রাজ্যের খবর

ডাকাতদের নিধন করায় ইংরেজরা উলা গ্রামের নাম রাখেন বীরনগর

The British renamed the village of Ula as Birnagar after killing the robbers

Truth Of Bengal: সুব্রত দত্ত, নদিয়া: একদা প্রসিদ্ধ উলা গ্রাম বা বীরনগর ইতিহাস সুপ্রাচীন। প্রাচীন গ্রন্থে উল্লেখ রয়েছে উলা গ্রামের নাম। এখানকার প্রাচীন সব ইতিহাস গৌরবোজ্জ্বল। তৎকালীন উলা ছিল ভাগীরথী নদীর পূর্ব তীরবর্তী একটি অখ্যাত গন্ডগ্রাম। উলা গ্রামটির কোল ঘেঁষে বহুকাল পূর্ব্বে ভাগীরথী নদী বহমান ছিল। বর্তমানে ভাগীরথী নদী অনেক দূরে সরে গিয়েছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ভাগীরথীর গতিপথ পরিবর্তন হয়েছে। তবে নদীর সেই পুরনো ধারা পথে একটি খাল হয়ে রয়েছে এখন।আজও সেই প্রাচীন অন্তর্হিত নদীখাত মজে যাওয়া খাল রূপে উলা গ্রামটির দক্ষিণ দিকে দেখা যায়।

“উলার মেয়ে কুলকুনুটি, নদের মেয়ের খোঁপা
শান্তিপুরের নথ নাড়া দেয়, গুপ্তিপাড়ার চোপা।।”

নদিয়ার বীরনগর। অনেকের মুখে মুখে ফেরে একসময় এখানে বীরেদের বসবাস ছিল। তাদের সাহসিকতায় ডাকাতরা পর্যন্ত ভয় পেত। কয়েকজন ডাকাতের প্রাণ যায় এখানকার বীরেদের বীরত্বে। তাই উলা গ্রামের নাম হয়ে যায় বীরনগর। বহু যুগ ধরে এই এলাকার নাম ছিল উলা গ্রাম।

মিত্র মুস্তাফিদের হাত ধরে উলা গ্রামের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল নদিয়া তথা বাংলা জুড়ে। মুঘল সম্রাট তখন ঔরঙ্গজেব। সেই আমলে মিত্র মুস্তাফিদের প্রভাব ছিল গোটা উলা গ্রামে। আনুমানিক ১৬৫৭ খ্রীষ্টাব্দে সুপ্রসিদ্ধ পন্ডিত মোহন মিত্র টেকা নামক গ্রাম থেকে এসে প্রাচীন উলা গ্রামে বসতি স্থাপন করেন। তাঁর পুত্র, এই মিত্র কুলের একজন প্রবাদপ্রতিম কৃতী পুরুষ ছিলেন রামেশ্বর মিত্র।

তিনি তৎকালীন বাংলার নবাব মুর্শিদকুলি খাঁ-এর কোষাধ্যক্ষ ও বাংলার নায়েব-কানুনগো পদে নিযুক্ত ছিলেন। নিজের কাজে পারদর্শিতা দেখিয়ে তিনি মুঘল সম্রাট ঔরঙ্গজেবের কাছ থেকে ‘মুস্তৌফি’ উপাধি লাভ করেন এবং সম্মানসূচক ‘সোনার পাঞ্জা’ উপহার হিসাবে পান। তাদের হাত ধরেই উলা গ্রামের বিভিন্ন প্রান্তে নির্মাণ হয় একের পর এক মন্দির। সেই সব মন্দির প্রাচীনত্বের ধারক ও বাহক। আজও এই সব প্রাচীন মন্দির উলা গ্রাম তথা বীরনগর এর খ্যাতিকে শীর্ষে নিয়ে গিয়েছে।

মন্দির গুলোকে ঘিরে আজও বীরনগরে নানা অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়। এখানকার অন্যতম প্রাচীন উলা-বীরনগরের জোড়া বাংলা কৃষ্ণ মন্দির। এই মন্দিরটি প্রাচীন বাংলার একটি অনন্য মন্দির। এখানকার স্থাপত্যশৈলী হল জোড়া বাংলা মন্দির। পাশাপাশি অবস্থিত এবং পরস্পর সংযুক্ত দুটি গ্রাম বাংলার দোচালা কুঁড়েঘরের আদলে নির্মিত মন্দিরকে বলা হয় জোড়া বাংলা। সামনের দোচালা ঘরটি এক্ষেত্রে বারান্দা বা নাটমন্দির এবং পিছনের দোচালা ঘরটি হয় গর্ভগৃহ। নদিয়া জেলার উলা বা বীরনগর গ্রামে রয়েছে এমনই সুপ্রাচীন ও দৃষ্টিনন্দন জোড়া বাংলা মন্দির।

