লাউ দিয়ে সেতার বানানো শিল্পী গণেশচন্দ্র, কেমন আছেন তিনি
Artist Ganesh Chandra, who made a sitar out of gourds, how is he?

Truth Of Bengal: হুগলি জেলার জাঙ্গিপাড়া বিধানসভার রসিদপুর পঞ্চায়েতের অন্তর্গত পশপুর গ্রাম। যাকে অনেকেই লাউগ্রাম বলেই জানেন। এই গ্রামের বাসিন্দা গনেশচন্দ্র রায় একজন বিখ্যাত লাউচাষি। পাশাপাশি তিনি একজন বাদ্যশিল্পীও। লাউচাষ করার পাশাপাশি লাউয়ের তৈরি নানা বাদ্যযন্ত্র, যেমন সেতার, তানপুরা, বীণার টিউনার ছিলেন তিনি।
ব্যবসা সূত্রে গণেশবাবুকে প্রায়ই যেতে হতো কলকাতা ছাড়াও দিল্লি, মহারাষ্ট্র ,এলাহাবাদ, লখনউ,পাঞ্জাব প্রভৃতি জায়গায়। সে সময় মহারাষ্ট্রের পাণ্ডলপুরে তানপুরা, সেতার প্রভৃতি বাদ্যযন্ত্র তৈরির উপযুক্ত লাউ পাওয়া যেত। তিনি মহারাষ্ট্রের মিরাজ (পাণ্ডলপুর) থেকে লাউয়ের বীজ এনে এখনকার বীজের সঙ্গে ক্রসব্রিড পদ্ধতিতে উন্নত জাতের লাউ তৈরি করেছিলেন। তিনি বলেন, তাঁর তৈরি বাংলার এই লাউ মিরাজকে টেক্কা দিয়েছিল। সেই সময় তানপুরা বা সেতার তৈরির জন্য মিরাজের লাউ কেউ আর তেমনভাবে কিনত না।
আগে দামোদরের পূর্ব পাড় অবস্থিত হুগলি জেলার জঙ্গিপাড়া থানার পশপুর, রঞ্জপুর, চকগড়া,পালিয়াড়া (হাওড়া জেলা) গ্রামে ব্যাপকহারে হত এই লাউ চাষ। এখন আর সেভাবে হয় না। তবে তানপুরা বা অন্যান্য বাদ্যযন্ত্র তৈরির এই লাউ এখন পশপুর গ্রামেই বেশি চাষ হয়। গনেশবাবুর কথায়, আগে যেসব জমিতে ব্যাপকভাবে লাউ চাষ হতো, সেইসব জমির অধিকাংশ অংশেই এখন বিকল্প বা অন্য চাষ করতে হচ্ছে। সেতার, তানপুরা তৈরির লাউয়ের খোল এখনও বিক্রি করেন গনেশবাবু, তবে খুবই অল্প স্বল্প।
কিন্তু কিভাবে তৈরি করতে হয় এই বিশেষ ধরনের লাউ? সে প্রসঙ্গে গণেশবাবু জানালেন, জমিতে বীজ ফেলতে হয় ভাদ্র-আশ্বিন মাসে। বীজ থেকে উৎপন্ন চারা তুলে রোপণ করা হয় একমাস পরে কার্তিক মাসে। লাউ মাচাতে হয় আবার মাটিতেও হয়। মাটি ভেঙে সমান করেপ্লাস্টিকের পাত্র বা থালা জাতীয় কিছু লাউয়ের নিচে বসাতে হবে,যাতে লাউয়ের তলার অংশটি গোলভাব বা সমান হয়। চৈত্র মাসে লাউ তোলা হয়। লাউ তোলার পর বাড়িতে এনে এক সপ্তাহ পর মুখ কেটে লাউয়ের বীজ ও সশ্যল অংশ পৃথক করে নিতে হয়। ৫-৭ দিন পরে জলে ফেলা হয় লাউয়ের খোল। জলে ৭ দিন থাকার পর তা তুলে নিয়ে ভালভাবে পরিষ্কার করে শুকনো জায়গায় রাখতে হয়। তারপর শুকনো করে ওই লাউ খোল গোডাউনে রাখা হয়।
