বাঙালি সংস্কৃতির ধারক ও বাহক উত্তরপাড়া জয়কৃষ্ণ লাইব্রেরি
Uttarpara Jayakrishna Library, the custodian and bearer of Bengali culture

রাজু পারাল: হুগলি জেলার একটি বর্ধিষ্ণু অঞ্চল উত্তরপাড়া। আর এই উত্তরপাড়াতেই রয়েছে ‘জয়কৃষ্ণ পাবলিক লাইব্রেরি’। উত্তরপাড়া রেলওয়ে স্টেশন থেকে মিনিট কুড়ি পঁচিশের পথ এই লাইব্রেরি। তবে জি.টি.রোড ধরে এলে লাইব্রেরিটি দশ মিনিটের পথ। ইতালিয়ান স্থাপত্যের আদলে নির্মিত এই লাইব্রেরি অভূতপূর্ব এক নিদর্শন যা একঝলকে দেখলে রাজবাড়ি বলে মনে করতে পারেন অনেকেই।
পশ্চিমবঙ্গের এই জেলা গ্রন্থাগারটি এশিয়ার প্রথম পাবলিক লাইব্রেরি গুলোর মধ্যে অন্যতম। এশিয়াটিক সোসাইটি, ভারতীয় জাদুঘর কিংবা জাতীয় গ্রন্থাগারের মতোই এই গ্রন্থাগারও বাঙালি সংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ একটি ধারক ও বাহক। উত্তরপাড়ার এই গ্রন্থাগারটি নির্মিত হয়েছিল বাবু জয়কৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়ের পৃষ্ঠপোষকতায়। কে ছিলেন এই জয়কৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়? যাঁর নামে আস্ত একটা লাইব্রেরি গড়ে উঠলো?
তিনি একদিকে যেমন ছিলেন জমিদার অন্যদিকে তেমনি ছিলেন একজন সমাজ সংস্কারক। তবে জমিদার হয়েও তিনি ছিলেন প্রজাদরদী। রাজা রামমোহনের পরবর্তী বাংলার সমাজ ও সাংস্কৃতিক জীবনে জমিদার জয়কৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়ের ভূমিকা ছিল যথেষ্ট। তবে একথা অনস্বীকার্য, বাবু জয়কৃষ্ণের ব্যক্তিত্বের বিকাশে কষ্টিপাথরের ভূমিকা পালন করেছিল তাঁর পরিবার।
জগমোহন মুখোপাধ্যায় ও রাজেশ্বরী দেবীর পুত্র জয়কৃষ্ণের জীবনগঠনে এর পূর্ণ ছায়া লক্ষ্য করা যায়। বাল্যকালে ঠাকুমা শিবানী দেবীর ব্যক্তিত্ব ও শিক্ষাদান জয়কৃষ্ণকে তিলে তিলে গড়ে তুলেছিল। আবার পিতার কর্মসূত্রে মিরাটের অভিজ্ঞতা বাংলার কাদায় গড়া জয়কৃষ্ণকে পাথুরে পাটকেলে পরিণত করেছিল। এই অর্জিত চারিত্রিক দৃঢ়তাই পরবর্তীকালে ব্যতিক্রমী জমিদার ও সমাজ সংস্কারক জয়কৃষ্ণের মনন গড়ে দিয়েছিল। জমিদারির মাটির সঙ্গে আঁকড়ে থেকে প্রজাদের সুখ-দু:খ, হাসি-কান্নায় একাত্ম হয়ে উঠেছিলেন বাবু জয়কৃষ্ণ। প্রজাদের শিক্ষা প্রসারের জন্যে অকাতরে অর্থ ব্যয় করে বিদ্যাদাতার তকমা অর্জন করেছিলেন বাবু জয়কৃষ্ণ। এর পরিচয় মেলে বন্ধু মাইকেল মধুসূদনের রসিকতাতেও, ‘ জয়কেষ্টটা তো পাগল শিরোমণি, টাকার কুবের হয়ে শুধু হবিষ্যি খায় আর বিদ্যালয় তোলে।
‘বন্ধু ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের প্রত্যক্ষ প্রেরণা ও উৎসাহে জিরাট, মায়াপুর, বলুটি, গঙ্গাধরপুর, ক্ষীরপাইসহ জমিদারির বিভিন্ন এলাকায় একাধিক ইঙ্গ-বঙ্গ বিদ্যালয় খুলেছিলেন। হুগলি কলেজের সঙ্গেও ছিল বাবু জয়কৃষ্ণের ওতপ্রোত সম্পর্ক। হয়তো অনেকেরই অজানা উত্তরপাড়ার প্যারীমোহন কলেজও প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তাঁরই প্রত্যক্ষ উদ্যোগে। আবার মেয়েদের শিক্ষা প্রসার ও নারী মুক্তির ক্ষেত্রেও জয়কৃষ্ণ সর্বদা সোচ্চার ছিলেন। বেথুন সাহেব যখন ‘হিন্দু ফিমেল স্কুল’ নির্মাণ করেন তখন বাবু জয়কৃষ্ণ নগদ দশ হাজার টাকা দান করেন স্ত্রী শিক্ষা বিস্তারে।
