েবসাইটে। আজও দেখা যায় অনেক গ্রাম বাংলায় লোকশিল্পী রয়েছে সেই সমস্ত শিল্পীরা কেমন রয়েছে দেখতে হাজির হলেন রাজ্যের প্রাণিসম্পদ দপ্তরের মন্ত্রী স্বপন দেবনাথ সঙ্গে ছিলেন কাটোয়ার তৃণমূল কংগ্রেসের নেতা অরিন্দম বন্দ্যোপাধ্যায় এছাড়াও বহু কাটোয়া এলাকার মানুষজন বহুরূপীর মুখোশ আজ ইউটিউবে ভাইরাল। ছৌ-নৃত্য এখন ফেসবুক লাইভে, দর্শক ছড়িয়ে পড়েছে দিল্লি, মুম্বই, এমনকি বিদেশেও।
লোক সংস্কৃতির অভিব্যক্তি নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের ইতিহাস এবং রীতিনীতির মধ্যে নিহিত। এর মধ্যে রয়েছে সঙ্গীত, নৃত্য, থিয়েটার, মৌখিক ঐতিহ্য, কারুশিল্প, অনুষ্ঠান এবং উৎসব, যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে মৌখিকভাবে হস্তান্তরিত হয়েছে। ভারতে লোকশিল্প নিছক বিনোদন নয়; এটি বিভিন্ন সম্প্রদায়ের জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। লোকশিল্প জ্ঞান, মূল্যবোধ এবং ইতিহাস বহন করে যা অন্যথায় লিখিত আকারে নথিবদ্ধ করা যায় না।
সমাজের অগ্রগতির সাথে সাথে আধুনিকীকরণ এবং প্রযুক্তিগত অগ্রগতির চ্যালেঞ্জগুলি প্রায়শই এই শিল্প ফর্মগুলির অবহেলা এবং পতনের দিকে পরিচালিত করে। যাইহোক, লোকজ এবং ঐতিহ্যবাহী মাধ্যম আমাদের সাংস্কৃতিক অতীতকে বোঝার এবং আমাদের ভবিষ্যতকে টিকিয়ে রাখার জন্য একটি সেতু হিসাবে কাজ করে। তারা সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য, সৃজনশীলতা এবং পরিচয় প্রচার করে, তাদের সংরক্ষণ এবং পুনর্জাগরণে বিনিয়োগ করাকে গুরুত্বপূর্ণ করে তোলে।
লোকশিল্প কেবল শিল্পচর্চা নয়, বরং একটি জাতির আত্মপরিচয়, সংস্কৃতির শরীরী ভাষা। বাংলার লোকশিল্প—যেমন পটচিত্র, বহুরূপী, গম্ভীরা, আলকাপ, রায়বেঁশে, ছৌ, বাউল গান ইত্যাদি—অনাদিকাল থেকে এক বিশেষ সাংস্কৃতিক বলয়ের অন্তর্গত। এই শিল্পগুলি একদিকে যেমন ধর্মীয়, সামাজিক, রাজনৈতিক বার্তা বহন করেছে; তেমনি অন্যদিকে তা গ্রামীণ জীবনের আত্মিক-নান্দনিক প্রকাশও ছিল।
কিন্তু বিগত কয়েক দশকে প্রযুক্তি, নগরায়ন ও গণমাধ্যমের প্রভাবে বাংলার লোকশিল্পে এসেছে দৃশ্যমান রূপান্তর। এই রূপান্তর কখনও সৃজনশীল, কখনও সংকটজনক। এই পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে লোকশিল্পের বর্তমান রূপ, তার অন্তর্নিহিত সমস্যা, সম্ভাবনা ও ভবিষ্যতের দিক নিয়ে আলোচনা করা খুবই প্রয়োজনীয় এবং গুরুত্বপূর্ণ।
এই রূপান্তর কি কেবল উন্নয়ন? নাকি কোথাও হারিয়ে যাচ্ছে লোকজ আত্মা? বীরভূমের এক রায়বেঁশে শিল্পী বললেন— “আগে মানুষ ডাকতো পুজোয়, বিয়েতে। এখন ভিডিও করতে বলে, বলে ‘অনলাইন চালাও’। পেট চলে, তবু প্রাণ কোথায় যেন কমে যাচ্ছে।” লোকশিল্প আজ বাণিজ্যের পথে। শহরের গ্যালারিতে লোকশিল্পের প্রদর্শনী হয়, কিন্তু শিল্পীর গ্রামে নেই ঠিকঠাক বিদ্যুৎ পরিষেবা বা ভালো রাস্তা। এই বৈপরীত্যের মধ্যেই টিকে থাকার লড়াই।
