চায়ের দোকানে গ্রাহকই বানাচ্ছেন চা! অদ্ভুত দৃশ্য শ্রীরামপুরের এক চায়ের দোকানে
Customers are making tea at a tea shop! Strange scene at a tea shop in Serampore

Truth Of Bengal: হুগলি, রাকেশ চক্রবর্তী: একটি চায়ের দোকান৷ সেখানে একজন ব্যক্তি চা-বানাচ্ছে৷ সাধারণের দৃষ্টিতে তিনি দোকানের মালিক বা কর্মচারী বলে মনে হবে৷ কিন্তু, আদতে তা নয় ৷ যিনি চা-বানাচ্ছেন, তিনি নিজেই একজন গ্রাহক৷ এমনই এক চায়ের দোকানের হদিশ মিলল হুগলি জেলার শ্রীরামপুরের কালীবাবুর শ্মাশানঘাটের সামনে৷
কিন্তু, একজন গ্রাহক কেন চা-বানাচ্ছেন? জানা গেল, এই দোকানের কোনও মালিক নেই৷ তাই স্থানীয় বাসিন্দারা এসে পালা করে চায়ের দোকান চালান৷ স্থানীয় খদ্দেররা নিজে হাতেই চা ঢেলে নেন৷ এমনকি শ্মশানে আসা লোকজনকে চা পরিবেশনও করেন স্থানীয়রা৷ এই দোকানে এখনও মাত্র পাঁচ টাকায় পাওয়া যায় দু’কাপ চা৷
যে যখন দায়িত্বে থাকেন, তাঁরাই সকালে-বিকেলে দোকান খোলেন ও বন্ধ করেন৷ বেচাকেনা শেষে সারাদিনের চা-বিস্কুট বিক্রির টাকা ক্যাশবাক্সে রেখে যান৷ সেই টাকা চায়ের দোকান চালাতেই খরচ করা হয় ৷ সেখানে লাভ-লোকসান বা ভাগবাটোয়ারার প্রশ্ন নেই৷ দিনের পর দিন স্থানীয়রা স্বেচ্ছায় শ্রম দিয়ে যাচ্ছেন৷ শ্মশান লাগোয়া এই চায়ের দোকান থেকে প্রাপ্তি, পাড়ার গুটি কয়েক মানুষের সকাল-সন্ধের আড্ডা ও গল্প৷
তবে, এই দোকানে শুরু থেকে চা বিক্রি হত না ৷ এমনকি এই দোকান মালিকবিহীনও ছিল না ৷ স্থানীয়রা জানাচ্ছেন, ২৫০ বছরের পুরনো এই দোকান ঘরটি ৷ শ্রীরামপুরে চাতরা বাজারে অবস্থিত এই চায়ের দোকানে আগে ঘট, কলসি বিক্রি হত ৷ সময়ের সঙ্গে সেই দোকান উঠে যায় ৷ পরিবারের কেউ আর সেই দোকান চালায়নি ৷ দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর, স্থানীয় এক ব্যক্তি নরেশ সোম চায়ের দোকান খোলেন সেখানে৷
প্রথম দিকে ঘুগনি, আলুর দম, চা বিক্রি হলেও বর্তমানে শুধু চা ও বিস্কুট বিক্রি হয়৷ নরেশ সোমের মৃত্যুর পর স্থানীয়রাই দোকান চালানোর দায়িত্ব নিয়েছেন৷ প্রায় একশো বছর ধরে এভাবেই চলে আসছে মালিকবিহীন দোকান৷ অবসর জীবনে কাটানো বয়স্ক মানুষজন এই দোকানে আড্ডা দেওয়া, চা-খাওয়ার সঙ্গে দোকানদারিও করেন৷
তেমনই একজন আশিস বন্দ্যোপাধ্যায়৷ তিনি দীর্ঘদিন ধরে চালিয়ে আসছেন এই চায়ের দোকান৷ আগে বেসরকারি সংস্থার চাকরি করতেন৷ অবসরের পর এই দোকান সামলান৷ তিনি বলেন, “সকাল ন’টা থেকে আমি দোকানে থাকি৷ দুপুরে বন্ধ করে দিলেও আবার বিকেল তিনটে থেকে দোকান খুলি৷ সপ্তাহে সবদিন না-হলেও, বেশিরভাগ সময়টা এখানেই কাটাতে চলে আসি৷ আমার সময় শেষ হলে অন্যজন এসে দায়িত্ব নেয়৷ এখানে সকলেই পেনশন হোল্ডার ৷”
তিনি বলেন, “৬০ থেকে ৭০ বছরের সবাই এখানকার চা খেয়ে আড্ডা দেন৷ কালীবাবুর শ্মশানঘাটের যাত্রীরা এই দোকানেরই খদ্দের এছাড়াও আশেপাশের স্থানীয় লোক দোকানের চা খেতে আসেন৷ সারাদিনে প্রায় তিনশো কাপ চা বিক্রি হয়৷ এখানে কাজের লোক কেউ নেই৷ নির্দিষ্ট সময়ে এসে প্রত্যেকেই তাঁর দায়িত্ব সামলে যান ৷”
এভাবেই দোকান সামলান বিশ্বনাথ দে৷ তিনি বলেন, “১০-১২ জন মিলে আমরা দোকান চালাই৷ এই দোকানে কাস্টমার ফেরত যায় না৷ যে যখন সময় পায়, সে এসেই দোকান সামলে যায়৷ ভোর চারটে থেকে দোকান খোলে, চলে রাত দশটা পর্যন্ত৷ তারমধ্যে শ্মশানঘাটের যাত্রীরা এলে, এগারোটা-বারোটা হয়ে যায়৷ আমাদের কারও বিরক্তভাব নেই৷ তাহলে অনেকদিন আগেই এই দোকান বন্ধ হয়ে যেত৷ এখানে মালিক বলে কেউ নেই৷ একজন শুধু দায়িত্বে থাকেন৷ সকলের বিশ্বাসের উপরেই এই দোকান চলে৷ আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম এই চায়ের দোকান সামলানোর জন্য এসে গেছে৷ এখানে চা-করার জিনিসপত্র পরিষ্কার করা থেকে, দুধ-চিনি আনা সবকিছুই করতে হয় সকলকে৷”
চা-দোকানের আরেক সদস্য অশোক চক্রবর্তী বলেন, “চায়ের দোকানের কিছুটা দায়িত্ব আমি নিয়েছি৷ আর যে যখন থাকে, সেই দায়িত্ব নিয়ে দোকান চালায়৷ দোকানে বিক্রির টাকা ক্যাশ বাক্সে থাকে৷ সেখান থেকেই খরচ করা হয়৷ আমি চাকরি করি বলে সবসময় থাকতে পারি না৷ সকালে আটটা পর্যন্ত থাকি৷ আবার সন্ধে বেলায় এসে দোকানের কেনাকাটা করি৷”
আট বছর ধরে এই দোকানের চা খাচ্ছেন বলরাম চক্রবর্তী৷ তিনি বলেন, “বিভিন্ন সময় বিভিন্ন লোক থাকে৷ কিন্তু, চায়ের কোয়ালিটি একই রয়ে যায়৷ ৫ টাকার চা তিন-চারজন মিলে খাওয়া যায়৷ এই দোকানে এলে খদ্দেররাই নিজেদের ইচ্ছামতো চা নিয়ে, টাকা দিয়ে চলে যায়৷”