সম্পাদকীয়

‘এক দেশ এক ভোট’ নীতি সংস্কার নয়, গণতন্ত্রে বুলডোজার চালানোর ব্যবস্থা

'One nation, one vote' policy is not a reform, but a bulldozer system in democracy

Truth of Bengal: জয় চক্রবর্তী: ‘এক দেশ এক ভোট’ কোনও ধরনের সংস্কার নয়। এটা আসলেই গণতন্ত্রের ওপর বুলডোজার চালানোর ব্যবস্থা। কেন্দ্রের এই নীতির বিরুদ্ধে কড়া ভাষায় আক্রমণ করেছেন তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কেন্দ্রীয় এই নীতির প্রতিবাদ অন্যান্য বিরোধী দলগুলিও করেছে। কিন্তু প্রশ্ন হল কেন ‘এক দেশ এক ভোট’-এর বিরোধিতা করা হচ্ছে। কী কাদের যুক্তি।

বিষয়টা সহজ সরল ভাবে বোঝার চেষ্টা করা যাক। কেন্দ্রীয় সরকারের যুক্তি যেমন রয়েছে, তেমনই পাল্টা যুক্তিও রয়েছে বিরোধীদের। কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় সবুজ সংকেত পাওয়ার পর সংসদে ২৬৯ জন সাংসদ সমর্থন করেছেন কেন্দ্রের নীতিকে। উল্টোদিকে ১৯৮। প্রথম ধাপে স্বাভাবিক ভাবেই এই নীতিকে সংসদের সমর্থন করা হয়েছে। ২০১৯ সালে নরেন্দ্র মোদির হাত ধরে দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসে ভারতীয় জনতা পার্টি অ্যান্ড কোম্পানি। তখন থেকেই ‘এক দেশ এক ভোট’-এর বিষয় জোরালো সমর্থন শুরু করে বিজেপি। গত বছর অর্থাৎ ২০২৩ সালে সমাধান সূত্র পেতে প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দের নেতৃত্বে একটি উচ্চপর্যায়ের কমিটি গঠন করা হয়।

চলতি বছরের মার্চ মাসে এই কমিটি রিপোর্ট পেশ করে রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুর কাছে। প্রাক্তন রাষ্ট্রপতির নেতৃত্বে কমিটি বেশ কিছু সুপারিশ করেছে। ‌রিপোর্ট অনুসারে, ‘এক দেশ এক ভোট’ দুটি পর্যায়ে করার সুপারিশ করা হয়েছে। প্রথম পর্যায়ে কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশন দেশের সমস্ত লোকসভা এবং বিধানসভা নির্বাচন সংঘটিত করবে। পরের দফায় পঞ্চায়েত এবং পুরসভাগুলির নির্বাচন হবে। তবে কমিটি লোকসভা ও বিধানসভা ভোট শেষ হওয়ার ১০০ দিনের মধ্যে পঞ্চায়েত পুরসভার নির্বাচন করার সুপারিশ করেছে। কেন্দ্রীয় সরকারের যুক্তি, একসঙ্গে নির্বাচন করলে অনেকটাই খরচ বাঁচানো সম্ভব।

‘এটা ঠিক যে একসঙ্গে নির্বাচন করবে খরচে বেশ কিছুটা রাশ টানা যাবে। কিন্তু গণতান্ত্রিক উপায় নির্বাচিত রাজ্যগুলির শাসন ব্যবস্থায় প্রভাব পড়বে। নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত অনেক রাজ্য সরকার এগিয়ে যেতে পারবে না। এটা গণতন্ত্রের পক্ষে শুভ নয়’ বলে জানালেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অভিরূপ সরকার। আগামী ২০২৯ সালে ‘এক দেশ এক ভোট’ লাগু করতে চায় বিজেপি। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কেন্দ্রীয় এই নীতির প্রতিবাদ করেছেন। অন্যান্য বিরোধী শক্তিও সংসদে এই নীতির বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছে। কিন্তু বিরোধীদের বিরোধিতা কেন? সত্যিই কি যুক্তিসঙ্গত বিরোধীদের বিরোধিতা? একটু সহজ করে বোঝার চেষ্টা করা যাক। ২০২৩ সালে দশটি রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন হয়েছে।