লোকশিল্পের ভিত্তি ছিল মৌখিক এবং পারম্পরিক। শিল্পীরা গুরু-শিষ্য পরম্পরায় রপ্ত করতেন শিল্পচর্চা। এটি ছিল এক প্রকার জীবিত ঐতিহ্য। যেমন—পটুয়ারা পটচিত্র আঁকতেন এবং সেই চিত্রের উপর ভিত্তি করে গাইতেন ‘পট গান’। একসময়ে পটচিত্র ছিল পুরুষ পটুয়াদের সম্পত্তি। এখন সেই কলম ধরেছেন নারীরাও। পশ্চিম মেদিনীপুরের এক মহিলা পটুয়া বললেন— “আমার মা শুধু পট আঁকতেন, আমি মোবাইলে তা রেকর্ড করি। ইনস্টাগ্রামে দিই। মানুষ দেখে, ভালোবাসে। কিন্তু কেউ জানে না—আমরা কতটা টিকিয়ে রাখতে চাই এই শিকড়।” ছৌ নৃত্যে ব্যবহৃত মুখোশ তৈরি হতো স্থানীয় কাঠ বা মাটির দ্বারা। যা কালের নিয়মে পরিবর্তিত হয়ে প্লাসটিক হয়ে উঠেছে। তৎকালীন সমাজে শিল্পী ছিলেন সংস্কৃতির বাহক ও সামাজিক বার্তাবাহক—তাঁদের অবস্থান ছিল সম্মানজনক, যদিও অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল।
সংস্কৃতির টানাপোড়েনে নতুন কালের তরঙ্গে পুরাতন ভেসে যায়, আবার সে নিজেই খুঁজে ফেরে নতুন জীবনের ঠিকানা। লোকশিল্প আজ হাইব্রিড—একপায়ে মাটি, অন্যপায়ে ডিজিটাল মঞ্চ। লোকগানে প্রবেশ করেছে র্যাপ, আলকাপে এসেছে রাজনীতির ভাষ্য। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের লোকউৎসব কিংবা ডিজিটাল আর্কাইভে কিছুটা আশার আলো পাওয়া যায়, তবু তা কি যথেষ্ট?
বর্তমানে আমরা এক ‘ডিজিটাল যুগে’ প্রবেশ করেছি। ফলে লোকশিল্পও ডিজিটাল মাধ্যমে প্রবেশ করেছে। যেমন— ইউটিউব ও ফেসবুক লাইভে দেখা যাচ্ছে পটচিত্রের গান, গম্ভীরা নাটক, বাউল সঙ্গীত। পটচিত্র এখন ডিজিটাল মিডিয়াতে ব্যবহৃত হচ্ছে অ্যানিমেশন ভিডিও বা ব্র্যান্ডিং-এর ক্ষেত্রে। ছৌ নৃত্য এখন ‘ফিউশন’ রূপে শহুরে মঞ্চে পরিবেশিত হচ্ছে। এই পরিবর্তনের পিছনে রয়েছে “ডিজিটাল মিডিয়ার সাংস্কৃতিক বিশ্বায়ন”। একইসঙ্গে একে বোঝা যেতে পারে গ্রাম্য সংস্কৃতির নগরায়নের এক প্রবণতা হিসেবে। অ্যান্টোনিও গ্রামশি-র ‘সাংস্কৃতিক আধিপত্য’ তত্ত্ব অনুযায়ী আধুনিক পুঁজিবাদী সমাজে প্রভাবশালী শ্রেণি তাদের সংস্কৃতি ও রুচিকে আধিপত্যশীল করে তোলে। লোকশিল্পকে যখন শহরের বাজারে ‘এক্সোটিক’ রূপে পরিবেশিত করা হয়, তখন তার আদি আত্মা সংকুচিত হয়। সামাজিক পরিচিতি তত্ত্ব অনুযায়ী লোকশিল্প গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর আত্মপরিচয়ের প্রতীক। যখন শিল্পকে শুধুমাত্র বাণিজ্যিক দৃষ্টিকোণ থেকে রূপান্তর করা হয়, তখন সেই পরিচয় হ্রাসপ্রাপ্ত হয়। এটি এক ধরণের সাংস্কৃতিক বিচ্ছেদ তৈরি করে। গবেষণায় দেখা গেছে, বীরভূম, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, পশ্চিম মেদিনীপুর—এই জেলাগুলির বহু শিল্পী আজ বিভিন্ন রকম প্রকল্প বা উৎসবের উপর নির্ভরশীল।
ডিজিটাল প্রযুক্তি এবং ভার্চুয়াল অভিজ্ঞতার দ্বারা প্রভাবিত এই যুগে ঐতিহ্যবাহী চিত্রকলা একটি অসাধারণ পুনরুত্থানের সম্মুখীন হচ্ছে। বিশ্ব ক্রমবর্ধমান ডিজিটাল হয়ে ওঠার সাথে সাথে চিত্রকলার মতো ঐতিহ্যবাহী শিল্প গুলির আকর্ষণ শিল্পী এবং শিল্প উৎসাহীদের একইভাবে মোহিত করেছে। এটি লক্ষণীয় যে ঐতিহ্যবাহী এবং ডিজিটাল শিল্পের সহাবস্থান কোনও প্রতিযোগিতা নয় বরং একটি সুরেলা সমন্বয়। শিল্পীরা নতুন শৈল্পিক