উলা সমাজের শীর্ষস্থানীয়, মুস্তৌফি বংশের প্রতিষ্ঠাতা এই রামেশ্বর মিত্র ১৬৯৪ খ্রীষ্টাব্দে তাঁর বসতবাড়ির কাছে একটি অনন্য সুন্দর জোড়া বাংলা রাধা-কৃষ্ণের মন্দির নির্মাণ করেন। মন্দিরের গর্ভগৃহে রাধা-কৃষ্ণের সুন্দর বিগ্রহ রয়েছে, যা আজও নিত্য পূজিত। তিনটি খিলান যুক্ত প্রবেশপথের ওপরে কুলুঙ্গি নিবদ্ধ অসংখ্য পোড়ামাটির ভাষ্কর্যের মধ্যে কৃষ্ণলীলা এবং পৌরাণিক দেবদেবীর প্রাধান্য লক্ষ্য করা যায়। দেওয়ালের বাকি অংশে ফুলকারি নকশা প্রচুর পরিমাণে দেখা যায়।

এখানে বহু গন্যমান্য পন্ডিতের চতুষ্পাঠী ছিল এবং রাঢ়ী শ্রেণীর অত্যন্ত সম্ভ্রান্ত ও অবস্থাপন্ন অনেক কুলিন পরিবারের বসবাস ছিল। পুরুষের তো কথাই নেই তখন এখানকার মহিলারা পর্যন্ত অত্যন্ত বিদূষী ছিলেন। বীরনগরের খ্যাতি এবং বনিয়াদী কুল মর্যাদা এই অঞ্চলের প্রবাদেও স্থান পেয়েছে।

প্রবেশপথের ওপরে জীর্ণ পোড়ামাটির ফলকে প্রতিষ্ঠা লিপিতে খোদিত রয়েছে: “অঙ্গৈককালেন্দুমিতে শকাব্দে ১৬১৬ কায়স্থ কায়স্থ হরেষধর্ম্মাঃ যো নির্ম্মমে শ্রীহরি যুগ্মধাম শ্রীযুক্ত রামেশ্বর মিত্র সঃ ।।” অর্থাৎ, “১৬১৬ শকাব্দে (১৬৯৪ খ্রীষ্টাব্দে) কায়স্থকুলোদ্ভব শ্রী রামেশ্বর মিত্র শ্রীহরির এই যুগ্ম গৃহ নির্মাণ করিলেন।।”

মন্দিরটির সামনের অংশ জুড়ে অসংখ্য সূক্ষ্ম টেরাকোটা ফলক দেখা যায়, যার মধ্যে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে নৌকাভ্রমণ, সৈনিকদল, মৃগয়া, বানিজ্য তরী, পালকি বাহিত বাবু-র মতো অনেক সামাজিক দৃশ্য। শিল্পনৈপুন্যে এগুলি নদীয়া জেলার অন্যতম সেরা পোড়ামাটির ভাষ্কর্য হলেও, অপটু হাতে সংস্কারের কারণে এবং সাদা ও লাল কলিচুনের প্রভাবে বর্তমানে অনেকটাই ক্ষয়প্রাপ্ত ও শ্রীহীন।

শিয়ালদহ-কৃষ্ণনগর শাখার রানাঘাটের পরে একটি স্টেশন পরে যার নাম বীরনগর, এটিই প্রাচীন উলা গ্রাম। বর্তমান বীরনগর আসলে উলা গ্রামের নামান্তর মাত্র। ১৮০০ খ্রীষ্টাব্দে ব্রিটিশ সরকার উলা গ্রামের বাসিন্দাদের সম্মিলিত এবং বীরত্বপূর্ণভাবে একটি ডাকাতির ঘটনা প্রতিহত করতে দেখে মুগ্ধ হয়ে, সম্মানের নিদর্শনস্বরূপ উলা গ্রামটির নাম পরিবর্তন করে রাখে বীরনগর অর্থাৎ বীরদের নগর। এমন কথা মুখে মুখে প্রচলিত রয়েছে এই এলাকায়।

Related Articles