পাঁচ বছর মেয়াদ ধরলে তা শেষ হবে ২০২৮ সালে। দশটি রাজ্যের মধ্যে রয়েছে রাজস্থান, ছত্রিশগড়, কর্ণাটক, তেলেঙ্গানা, মিজোরাম, মধ্যপ্রদেশ, হিমাচল প্রদেশ, মেঘালয়, নাগাল্যান্ড, ত্রিপুরা। যদি ২০২৯ সালে ‘এক দেশ এক ভোট’ গোটা দেশে লাগু হয়, তা হলে এই দশটি রাজ্যের ক্ষেত্রে অসুবিধা হবে না। কারণ তাদের মেয়াদ শেষ হচ্ছে ২০২৮ সালে। প্রাক্তন রাষ্ট্রপতির নেতৃত্বে কমিটির সুপারিশে বলা হয়েছে, এক্ষেত্রে বাড়িয়ে দেওয়া যেতে পারে। তা হলে কোনও সমস্যা হবে না। কিন্তু এরপর? ২০২৬ সালে বেশ কয়েকটি রাজ্যের নির্বাচন রয়েছে। যার মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ রয়েছে। আর রয়েছে কেরল, তামিলনাড়ু, অসম। ২০২৬ সালে বিধানসভা নির্বাচনের পর মেয়াদ শেষ হবে ২০৩১ সালে। তা হলে সে ক্ষেত্রে কমিটির সুপারিশ কী? এই রাজ্যগুলির বিধানসভা কিছুটা আগে ভেঙে দিয়ে সেখানে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করতে হবে। গণতান্ত্রিক উপায়ে একটা সরকার আসবে কিন্তু পুরো পাঁচ বছর টিকবে না।‌ তার আগেই ভেঙে দিয়ে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করতে হবে। এক্ষেত্রে গণতন্ত্রের ওপরে সত্যিই বুলডোজার।

মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এক্স হ্যান্ডেলে যে বুলডোজারের কথা বলেছেন সেটা তো মিলে যাচ্ছে। ‌আবার সুপারিশে বলা হচ্ছে, সবটাই কেন্দ্রীয় সরকার নির্ধারণ করতে পারে। ২০২৭-এ গুজরাট, পঞ্জাব এবং উত্তরপ্রদেশে ভোট হবে। এই রাজ্যগুলির ক্ষেত্রেও একই ধরনের গণতান্ত্রিক পদ্ধতির ওপর বুলডোজার চলবে। এই সমস্ত বিষয়ে করতে উচ্চপর্যায়ের কমিটির সুপারিশ রয়েছে সংবিধানের বেশ কিছু ধারার পরিবর্তনের। এক্ষেত্রে প্রায় আঠারোটি সংশোধন করার বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতামত। উচ্চপর্যায়ের কমিটির সুপারিশ অনুসারে গণতান্ত্রিক উপায়ে নির্বাচিত বিধানসভা ভেঙে রাষ্ট্রপতি শাসন করতে গেলে সংবিধানের বেশ কয়েকটি অনুচ্ছেদের সংশোধন আনতে হবে। মনে রাখতে হবে, সংবিধান পরিবর্তনের বিষয় নিয়ে অনেকগুলি ক্ষেত্রে রাজ্য বিধানসভার সম্মতি প্রয়োজন।

ভারতে একসময় লোকসভা বিধানসভা নির্বাচন একত্রে হয়েছে। ১৯৫১ খালি স্বাধীনতার পর প্রথম নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৫১-৬৭ সাল পর্যন্ত একসঙ্গেই লোকসভা ও বিধানসভা নির্বাচন হয়েছিল। তা হলে এখন নয় কেন? মনে রাখতে হবে, ১৯৬৭ সালের ভোটের পর বেশ কিছু রাজ্যে সরকার সম্পূর্ণ সময় টেকেনি। আবার ১৯৭০ সালে লোকসভা ভেঙে দিয়েছিলেন সেই সময়ের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধি। কিন্তু এখানেই শেষ নয়। বিষয়টা ২০২৯ সালে আদৌও লাগু করা যাবে কিনা তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। কারণ চলতি বছরের লোকসভা অধিবেশনের শুরুতে ‘এক দেশ এক ভোট’ সম্পর্কিত একটি ঘোষণার প্রয়োজন ছিল। সেটা কিন্তু হয়নি। ফলে ২০২৯-এ এটা হচ্ছে না ধরে নেওয়া যায়। তা হলে কবে হতে পারে? ২০২৯ সালে ফের লোকসভা নির্বাচন রয়েছে।

এখানে যদি ‘এক দেশ এক ভোটে’র বিষয়টি আবার উঠে আসে তা হলে সংসদের প্রথম অধিবেশনে ঘোষণা করতে হবে। তা হলে ২০৩৪ সালে গোটা দেশে লাগু হওয়া সম্ভব। কিন্তু সেখানেও গণতন্ত্রের ওপর বুলডোজার কোনওমতেই কমবে না। ২০২৬ অথবা ২০২৭ সালের বিধানসভা নির্বাচন হওয়ার পর তার মেয়াদ ২০৩১ ও ২০৩২ হবে। যদি ২০৩৪ সালে ‘এক দেশ এক ভোট’ চালু করতে হয় তখনও বেশ কিছু রাজ্যের পাঁচ বছরের মেয়াদ পূর্ণ হবে না। ফলে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ‘এক দেশ এক ভোট’ সমগ্র দেশের চালু করার ব্যাপারে যে প্রতিবাদ করেছেন তার যথেষ্ট যৌক্তিকতা রয়েছে।

Related Articles