সম্ভাবনাগুলি অন্বেষণ করতে ঐতিহ্যবাহী কৌশল এবং ডিজিটাল সরঞ্জাম উভয়ই গ্রহণ করছেন। ডিজিটাল প্রযুক্তির একীকরণ বৃহত্তর পরীক্ষা-নিরীক্ষা, দক্ষতা এবং সহযোগিতার জন্য অনুমতি দেয়। শিল্পীরা তাদের ঐতিহ্যবাহী চিত্রকর্মগুলি প্রদর্শন করতে, বিশ্বব্যাপী শ্রোতাদের সাথে সংযোগ স্থাপন করতে এবং এমনকি তাদের কাজ প্রচার করতে এবং বিশ্বজুড়ে শিল্প উৎসাহীদের কাছে পৌঁছানোর জন্য বিভিন্ন ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করতে পারেন।
বিজ্ঞাপনে লোকশিল্পের চিত্রকল্প ব্যবহারের চর্চা ও ধারণা ছিল না ভারতে। তবে কোকাকোলা, রেনল্ট, স্যামসাং -এর মতন বিজ্ঞাপন অভিযানের সাফল্য, লোকশিল্প পুনঃপ্রাসঙ্গিককরণ এবং সংবেদনশীল সংযোগের মাধ্যমে মানুষকে প্রভাবিত করতে এবং বোঝাতে পারে, তা প্রমানিত করে। এটা নিশ্চয়ই যেকোনো পণ্যের ব্র্যান্ড ভ্যালু, ব্র্যান্ড ইমেজ ও ব্র্যান্ড ইক্যুইটি বৃদ্ধি করতে যথেষ্ট সক্ষম।
দ্রুত বিশ্বায়ন এবং প্রযুক্তিগত অগ্রগতির মুখে, লোক এবং ঐতিহ্যবাহী মিডিয়া সাংস্কৃতিক পরিচয় এবং বৈচিত্র্য বজায় রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ‘জাতীয় সাংস্কৃতিক বিনিময় কর্মসূচি’ এবং ‘গুরু শিষ্য পরম্পরা’ প্রকল্পের মতো কর্মসূচিগুলি এই শিল্পকলাগুলিকে জীবিত এবং প্রাসঙ্গিক রাখার জন্য অপরিহার্য। উপরন্তু, এনজিও এবং নাগরিক সমাজ সংস্থাগুলি এই ঐতিহ্যগুলির স্থায়িত্ব নিশ্চিত করতে সম্প্রদায়ের সাথে সরাসরি কাজ করে অমূল্য অবদান রেখে চলেছে। উদ্ভাবন, অভিযোজন এবং সংরক্ষণের মাধ্যমে, লোক ও ঐতিহ্যবাহী মিডিয়া সমৃদ্ধি অব্যাহত রাখতে পারে এবং আগামী প্রজন্মের জন্য ভারতের সাংস্কৃতিক ল্যান্ডস্কেপের একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসাবে থাকতে পারে।
লোকশিল্প কেবল অতীত নয়, এটি বর্তমান ও ভবিষ্যতের মধ্যে এক সেতুবন্ধন। প্রযুক্তি যদি লোকশিল্পকে সম্মান করে, তার আদি রূপকে সম্মান জানিয়ে আধুনিক রূপ দেয়—তাহলে সেই রূপান্তর হবে ইতিবাচক। কিন্তু যদি শুধুমাত্র বাণিজ্যিক প্রয়োজনেই এই রূপান্তর হয়, তবে তা এক ধরণের সাংস্কৃতিক অবক্ষয় ডেকে আনবে। আজ দরকার লোকশিল্পের সঙ্গে হৃদয়ের বন্ধন, শিক্ষার যোগসূত্র, এবং নীতিগত সম্মান। তাহলেই বাংলার মাটি থেকে ডিজিটাল মিডিয়ার পর্দা পর্যন্ত লোকশিল্পের গন্ধ ছড়িয়ে পড়বে, জীবন্ত থাকবে তার প্রাণ।
পুনর্জন্মের প্রত্যয়ে প্রযুক্তি নিঃসন্দেহে শক্তি। কিন্তু যদি তা শিকড়হীন করে তোলে, তবে সেটা উন্নয়ন নয়, বিলুপ্তির সিগন্যাল। তাই দরকার সংস্কৃতির সঙ্গে প্রযুক্তির সহাবস্থান। দরকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে লোকশিল্পের অন্তর্ভুক্তি, মিডিয়ার মনোযোগ, এবং সবচেয়ে বেশি দরকার—আমাদের সম্মান ও ভালোবাসা। শেষ কথায় লোকশিল্প কেবল শিল্প নয়—এ হলো আত্মার ভাষা, এক জনজাতিগত চেতনা। আজ সে বদলাচ্ছে, কিন্তু যদি তার আত্মাকে ধরে রাখা যায়, তবে বদলেও সে বাঁচবে। ডিজিটালের দুনিয়ায় শিকড় না ভুলে জেনারেশনের গল্প হোক, কিন্তু লোকজের গন্ধ মিশুক সেই গল্পে।