অফবিটকলকাতা

খাস কলকাতায় ইংরেজ সাহেবদের মৃতদেহ দাহ করা হত চুল্লিতে, জানেন কি সেই ইতিহাস!

Lower Circular Road Cemetery

The Truth of Bengal: তিলোত্তমা নগরী কলকাতা। এই শহরের বুকে জমে রয়েছে নানা ইতিহাসের পাহাড়। আজও চূড়ান্ত গতিময় ব্যস্ততার ভিড়ে সেইসব ইতিহাস কিছুটা ধুলোয় মিশে গিয়েছে, কিছু রয়ে গিয়েছে আড়ালে আবডালে। আচ্ছা একটা প্রশ্ন যদি করা হয়, যে খ্রিস্টানদের কি অগ্নিতে দাহ করা হয়? বা হত? প্রচীন প্রথার কথা মানলে, খ্রিস্টানদের অগ্নিতে দাহ করার কোনও রীতি নেই। কিন্তু একটা সময় এই কলকাতার বুকেই তৈরি হয়েছিল খ্রিস্টানদের দাহ করার শ্মশানঘাট। প্রশ্ন উঠতেই পারে, আচমকা কলকাতার বুকে কেন তৈরি করা হল খ্রিস্টানদের জন্য দেহ দাহ করার চুল্লি? ইতিহাস থেকে জানা যায়, কলকাতায় ইংরেজরা পাকাপাকি ভাবে বাণিজ্যের পাশাপাশি রাজধানী গড়তে শুরু করল, তখনই, বেশ কয়েকটি জায়গা তাঁরা নির্বাচন করেছিল কবরস্থান হিসেবে। পার্ক স্ট্রিট চত্বরে এমন বেশ কয়েকটি পুরনো কবরস্থান রয়েছে। যদিও তার মধ্যে কয়েকটি সময়ের গর্ভে হারিয়ে গিয়েছে, এবং সেখানে জন্ম নিয়েছে হাইরাজই বিল্ডিং, অফিসঘর, কলেজ, হাসপাতাল।

১৭৬৭ সালে কলকাতার পার্ক স্ট্রিটে তৈরি হয়, গ্রেট খ্রিস্টান বুরিয়াল গ্রাউন্ড। যার বর্তমান নাম সাউথ পার্ক স্ট্রিট সিমেট্রি। এখন এটি হেরিটেজ তকমা পাওয়ায় সংরক্ষিত স্থান হিসেবে বিবেচিত। এই সাউথ পার্ক স্ট্রিট সিমেট্রি সময়ের সঙ্গে আরও আশে পাশের কিছু এলাকা নিয়ে বহরে বাড়তে থাকে। পরে একটা সময় স্থান সংকুলান না হওয়ায়, সাউথ পার্ক স্ট্রিট সিমেট্রিকে বন্ধ করে দেওয়া হয়। তার জায়গায় কিছুটা দূরেই নতুন জায়গা দেখা হয়। ১৮৪০ সালে তৈরি হল, লোয়ার সার্কুলার রোড সিমেট্রি। সব ঠিকঠাকই চলছিল, কিন্তু উনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে এবং বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে, কলকাতায় দেখা দিল ভয়ঙ্কর রোগ প্লেগ। অত্যন্ত কম সময়ে তা মহামারির আকার নিল। আর এই রোগে আক্রান্ত হয়ে, দেশের সাধারণ মানুষ যেমন মারা গেলেন, তেমনই বহু ইংরেজ সেনা, কর্মীরাও মারা গেলেন। তাঁদের কবর দেওয়ার ক্ষেত্রে জায়গার অভাব দেখা দিল। পাশাপাশি দাবি উঠল, মৃতদেহগুলিকে পুড়িয়ে না দিলে, রোগের প্রাদুর্ভাব কিছুতেই কমবে না।

সেই প্রয়োজন থেকেই, তৎকালীন খ্রিস্টিয়ান বুরিয়াল বোর্ড সিদ্ধান্ত নেয়, একটা চুল্লি গড়ে তোলা হবে কোলকাতায়। বেছে নেওয়া হয় জেনারেল এপিস্কোপাল সেমেটারির অর্থাৎ লোয়ার সার্কুলার রোড সেমেটারির পিছনের একটা জায়গা। ১৯০৪ খৃস্টাব্দে এই চুল্লি বানানোর কাজ শুরু হয়। উদ্বোধন হয় ১৯০৬ সালে। নামকরণ হল খ্রিস্টান গ্যাস ক্রিমেটোরিয়াম। প্রসঙ্গত বলে রাখা ভালো, সেই সময় কলকাতা নব্য শিক্ষিত, ধনীদের হাত ধরে একটি নয়া ধর্মের জন্ম হয়েছিল। ব্রাহ্ম ধর্ম। তৎকালীন কুলীন ব্রাহ্মন সম্প্রদায় যেহেতু এই নয়া ধর্ম প্রচারকদের ঠিক পছন্দ করতো না, তাই, তাদের পরিবারের মৃতদেহ সাধারণ শ্মশানঘাটে পোড়ানোতেও ছিল নিষেধাজ্ঞা। অগত্যা, খ্রিস্টানদের তৈরি চুল্লিতেই তাঁদের দাহ করা হত।

চুল্লিটি বানিয়েছিল একটি ফ্রেঞ্চ কোম্পানী, নাম Toisoul Fradet & Co. , এই সংস্থা সেই সময় গ্যাস চুল্লি বানানোর ক্ষেত্রে বিশেষ পরিচিতি লাভ করেছিল। মোটামুটি ১০ ফুট লম্বা এই চুল্লিটির দুই দিকেই দরজা আছে, আর একটা ধাতব সিঁড়ির মতো দেখতে ট্রের মাধ্যমে মৃতদেহ চুল্লিতে ঢোকানো হয়। চুল্লির ভিতরে গ্যাসের পাইপের অনেকগুলো মুখ রয়েছে। এছাড়াও চুল্লিতে আগুন জ্বলার সময়ে, ভিতরের অবস্থা দেখার জন্য ছোট ছোট ঢাকনাওলা ফুটো রয়েছে চুল্লির বাইরের দুদিকের দেওয়ালে। চালু হওয়ার পরেই এই গ্যাস চুল্লি বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। স্যার জগদীশ চন্দ্র বসু যেহেতু ব্রাহ্ম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন, তাই তাঁর মৃত্যুর পর, তাঁকেও এই চুল্লিতে দাহ করা হয়। এই চুল্লি আটের দশকের পর্যন্ত ভালো চলতো। দুর্গাপুর থেকে টানা গ্যাসের লাইন এসেছিল খাস কলকাতায়। শহরে গ্যাসের বাতি যেমন জ্বলতো, তেমনই এই চুল্লিও চালু ছিল। কিন্তু ৭৮ সালের বন্যা, সেই পাইপ লাইন বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তারপর থেকে ধীরে ধীরে কলকাতায় ইলেক্টিফিকেশন শুরু হওয়ার পর থেকে, গ্যাসের সাপ্লাই বন্ধ হয়। ফলত, এই চুল্লিও বন্ধ করে দেওয়া হয়।