সিপিএমের ঝুলি থেকে বেড়াল বেরিয়ে পড়ল
CPME was keeping these protests and doctors' movement alive for so long

Truth of Bengaol, সুমন ভট্টাচার্য: শৈশবে এবং কৈশোরে আমরা উত্তর শহরতলির যে জায়গাটায় থাকতাম, সেটা সিঁথি নামে পরিচিত। বরাহনগর পুরসভার এলাকা। আমার এখনও মনে আছে, বরাহনগর পুরসভার ২৪ নম্বর ওয়ার্ডে যেখানে আমরা থাকতাম, সেখানে ধারাবাহিকভাবে কংগ্রেস নির্বাচনে জিতত। একবার পুরসভা নির্বাচনের সময় সিপিএম গণ্ডগোল করতে পারে এই আশঙ্কায় আমার বাবা, আমার বৃদ্ধা ঠাকুমা আর মাকে বুথে এজেন্ট হিসেবে বসিয়েছিল।
তাতে বিকেল অবধি ঝামেলা না হলেও, একেবারে শেষ প্রহরে এসে দেখা গেল বহিরাগতরা বুথে ঢুকে ঝামেলা এবং ভাঙচুর করল। আমার বৃদ্ধা ঠাকুমার চশমা পর্যন্ত ভেঙে গিয়েছিল। কিন্তু যেহেতু বহিরাগত, সেহেতু কেউ বুঝে উঠতে পারছিল না, যে কারা গণ্ডগোলটা করেছে। পাড়ায় এই নিয়ে খুবই শোরগোল, কারা এসে দুই মহিলাকে এহেন মারধর, অত্যাচার করল।
অনেক রাতের দিকে আমাদের পাড়ার সিপিএম নেতা বাড়িতে ক্ষমা চাইতে এলেন। আমার এখনও মনে আছে, বাবা হাসতে হাসতে ঠাকুমাকে বলেছিলেন, শেষপর্যন্ত সিপিএমের ঝুলি থেকে বেড়ালটা বেরিয়েই পড়ল। কারা মারধর করেছিল, কারা গণ্ডগোল পাকিয়ে ভোট নষ্ট করে দিতে চেয়েছিল, সেটা সিপিএমের এই ক্ষমাপ্রার্থনা থেকেই বোঝা যায়।
শুক্রবার আরজি কর নিয়ে নাগরিকদের প্রতিবাদ মিছিলে সিপিএমের যুব নেতা এবং এসএফআই নেত্রীর ছবি দেওয়া ‘ব্যানার’ দেখে আবার আমার বাবার কথাটা মনে পড়ে গেল। শেষ পর্যন্ত সিপিএম ঝুলি থেকে তাদের বেড়ালটা বারই করে ফেলল। গত ৫০ দিন ধরে কলকাতা শহর যে নাগরিক সমাজের বিক্ষোভ বা আন্দোলন দেখেছে, তার পিছনে যে সিপিএম বা অতি বামেদের মদত রয়েছে, সেই নিয়ে অনেক দিন ধরেই রাজ্যের শাসকদল তৃণমূল অভিযোগ করে আসছে।
কিন্তু তার কোনও প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছিল না। শুক্রবার যেদিন জুনিয়র ডাক্তারদের শেষ মিছিল ছিল একদিকে সিবিআই দফতরের দিকে, সেই দিনই যখন দক্ষিণ কলকাতার হাইল্যান্ড পার্ক থেকে আরজি কর অবধি প্রতিবাদ মিছিলের ডাক দেওয়া হয়েছিল, এবং তাও আবার ‘নাগরিক সমাজের উদ্যোগ’ বলে বিজ্ঞাপিত করা হয়েছিল।
সেই নাগরিক সমাজের উদ্যোগে যখন সিপিএমের যুবনেতা এবং এসএফআই নেত্রীর ছবি দেওয়া ‘ব্যানার’ দেখা গেল, তখনই বোঝা গেল, যে আসলে সিপিএমই এত দিন ধরে এই বিক্ষোভ এবং ডাক্তারদের আন্দোলনকে জিইয়ে রাখছিল। এই যে বারবার জুনিয়র ডাক্তাররা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ি কিংবা নবান্ন পর্যন্ত যাচ্ছিলেন এবং তাতেও কর্মবিরতি প্রত্যাহার করছিলেন না, তার পিছনে আসলে কাদের মদত ছিল, সেটা শুক্রবারের পর পরিষ্কার হয়ে গেল।
