জগতের নাথ জগন্নাথের বিগ্রহ নির্মাণ কাহিনি বড়োই অদ্ভুত, কী সেই রহস্য
The story of the construction of the idol of Lord Jagannath, the Lord of the universe, is very strange, what is the mystery?

Truth Of Bengal: কলির দেব জগন্নাথ। কলিযুগে তাই নীলাচলে প্রভুর মন্দিরে সবারই সচ্ছন্দ গতি। তাঁর হাত নেই, তবু পলকহীন বিশাল চোখ দিয়েই টানেন সবাইকে। সেজন্যই তাঁর আরেক নাম ‘চকাডলা’। এই বিশাল, অর্ন্তভেদী চোখই যুগ যুগ ধরে টেনে এনেছে ভক্তকুলকে মন্দির প্রাঙ্গনে।
আপাতদৃষ্টিতে জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রা- তিন দেব-দেবীর রূপ সনাতন হিন্দু রীতি থেকে আলাদা। সাধারণত দেখা যায়, পাথর, ধাতু বা মাটি দিয়ে তৈরি হয়ে থাকে বিগ্রহের মূর্তি, কিন্তু জগন্নাথদেব কাঠ নির্মিত। জগন্নাথ দেব তাঁর বিচিত্র রূপ নিয়ে ভারতবর্ষের সব ধর্মের সব সম্প্রদায়ের নিজস্ব দেবতা হয়ে উঠেছেন। তিনি বৈষ্ণবের বিষ্ণু, শৈবের শিব, গাণপত্যের গণপতি, সূর্য উপাসকদের কাছে দিবাকর, শাক্তদের কাছে দক্ষিণা কালিকা।
বৌদ্ধরাও তাঁকে বুদ্ধের অবতার বলে মানেন। জৈনরাও মনে করেন তিনি জৈন ধর্মের আদি প্রবর্তক ঋষভনাথ। কথিত তিনি রত্নবেদীতে বিষ্ণু, শয়নকালে শক্তি দক্ষিণা কালিকা ,গমনে রুদ্র, স্নানবেদীতে বিনায়ক ও রথে সূর্য।
প্রভু যেমন বিরাটকায়-তাঁর থাকার স্থান বা মন্দিরটিও হবে তেমনই প্রকাণ্ড আর রহস্যময়। কোন কাহিনি জড়িয়ে আছে পুরীর মন্দিরের নির্মাণের সঙ্গে?
তখন দ্বাপর যুগের শেষ পর্ব। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ দেহত্যাগ করলেন জরা নামে এক শবরের তীরাঘাতে। ঘন অরণ্যে শ্রীকৃষ্ণ বটবৃক্ষমূলে বিশ্রামরত, আর ওদিকে শবর জরা হরিণ ভেবে তীর ছুড়ে বসলো। পায়ে তীর লেগে শ্রীমধুসূদন ওই অরণ্যেই দেহত্যাগ করলেন। বিলাপরত জরাকে স্বান্ত্বনা দিলেন স্বয়ং ভগবান। আর বন্ধু অর্জুনকে দিলেন কিছু নির্দেশ-শ্রীমদভগবদগীতায় যা বলা আছে। ‘ভগবানের হৃদয় অবিনশ্বর। নির্বিকল্প, সর্বব্যাপী। অতএব ভগবানের শরীর অস্থিতে পরিণত হলেও, আত্মা থাকবে চির ব্রহ্মের মতো অমর।