এগুলির বিভিন্ন মাপ বা সাইজ সম্পর্কে তিনি জানালেন, লেডিজ তানপুরা ৪৭ ইঞ্চি বেড় (বি-ফ্ল্যাট) সি-সার্ফ বাড়ে তিন তানপুরা (৫৮ ইঞ্চি-৬০ ইঞ্চি বেড়) পৌনে চার তানপুরা। আবার বীণা (৫৮ ইঞ্চি-৬০ ইঞ্চি বেড়), সুর বাহার (৫০ ইঞ্চি-৫৩ ইঞ্চি বেড়)। তিনি আরও জানালেন, এ দেশের লাউ হল ইন্ডিয়ান মিউজিক্যাল ইন্সট্রুমেন্ট প্রোডাক্ট। লাউ থেকে তৈরি করা হয় সেতার, তানপুরা, বীণা (বার্তা বীণা, রুদ্র বীণা, সরস্বতী বীণা), একতারা, সুরবাহার প্রভৃতি বাদ্যযন্ত্র। ওইসব বাদ্যযন্ত্রগুলি সম্পর্কে তাঁর ধারণা যে কত স্পষ্ট, তা বোঝা গেল তাঁর কথায়।
তিনি বলেন, মোট দ্বাদশ (১২) স্বর আছে, যেগুলির দ্বারা সঙ্গীত জগৎ পরিচালিত হয়। তার মধ্যে শুদ্ধ স্বর সাতটি,পাঁচটি বিকৃত স্বর। এই দ্বাদশ স্বরকে কন্ট্রোল করে যে,তার নাম তানপুরা। তানপুরা ও সেতারের মধ্যে তফাৎ সম্পর্কে বললেন, তানপুরা তৈরিতে লাগে বড় লাউয়ের সঙ্গে ঘোড়া নিমকাঠ (মোটা ডান্ডি)-এর মোড় বা সংযুক্তি ,৪-৬ টা তার। সুর কন্ট্রোল করে তানপুরা। সেতার তৈরিতে লাগে মোট লাউয়ের সঙ্গে ঘোড়া নিমকাঠ (পাতলা ডান্ডি)-এর মোড়,২২টি তার। সেতারে সব গানই বাজানো যায়। সেতার হল মিউজিক যন্ত্র। এটিকে আজও কেউ অকেজো করতে পারেনি। গানবাজনা শিখতে হলে তানপুরাকে অবশ্যই সঙ্গী করতে হবে।
দামোদর বাঁধের পূর্ব পাড়ে অবস্থিত পশপুর বাংলো। বাংলোর কিছুটা আগে পূর্ব দিক বরাবর একটি ঢালাই রাস্তা নিচের দিকে নেমে গিয়েছে। ওই রাস্তা ধরে কিছুটা গেলেই গণেশবাবুর বাড়ি। গ্রামের সকলেই তাঁকে একডাকে চেনেন। অসম্পূর্ণ দু’তলা বাড়ি, বেশ বড়সড় বাড়িটি। সারা বাড়ি জুড়ে পড়ে রয়েছে ছোট-বড় নানান সাইজের অসংখ্য লাউয়ের খোল (তুম্বা)। কথায় কথায় তিনি জানালেন, ‘বাবার আমল থেকেই আমাদের লাউ চাষ শুরু। সেসময় আমাদের প্রায় দশ বিঘা জমিতে লাউ চাষ করা হত। এখন মন্দার বাজার, খুবই সামান্য অংশে লাউ চাষ করি। লাউয়ের কদর আর আগের মত নেই। আমাদের দুর্দশার সীমা নেই, খেতে পর্যন্ত পারছিনা এখন।’ খুবই আক্ষেপের সঙ্গে কথাগুলি শোনালেন গণেশবাবু।