৩৪ বছর পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় থাকা সিপিএম পালাবদলের পর বিদায় নিয়েছে ২০১১ সালে। কিন্তু ২০১৯ থেকে পশ্চিমবঙ্গে প্রধান বিরোধী দলের জায়গাটি দখল করে নিয়েছে বিজেপি। আর ২০১৯-এর লোকসভা, ২০২১-এর বিধানসভা এবং ২০২৪-এর লোকসভাতেও পশ্চিমবঙ্গে সিপিএমের ঝুলিটি শূন্য। কিন্তু ‘ফাঁকা কলসির আওয়াজ বেশি’। সিপিএমের ভোট শতাংশ নামতে নামতে ৫ শতাংশে চলে গিয়েছে।
কিন্তু তারা এখনও ফেসবুকে, সোশ্যাল মিডিয়ায় এবং সামাজিক স্তরে নিজেদের দাপট দেখাতে ছাড়ে না। তাদের তীব্র মমতা বিরোধিতা এবং তৃণমূলের শাসনকে মেনে না নিতে পারা আসলে একধরনের অসূয়ার জন্ম দিয়েছে। এবং সেই অসূয়া থেকে তারা এটাও ভুলে যায়, যে তাদের রাজনৈতিক কার্যকলাপ আসলে পরোক্ষে বিজেপির লাভ করে দিচ্ছে। সিপিএমের থেকে ২৩ শতাংশ ভোট বিজেপিতে গিয়েছে, অর্থাৎ বামের ভোট ফুটকি দিয়ে রামে চলে গিয়েছে।
কিন্তু সেখানেও সিপিএমের দম্ভের শেষ নেই। সিপিএমের রাজ্যসভার প্রাক্তন সাংসদ এবং আইনজীবী নেতা বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য মনে করেনযে, কেন্দ্রীয় এজেন্সি দিয়েই পশ্চিমবঙ্গ থেকে তিনি তৃণমূলের শাসনকে উৎখাত করে দেবেন। আর তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গরা আরও দাপটের সঙ্গে টেলিভিশনে এসে চিৎকার করেন। খেয়ালও রাখেন নাযে, ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনে বিকাশ ভট্টাচার্যের যেসব সঙ্গীসাথীরা প্রার্থী হয়েছিলেন, কী নিদারুণভাবে তাঁদের জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছে।
বন্যেরা বনে সুন্দর, শিশুরা মাতৃক্রোড়ে, আর বামেরা ফেসবুকে। ২০১৬-র পরবর্তী সময় থেকে সেটাই আমরা জেনে এসেছি। এবার আরজি করে একটা জঘন্য অপরাধ হওয়ার পর থেকে দেখলাম সেই ফেসবুকের বিপ্লবী বামেরা একেবারে নিজেদের প্রমাণ করতে রাস্তায় নেমে এসেছে। সেটা অবাক হওয়ার বিষয় নয়। আমরা যখন ৩০ বছর আগে কলেজে বা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তাম এবং যেটা বামেদের তথাকথিত ‘আঁতুড়ঘর’ বলে পরিচিত, সেই প্রেসিডেন্সি আর যাদবপুরে, তখন দেখতান ভেনেজুয়েলায় সরকার বদল হলেও এসএফআই পতাকা নাড়ছে।
কেন সেটা তারা জানত না। আর এবার তো ঘরের পাশে বাংলাদেশে পালাবদল হয়ে গিয়েছে, শেখ হাসিনাকে হেলিকপ্টারে চড়ে দেশ ছেড়ে চলে যেতে হয়েছে। অতএব, ফেসবুকের বিপ্লবী বামেরা মনে করে নিলেন পশ্চিমবঙ্গেও বিপ্লবের দিন সমাগত, এবার তাঁরাই গিয়ে গুটি গুটি পায়ে নবান্নে কিংবা থুড়ি তাঁদের ‘পুরোনো আস্তানা’ লালবাড়ি, রাইটার্স বিল্ডিং থেকে আবার প্রশাসন চালাবেন।
