
Truth of Bengal, রাজু পারাল: গীতিকার, সুরকার বা সঙ্গীত আয়োজক–তাঁকে যে ভাবেই দেখা হোক না কেন তাঁর কালে তিনিই যে শ্রেষ্ঠ তা স্বীকার করতেই হয়। সলিল চৌধুরী মানেই যেন স্বতন্ত্র একটা ঘরানা- কী কথা, কী সুরে। বলা যায়, হিন্দুস্তানিসঙ্গীত, লোকসঙ্গীত এবং সর্বোপরি রবীন্দ্রসঙ্গীতের সুরে জারিত হয়ে জন্ম নিয়েছিলেন সুরসম্রাট সলিল চৌধুরী। তাঁর গানে প্রাচ্য ও প্রাশ্চাতের দু’রকম প্রভাবই লক্ষ্য করা যায়। প্রাচ্য ও প্রাশ্চাত্য সঙ্গীত সম্পর্কে সলিল চৌধুরী নিজেই বলেছেন, ‘ভারতীয়সঙ্গীতের ‘মেলোডি’ পৃথিবীর যে কোনও দেশের শ্রেষ্ঠসঙ্গীতের সঙ্গে সমানে দাঁড়াতে পারে।”
বহুমুখী এইসঙ্গীতপ্রতিভা সুর নিয়ে যে সব পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতেন তা নিজের গানেই প্রয়োগ করতেন, যা সত্যিই অবাক করার মতো। কখনও তিনি সুকান্ত ভট্টাচার্যের কবিতায় সুর বসিয়ে নির্মাণ করেছেন ‘রানার’, আবার কখনও নিজেই লিখছেন, ‘কোনও এক গাঁয়ের বধূ’। তাঁর সুরে কিশোরকুমার, মুকেশ, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, লতা মঙ্গেশকার, মান্না দে প্রমুখ গেয়েছেন একের পর এক কালজয়ীসঙ্গীত। তবেসঙ্গীত প্রতিভার সাক্ষর সঙ্গীতের নানা শাখায় রাখলেও সলিল চৌধুরী পাশাপাশি কবি ও গল্পকার হিসেবেও সাহিত্যপ্রেমীদের কাছে হয়ে উঠেছিলেন সমানভাবে সমাদৃত।
তবে গানই তাঁর প্রধান আইডেন্টিটি। সমকালে তিনি বাংলা গানের একজন আইকন হয়ে উঠেছিলেন। রবীন্দ্র-নজরুল-দ্বিজেন্দ্রলাল-অতুলপ্রসাদ-রজনীকান্তের পরবর্তীকালে বাংলা আধুনিক গানে এক নতুন জগৎ তৈরি করেছিলেন সলিল চৌধুরী। শচীনদেব বর্মন কিংবা পঙ্কজ মল্লিকেরসঙ্গীত বৃত্তের বাইরে গিয়ে তিনি নির্মাণ করেছিলেন বাংলা গানের নতুন একটি পথ। সুরে এবং গানের কথায় এনেছিলেন নতুন যুগ। তাঁর প্রতিটি গানের কথায় উঠে আসে শোষিত মানুষের মুক্তির কথা। আমাদের রোজকার দিনের হাসি, রাগ, শোক, ভালবাসা ও বিদ্রোহ ফিরে ফিরে আসে তাঁর গান ও কবিতায়। তাঁর গান নিছক গান নয় এক জীবন দর্শন।
কিংবদন্তি গীতিকার ও সুরকার সলিল চৌধুরীর জন্ম২৪ পরগনার সোনারপুরে হলেও আসামের চা বাগানে প্রাত্যহিক জীবনের ছন্দে ও সুরে বাল্যকালে সিক্ত হয়েছেন সলিল চৌধুরী। বাবা জ্ঞানেন্দ্রময় চৌধুরী ছিলেন চা বাগানের ডাক্তার। পাশাপাশি তাঁর বাবার সংগ্রহে ছিল প্রাশ্চাত্য সঙ্গীতের বিপুল সম্ভার। বাল্যবয়স থেকেই সে সব সুরভাণ্ডার তাঁকে সমৃদ্ধ করেছিল। কেবল তাই নয়, শিল্পেরসঙ্গেরাজনীতির মেলবন্ধনের কৌশলও তিনি প্রাথমিকভাবে শিখেছিলেন বাবার কাছ থেকে। কলকাতা বঙ্গবাসী কলেজ পড়াকালীন তিনি আকৃষ্ট হন ভারত ছাড়ো আন্দোলনে।
স্নাতক পড়াকালীন তিনি ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সংস্পর্শে আসেন। পার্টির সাংস্কৃতিক সংগঠন ভারতীয় গণনাট্য সংঘে যোগ দিয়ে সক্রিয়ভাবে প্রচুর কাজ করেন।১৯৫২ সালে তিনি চলচ্চিত্রের কাজে মুম্বই পাড়ি দেন। মুম্বইতে পেশাগত কাজ করতে করতেই তাঁর মনে কয়্যার দল গড়েতোলার স্বপ্ন দানা বাঁধে।১৯৫৮ গড়ে তোলেন ‘বোম্বে ইয়ুথ কয়্যার’। এই সংগঠনে থাকাকালীনই তিনি তাঁর পূর্ব রচিত গানকে কয়্যার রূপ দেন এবং কিছু নতুন গানও সৃষ্টি করেন। সেগুলির মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য ‘ও আলোর পথযাত্রী’, ‘নওজোয়ান নওজোয়ান’, ‘গৌরীশৃঙ্গ তুলেছে শির’ ইত্যাদি।
গণসঙ্গীতকার সলিল চৌধুরী বোম্বে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন সেই সময়ে। হিন্দি, গুজরাটি, ওড়িয়া, অসমিয়া, মারাঠি, মালয়ালাম, তেলেগু ইত্যাদি নানা ভাষার গানে তিনি সুরারোপ করেছিলেন। তাঁর অনেক গান নানা ভাষায় অনুদিত হয়েছে। সমাজ এবং মানুষের প্রতি এক গভীর দায়বদ্ধতা তাঁকে গানের জগতে এক ভগীরথ করে তুলেছিল।