আগে গণেশবাবুর বাড়িতেই তৈরি হতো লাউয়ের তানপুরা, সেতার প্রভৃতি বাদ্যযন্ত্র। এখন অবশ্য তা আর হয় না। এখন পশপুর গ্রামের সুশীল মিদ্দে, দিনু দোয়ারী তৈরি করেন লাউয়ের খোল থেকে সেতার, তানপুরা প্রভৃতি বাদ্যযন্ত্র। তবে তাঁরা সেতার বা তানপুরার শুধুমাত্র বডি তৈরি করেন। পশপুর গ্রাম থেকে লাউ (লাউয়ের খোল বা তুম্বা) চালান যায় উলুবেড়িয়া, বরানগর,বেলঘড়িয়া,মধ্যমগ্রাম প্রভৃতি জায়গায়। ওইসব জায়গাতেই তৈরি হয় সম্পূর্ণ সেতার বা তানপুরার মত বাদ্যযন্ত্রগুলি। বর্তমানে বসপুর গ্রামের গণেশ রায়, তড়িৎ সিং, কাশি হাজরা এবং পাশের রঞ্জপুর গ্রামের নিতাই থামারীর মতো গুটিকয়েক ব্যক্তি লাউ চাষ করেন।
গণেশবাবু বললেন, লাউ থেকে তৈরি সেতার, তানপুরা বা অন্যান্য বাদ্যযন্ত্রের সেই সোনালী অতীত আজ আর নেই। বর্তমানে ইলেকট্রনিক ইন্সট্রুমেন্টের দাপটে ক্রমশই হারিয়ে যাচ্ছে বঙ্গীয় প্রযুক্তিতে তৈরি লাউয়ের সেতার, তানপুরা বা বীণার মত বাদ্যযন্ত্র। যা খুবই চিন্তার বিষয়। কথায় কথায় গণেশবাবু জানালেন, পণ্ডিত রবিশঙ্করই হচ্ছেন (সেতার) শিল্পী হিসাবে তাঁর কাছে আদর্শ। তিনি বলেন, পন্ডিতজি ভারতের বাইরে লন্ডন,আমেরিকা, প্রভৃতি দেশে গিয়ে লাউয়ের বাদ্যযন্ত্রগুলিকে জনপ্রিয় করে তোলেন। সে প্রায় আজ থেকে পঞ্চাশ বছর বা তারও আগে। সেসময় এক অনুষ্ঠানে পেয়েছিলেন পন্ডিত রবিশংকরের সান্নিধ্য।
নন-ম্যাট্রিক গণেশবাবুর কলকাতার সাউথ সিটিতে দোকান ছিল। বেনারসের লছমিকুণ্ডে দিলীপ শর্মার দোকানেও কাজ করেছেন বেশ কিছুদিন। ওই সব জায়গায় থেকে বিভিন্ন এলাকায় লাউ সরবরাহ করতেন। পরে কোনও এক সময় তিনি এলাহাবাদের সরমন্দিরে লাউয়ের এক প্রদর্শনীতে গিয়েছিলেন আমন্ত্রিত অতিথি হয়ে। কিছু বছর আগে খোদ লন্ডন থেকে সাহেবরা এসেছিলেন গণেশবাবুর গ্রামের বাড়িতে সাক্ষাৎকার নিতে। আগ্রহ দেখিয়েছিলেন তাঁর তৈরি বাদ্যযন্ত্রগুলি সম্পর্কে।অথচ এহেন একজন শিল্পী মানুষ আজ পর্যন্ত কোনওরকম সরকারি স্বীকৃতি পাননি। পাননি কোন সরকারি অনুদান বা পেনশন। জোটেনি কোনও সম্বর্ধনাও। থেকে গেলেন এরকম অবহেলিত শিল্পী হিসাবেই।