এই দিবাস্বপ্ন দেখে তাঁরা যে তাণ্ডব শুরু করলেন, সেই তাণ্ডবের কারণে গত দেড় মাস ধরে পশ্চিমবঙ্গে এক ‘নৈরাজ্য’ চলেছে। পুলিশ আক্রান্ত হয়েছে, মেরে পুলিশের চোখ ফাটিয়ে দেওয়া হয়েছে, মহিলাদের উপর অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গিয়ে এক অভিনেত্রী, রীতিমতো সেলিব্রিটি ঋতুপর্ণা সেনগুপ্তকে চরম হেনস্থা করা হয়েছে, এক মহিলা পুলিশকর্মী শম্পা প্রামাণিকের মেরে মুখ ফাটিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাতে কী? বিপ্লবী বাম এবং সিপিএম তো এই সুযোগে আবার পশ্চিমবঙ্গে লাল পতাকার বিজয়কেতন ওড়ানোর স্বপ্ন দেখতে পাচ্ছিল।
ফেসবুকের বামেদের এই বিপ্লবগাথায় যোগ দিয়েছিলেন সেইসব ডাক্তার নেতারা, যাঁরা সিপিএমের আমলে উত্তর শহরতলি থেকে বাইপাস পর্যন্ত ফুলে ফেঁপে উঠেছিলেন। এদের কেউ কেউ একসময় সিপিএমের কার্ড হোল্ডার ছিলেন। তারপর নিজেদের বাড়ুজ্জ্যে পদবি ভাঙিয়ে জমি এবং সিপিএমের সাংসদের আনুকূল্য লাভ করে নিজস্ব বিরাট হাসপাতাল ব্যবসা ফেঁদে বসেছিলেন।
তারপর সেই ব্যবসা বেচে দিয়ে আরও মোটা টাকা নিয়ে নিজেদের পসার চালিয়ে গিয়েছেন। কেউ কেউ বা দক্ষিণ শহরতলিতে সিপিএমের প্রাক্তন মন্ত্রী এবং শ্রমিক দরদি নেতার সহযোগিতায় বিরাট জমিতে আরও বড় হাসপাতাল ফেঁদে ব্যবসা করেছেন এবং করোনার সময় কোটি কোটি টাকা লাভ করেছেন। সেইসমস্ত তথাকথিত ‘নাগরিক মুখ’দের গত ৫০ দিন ধরে আমরা এয়ার কন্ডিশন স্টুডিওতে বসে বিভিন্ন ধরনের তাত্ত্বিক কথাবার্তা বলতে দেখেছি।
দুঃখের বিষয়, মধ্যবিত্তের দখলে থাকা সিপিএম বহুদিনই গরিব মানুষের কথা ভুলে গিয়েছে। তাই সিপিএমে এই ডাক্তার নেতারাও সরকারি হাসপাতালে এসে কেন প্রান্তিক মানুষদের ফিরে যেতে হচ্ছে, কেন সফিকুল ইসলাম বা আবিদা সুলতানারা বিনা চিকিৎসায় মারা যাচ্ছেন, সেই নিয়ে টুঁ শব্দটি উচ্চারণ করেননি। বরং তাঁরা ক্রমাগত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করে গিয়েছেন। এবং এমন ভাব দেখিয়েছেন, যেন এবারই তাঁরা তৃণমূল সরকারকে রাজ্য থেকে উৎখাত করে দেবেন।
বামদের ‘বিধি বাম’। বামেদের এই অতি তৎপরতা দেখে আরএসএস নিজেই বলে দিল, যে তারা পশ্চিমবঙ্গে রাষ্ট্রপতি শাসন চায় না। আর বামেরা গলাধাক্কা দিয়ে তাড়াল বিজেপির দুই ‘পোস্টার বয়’ এবং ’পোস্টার গার্ল’কে, অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় এবং অগ্নিমিত্রা পালকে৷ বাধ্য হয়ে বিজেপির পরিষদীয় দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী এই আন্দোলনের পিছনে নাকি বিভিন্ন ধরনের প্রভাব রয়েছে বলে মন্তব্য করে দিলেন।
বাম, অতি বামদের সঙ্গে বিজেপির দূরত্ব তৈরি হয়ে যাওয়ার কারণে নাগরিক আন্দোলন যে ক্রমশ শুধুমাত্র সিপিএম এবং তার কিছু মদতপুষ্ট ডাক্তারদের আন্দোলন হচ্ছিল তা তৃণমূল অনেকদিন ধরেই বলছিল। কিন্তু ঝুলি থেকে সেই বেড়াল বেরিয়ে পড়ল সিপিএমের যুবনেতার জামিন পাওয়ার পরে। উৎসাহের আতিশয্যে সিপিএম আর নিজেকে সামলাতে পারল না। একেবারে নাগরিক মিছিলে নিজেদের নেতানেত্রীদের ছবি দিয়ে ‘ব্যানার’ নিয়ে নেমে পড়ল।