তুমি ওই আত্মাকে একটি কাষ্ঠখণ্ডের সঙ্গে ভাসিয়ে দাও সমুদ্রে। অর্জুন ঠিক তাই করলেন। শ্রীকৃষ্ণের আত্মা বা হৃত্পিণ্ড দ্বারকা থেকে কত মাস, কত দিন পার হয়ে ভেসে চলল। কেটে গেল বহু যুগ। আর সেই কাঠের টুকরো ভেসে উঠল এক সমুদ্র চরে। সেখানে জন্ম নিল উদ্ভিদ, ক্রমশ সমুদ্রতীর ঢেকে গেন ঘন অরণ্যে। স্পন্দিত হল প্রাণের শব্দ। অরণ্যচারী মানুষ এল সেই স্থানে। ‘এল’ বলা ভুল-আসলে সবই পূর্ব নির্ধারিত। অবশ্যম্ভাবী ছিল তাদের আসা।তারপর-সেই আরণ্যকদের নেতা বিশ্ববসু এক ফাল্গুনি পূর্ণিমায় শিকারে বেরিয়ে দেখতে পেলেন আরো গভীর অরণ্যে এক নীল আলোকশিখা।
খুঁজতে খুঁজতে হাজির হলেন সমুদ্রের ধারের এক বালিয়াড়ির টিলায়। সেখানে গিয়ে এক অপার্থিব নীল আলোয় ধাঁধিয়ে গেল তার চোখ। দেখলেন এক মাটির স্তূপের মাঝখানে আছে এক অতি উজ্জ্বল নীলাভ পাথর। তার দ্যুতিই ঠিকরে পড়ছে বনের চারিদিকে। বিশ্ববসু বুঝলেন এ কোনো সাধারন আলো বা পাথর নয়, স্বয়ং ভগবান বিরাজ করছেন। অবশ্য বিশ্ববসু ছাড়া কেই বা বুঝবেন এই কথা। দ্বাপরের জরা ব্যাধই তো কলিতে শবর বিশ্ববসু। আর ওই নীলকান্ত পাথর আর অন্য কিছু নয়-স্বয়ং ভগবান শ্রীকৃষ্ণের আত্মা।
ক্রমশ অরণ্যচারী বিশ্ববসু ও তার সহচরদের আরাধ্য দেবতা হয়ে উঠলেন নীলমাধব। কিন্তু যার অঙ্গুলিহেলনে জগত্সংসার চলে তিনি কি শুধুই বনবিহারী হয়ে থাকবেন? না, তা কী করে হয়। তাই কলি যুগে তার লীলায় শুরু হল আরেক কাহিনি। সূর্যবংশীয় রাজা অনঙ্গভীমদেব পুরীর মন্দিরটি নির্মাণ করেছিলেন ১১ একর জমির ওপর। কুর্মবেড় আর মেঘনাদ প্রাচীর নামে ২টি বিশাল প্রাচীর দিয়ে ঘেরা এই মন্দিরের ৪টি দ্বার-সিংহ, বাঘ, হস্তী ও অশ্ব। এই ৪টি দরজা বা দ্বার হল ধর্ম, বৈরাগ্য, জ্ঞান ও ঐশ্বর্যের প্রতীক।
জগন্নাথ, বলরাম, সুভদ্রা আর সিংহদ্বারের ২২টি সিঁড়ি মিলে সনাতন পঞ্চবিংশতি তত্ত্ব। এরপর মন্দিরে প্রবেশ করলে দেখা যাবে কালো পাথরের রত্নবেদী। এই রত্নবেদীতে অধিষ্ঠিত জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রা তিন বিগ্রহই নিমকাঠ নির্মিত, চন্দন আর ধুনোর আস্তরন দিয়ে রং করা বিগ্রহে জড়ানো থাকে সিল্কের কাপড়। গর্ভমন্দিরের পূর্বদিকের দ্বারের নাম কলাঘাট দ্বার। গভীর রাতে এর সামনের প্রাঙ্গনে হয় দেবদাসীদের নাচ গান। চৌকাঠের ওপর দিকে তাকালে দেখা যাবে নৃসিংহদেবমূর্তি। যাঁকে জগমোহন বলা হয়। এখান থেকেই বিগ্রহ দর্শন করা হয়। নাটমন্দিরের সামনের দরজার নাম জয় বিজয় দ্বার।