তবে উনিশ শতকের বাংলার অন্যতম সংস্কারকরূপে জয়কৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়ের কথা এলে সর্বাগ্ৰে উঠে আসবে উত্তরপাড়ার সাধারণ গ্রন্থাগারের কথা। বস্তুত তাঁর অক্ষয় কীর্তি উত্তরপাড়া গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠার ভিত্তিও এই শিক্ষা প্রসারী মননেই নিহিত ছিল তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। নি:সন্দেহে সমাজ সংস্কারক বাবু জয়কৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়ের এটি সেরা কীর্তি।
স্যার উইলিয়াম হান্টার (উনবিংশ শতাব্দীর বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ ও পরিসংখ্যানবিদ) এই গ্রন্থাগার সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘a unique storehouse of local literature alike in english and vernacular tongues.’ ১৮৫২ সালের ১৫ এপ্রিল, বাবু জয়কৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় আনুষ্ঠানিকভাবে ভারতে প্রথম (সম্ভবত এশিয়াতেও) বিনামূল্যে জনসাধারণের জন্যে এই গ্রন্থাগার খুলে দেন। উত্তরপাড়া পাবলিক লাইব্রেরি নামে খ্যাত এই গ্রন্থাগারটি মূলত বাবু জয়কৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়ের ব্যাক্তিগত সংগ্রহ নিয়ে তৈরী হয়। ১৯৫১ সালের শেষদিক পর্যন্ত এটি শুধুমাত্র গবেষকদের জন্যে খোলা থাকতো। জনসাধারণের শিক্ষার প্রসার এবং বাংলায় বৃত্তি প্রদান বৃদ্ধির জন্যে বাবু জয়কৃষ্ণ কিছু একটা করতে চেয়েছিলেন।
তাঁর উপর দ্বারকানাথ ঠাকুরের প্রভাব এবং ১৮৫০ সালে ব্রিটেনে পাবলিক লাইব্রেরি অ্যাক্ট তাঁর এই ইচ্ছেকে আরও আগ্রহী করে তোলে। ১৮৫৪ সালের আগস্ট মাসে তিনি উত্তরপাড়াতে একটি পাবলিক লাইব্রেরি গড়ে তোলার জন্যে বর্ধমানের বিভাগীয় কমিশনারের কাছে একটি প্রস্তাব পেশ করেন। পাঁচ হাজার টাকা তিনি এই লাইব্রেরিতে দান করতে ইচ্ছুক ছিলেন। প্রস্তাবটি অনুমোদিত হয়নি শেষপর্যন্ত। বাবু জয়কৃষ্ণ তখন নিজেই পুরো লাইব্রেরিটির খরচ বহন করেন। তখনকার সময়ে ৮৫,০০০ টাকা খরচ করে এক একর জমির উপরে লাইব্রেরিটি নির্মাণ করেন তিনি।
প্রাথমিকভাবে সাত জন কর্মী নিয়োগ করা হয়েছিল। একজন গ্রন্থাগারিক, একজন সহকারি গ্রন্থাগারিক, একজন ক্লার্ক , দুইজন মালি, একজন ঝাড়ুদার এবং একজন দারোয়ান। তিনি উত্তরপাড়ার নাগরিকদের একটি দলকে লাইব্রেরী দেখাশোনা করার কাজে নিয়োগ করেছিলেন। বাবু জয়কৃষ্ণ মনে করতেন লাইব্রেরিই একমাত্র পারে জ্ঞানক্ষুধার নিবারণ করতে। জ্ঞানপিপাসু বইপ্রেমীরা বারবার ছুটে এসেছেন এই গ্রন্থাগারে। আর ফিরে গেছেন পরম তৃপ্তিলাভ করে। উত্তরপাড়া জয়কৃষ্ণ লাইব্রেরিতে যে সমস্ত গুণীজন বারেবারে ছুটে এসেছেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম মেরি কার্পেন্টার। মেরি কার্পেন্টার তাঁর বহু লেখায় উত্তরপাড়া সাধারণ গ্রন্থাগারের কথা সবিস্তারে উল্লেখ করেছেন।