শুক্রবার মধ্যরাত অবধি দেখছিলাম, প্রেসিডেন্সি-যাদবপুরের বিভিন্ন এলিট গ্রুপেও এই নিয়ে তুমুল উত্তেজনা। যাঁদের সিঙ্গুর, নন্দীগ্রাম কিংবা সুশান্ত ঘোষ, বিনয় কোঙারদের মনে আছে, তাঁরা অবশ্যই ভাবছিলেন যে তাহলে কি আবার সিপিএম ক্ষমতা দখলের চেষ্টা করছে? সিপিএম ফিরে আসছে শুনেই, এমনকি তথাকথিত নাগরিক সমাজের যে উত্তেজনা এবং উদ্বেগ, তা যদি আলিমুদ্দিন স্ট্রিট বুঝত তাহলে সম্ভবত এই হারিকিরি করত না।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তৃণমূল নেতৃত্ব অনেকদিন ধরেই অভিযোগ করে আসছিলেন নাগরিক আন্দোলনের নামে আসলে সিপিএমের অধ্যাপককুল, তাঁদের ডাক্তার নেতৃত্ব এবং তাঁদের মদতপুষ্ট আরও কিছু বুদ্ধিজীবী ‘বাজার’ এ নেমে পড়েছেন। যিনি সিরিয়ালে কাজ পান না, তিনি বিপ্লবী গান গাইছেন, যিনি সাহিত্যে জায়গা পান না, তিনি ভাবছেন এই করে যদি বড় কাগজে উপন্যাস লেখার ডাক আসে।
এই বামেদের কল্যাণেই গত ৫০ দিন ধরে পশ্চিমবঙ্গ এক নৈরাজ্য দেখেছে, যে নৈরাজ্যে সরকারি হাসপাতালে ৩০ জন প্রান্তিক মানুষের মৃত্যু হয়েছে। দুঃখের বিষয়, কফি হাউসে যা নিয়ে তুফান ওঠে, তা যে কোন্নগর বা কোচবিহারকে স্পর্শ করে না, তা আজকের বাম নেতৃত্ব বোঝেন না। সেইজন্য কোন্নগরের বিক্রম ভট্টাচার্য কিংবা রিষড়ার রাজীব দাসের মৃত্যুতে তাঁরা আলোড়িত হন না।
বরং অতি বাম চিকিৎসক নেতারা বলে দেন বড় আন্দোলনে এইসব ‘ছোটখাটো ঘটনা’ ঘটতেই থাকে। কিন্তু এই যে নাগরিক আন্দোলনের ছদ্মবেশে বাংলাদেশ থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে যাঁরা নৈরাজ্য তৈরির চেষ্টা করছিলেন, তাঁদের আসল চেহারাটা শুক্রবারের নাগরিক মিছিলে সিপিএমের ‘ব্যানার’ দেখতে পাওয়ার পরে পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে।
কারা পুজো পালন করবেন, কারা প্রতিবাদ করবেন, সেটা তাঁদের একান্তই ব্যক্তিগত ব্যাপার। আমরা, যাঁদের ৫০-এর একটু কাছাকাছি বয়স, তাঁদের মনে আছে একসময় সিপিএম পুজো সম্পর্কে কত বড় বড় কথা বলে তারপর পুজোমণ্ডপের চারপাশে নিজেদের বই বিক্রির জন্য স্টল সাজাত। কিংবা সুভাষ চক্রবর্তী কীভাবে তারাপীঠে পুজো দিতে চলে যেতেন।
আবারও মনে করাতে চাই, যাঁরা পুজো দেবেন, তাঁরা পুজো দেবেন, যাঁরা প্রতিবাদ করবেন, তাঁরা প্রতিবাদ করবেন। কিন্তু যেসব ডাক্তার নেতা প্রতিবাদের কথা বলে, নিজেদের ব্যাগপত্র গুছিয়ে বেড়াতে চলে গিয়েছেন, তাঁদের মুখে এইসব সামাজিক দায়বোধের কথা মানায় না।
আসলে বাম বা প্রগতিশীল আন্দোলনের যে কোনও শিকড় নেই, তাঁরা যে আসলে একটা শিকড়হীন অস্তিত্বে বাঁচে সেটাই আবার নৈরাজ্য সৃষ্টির চেষ্টা প্রমাণ করে দিল। জুনিয়র ডাক্তারদের নিরাপত্তার দাবি থাকতে পারে, আরজি করের জন্য সবাই নির্যাতিতার বিচার চায়, কিন্তু তাই বলে প্রান্তিক মানুষদের চিকিৎসাকে উপেক্ষা করে যাঁরা নৈরাজ্য কায়েম করার চেষ্টা করেছিলেন, তাঁরা আসলে কারা, শেষ পর্যন্ত সিপিএম সেটাই প্রমাণ করে দিল।