এছাড়া অন্যান্য যে সমস্ত গুণীজনের পদধুলিতে ধন্য এই গ্রন্থাগার তাঁরা হলেন – ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, মাইকেল মধুসূদন, রেভা জেমস লং, প্যারীচাঁদ মিত্র, রামতনু লাহিড়ী, কিশোরীচাঁদ মিত্র, হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়, ভূদেব মুখোপাধ্যায়, কেশবচন্দ্র সেন, অক্ষয়কুমার দত্ত, ডা মহেন্দ্রলাল সরকার, হেমচন্দ্র বন্দোপাধ্যায়, অরবিন্দ ঘোষ, স্বামী বিবেকানন্দ, বিপিনচন্দ্র পাল, চিত্তরঞ্জন দাশ, সুভাষচন্দ্র বসু, যদুনাথ সরকার, নজরুল ইসলাম, সুকুমার সেন, বিধানচন্দ্র রায়, প্রফুল্লচন্দ্র সেন, প্রণব মুখোপাধ্যায়, জ্যোতি বসু, প্রতিভা পাটিল, গোপালকৃষ্ণ গান্ধী প্রমুখ। বাবু জয়কৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় এই গ্রন্থাগারে কত প্রকারের যে বইয়ে সমৃদ্ধ করেছিলেন তা ভাবলে বিস্ময় জাগে।
সমকালে অনেকেই বলতেন, ‘যাহা নাই জয়কৃষ্ণে, তাহা নাই ভূভারতে।’ গ্রন্থাগারে বর্তমানে বই ও পত্রপত্রিকার সংখ্যা প্রায় এক লক্ষ পঁয়ষট্টি হাজার। ইংরেজি ও বাংলা সাহিত্যের কিছু অমূল্য সম্পদ এই গ্রন্থাগারে সংরক্ষিত আছে। পুরোনো দিনের পত্র-পত্রিকা, যেমন – তত্ত্ববোধিনী, দিকদর্শন, বিবিধার্থ সংগ্রহ, সংবাদ রসরাজ, সোমপ্রকাশ, বামাবোধিনী, আর্যদর্শন, বঙ্গদর্শন, সাধনা, ভারতী এই গ্রন্থাগারে আপন মহিমায় বিদ্যমান। ইংরেজি পত্র-পত্রিকার মধ্যে পাওয়া যায় – গেজেট অব ইন্ডিয়া, কালকাটা গেজেট, এশিয়াটিক জার্নালস, ব্রিটিশ রিভিউ, এডিনবরা রিভিউ….ইত্যাদি। উনবিংশ শতাব্দীর শেষদিকে থিয়েটার ও রঙ্গমঞ্চকে জনপ্রিয় করে তোলার জন্য প্রকাশিত হয়েছিল রঙ্গালয়, নাট্য পত্রিকা, থিয়েটার, নাচঘর ইত্যাদি। শিশু ও কিশোরদের জন্য প্রকাশিত হয়েছিল মুকুল, সন্দেশ, মৌচাক, শিশুসাথী, পাঠশালা, রঙমশাল প্রভৃতি পত্রিকা।
উনিশ শতকের ছাপাখানার অগ্রদূতদের বিশেষত, উইলিয়াম কেরী, মার্শম্যান, হ্যালডে, ওয়ার্ড, রামমোহন প্রমুখদের লেখা এই লাইব্রেরীতে আজও সংরক্ষিত। রেভারেন্ড জেমস লং এর লেখা স্বদেশী বইয়ের তালিকার বেশিরভাগ বইই এই গ্রন্থাগারের অন্তর্ভূক্ত। প্রায় দুশো বছরের প্রাচীন এই গ্রন্থাগারে রয়েছে বহু দুষ্প্রাপ্য পুঁথিও। গ্রন্থাগারের এই দুষ্প্রাপ্য পুঁথির সংগ্রহ গবেষণারত ছাত্রছাত্রীদের পাশাপাশি ইতিহাস প্রনেতাদের কাছেও অমূল্য সম্পদ। আক্ষরিক অর্থেই উত্তরপাড়া জয়কৃষ্ণ লাইব্রেরী হয়ে উঠেছিল দেশব্যাপী গ্রন্থাগার আন্দোলনের মুখ ও সাংস্কৃতিক জাগরণের পীঠস্থান। যার ধারা আজও গঙ্গার সলিল জলরাশির মত প্রবাহমান। পরাধীন ভারতে তাঁর মতো মানসিক দৃঢ়তা খুব কম মানুষেরই ছিল। উল্লেখ্য, বাবু জয়কৃষ্ণ তাঁর পরবর্তী প্রজন্মের জন্য যা করে গেছেন তার জন্য তিনি তাদের মনে চির অমর হয়ে থাকবেন।