অফবিটলাইফস্টাইল

হারানো ঐতিহ্য কি ফিরে পাচ্ছে মুর্শিদাবাদের সিল্ক! ফিরে দেখা বাংলার রেশমের ইতিহাস

Murshidabad Silk History

The Truth of Bengal: ব্রিটিশ শাসনকালে কলকাতাকে রাজধানী তৈরি করার পিছনে সুনির্দিষ্ট কয়েকটি উদ্দেশ্য ছিল, তার মধ্যে অন্যতম ছিল, গোটা দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার শাসনব্যবস্থাকে যাতে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। এছাড়াও দেশীয় জাত পণ্য যাতে ইউরোপের বাজারে জনমুখী করে তোলা যায়, তারও বন্দোবস্ত করেছিল ব্রিটিশরা। পূর্বভারতের নীলচাষের জন্য যেমন একটি আদর্শ স্থান গড়তে পেরেছিল ব্রিটিশ বণিরা, তেমনই, তাঁদের কাছে মূল্যবান সোনা হিসেবে দেখা দিয়েছিল ভারতীয় সিল্ক বা রেশম। একটা সময় বাংলার মুর্শিদাবাদের সিল্কের চাহিদা ছিল গোটা ইউরোপ জুড়ে। সপ্তদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে অষ্টাদশ শতাব্দীতেও, বিভিন্ন ভারতীয় ব্যবসায়ী গোষ্ঠী ও ইউরোপীয় কোম্পানিগুলি বাংলা থেকে যে সমস্ত পণ্য ইউরোপে রফতানি করত। তার অন্যতম ছিল কাঁচা রেশম। পূর্বভারত থেকে যে সমস্ত পণ্য রফতানি হত, তার প্রথম সারিতে বস্ত্র থাকলেও, দ্বিতীয় সারিতে ছিল কাঁচা রেশন।

সপ্তদশ শতাব্দীর আগে থেকে অবশ্য ইংরেজ ও ডাচরা পারস্যদেশ বর্তমানে ইরান ও চিন থেকে ইউরোপে রেশম রফতানি করত। কিন্তু যখন বুঝতে পারল, বাংলা থেকে রেশম রফতানি করলে তারা বেশি লাভবান হবে, তখনই তারা বাংলা থেকে রেশম চাষ ও রফতানিতে বাড়তি নজর দিতে শুরু করল। ইংরেজরা ১৬৫৮ সালে কাশিমবাজারে কুঠি স্থাপন করে বাংলা থেকে ইউরোপে রেশম রফতানি করার ওপর জোর দিতে শুরু করে। ১৬৭০-র দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে রেশম বাণিজ্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। এবং মাঝেমধ্যে কিছুটা ওঠানামা করলেও এই বাণিজ্য ১৭৩০-এর দশক পর্যন্ত ক্রমাগত বৃদ্ধি পেতে থাকে। এই সময় রফতানি চূড়ান্ত মাত্রা পায়। ব্রিটিশদের পাশাপাশি ডাচ কোম্পানিগুলিও সপ্তদশ শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে রেশম রফতানি শুরু করে। তবে ইংরেজদের সঙ্গে পার্থক্য় ছিল, ডাচরা বাংলার রেশম ইউরোপের পাশাপাশি, জাপানেও রফতানি করতো।

ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১৬৭০ এর সময়, ডাচরা  পারস্যদেশের রেশমই রফতানি করত, আর বাংলা ও চিনদেশের রেশম প্রধানত জাপানে রফতানি করত। কিন্তু ওই বাণিজ্যে কিছু পালা বদল হয়, একদিকে জাপানের বাণিজ্যে ভাটা পড়তে শুরু করে, অন্যদিকে বাংলার রেশম, চিন বা পারস্যদেশের রেশমের থেকে কিছুটা নিম্নমানের হলেও, তার বাজার ছিল। কারণ চিন ও পারস্যদেশের রেশমের তুলনায় অনেকটাই সস্তা। বাংলায় বেশ কিছু জায়গায় সিল্কের চাষ হয়, তার মধ্যে মুর্শিদাবাদের সিল্কের কদর অনেকটাই বেশি ছিল।  এখনও রয়েছে। ইতিহাস থেকে জানা যায়, পাঁচ হাজার বছর আগে চিনে প্রথম রেশমের ব্যবহার শুরু হয়। যদিও চিনারা প্রথম দিকে রেশমের ব্যবহার সেভাবে আন্তর্জাতিকমুখী করে তোলেনি প্রথম দিকে। পরবর্তী সময়ে নিজেদের বাণিজ্যকে শক্তিশালী করে, সিল্ককে বাণিজ্যমুখী করে তোলে। শুরু হয় আন্তর্জাতিক সুল্করুট। বাংলার ইতিহাস খুঁজলে, মুর্শিদাবাদের নবাব, মুর্শিদকুলি খাঁয়ের হাত ধরে ঢাকা থেকে মুর্শিদাবাদে আসে বালুচরী শাড়ি। সেই সময় ভিন্ন রঙের সুতোর বুনোনে তুলে ধরা হত, নবাবি সংস্কৃতি। একটা সময়ে এই শিল্পকর্ম নজরে আসে মুঘল শাসকদের। ষোড়শ ও সপ্তদশ শতাব্দীতে মুঘল সম্রাটদের পৃষ্টপোষকতায় অবিভক্ত বাংলায় রেশমশিল্পে এক নবজোয়ার আসে। সেই সময় বাংলাদেশের রাজশাহী জেলা, মালদা , মুর্শিদাবাদে বেঙ্গল সিল্কের প্রধান উৎপাদনস্থল হিসেবে পরিচিতি পায়।  এখনও দেশ বিভক্ত হওয়ার পরেও রাজশাহী ও মালদা, মুর্শিদাবাদ সিল্ক ইতিহাসের সেই নজিরই বহন করে এখনও।

কিংবদন্তি রয়েছে, রেশমচাষের কৌশল, সিল্কের পর্যায়ক্রম শিক্ষণের জন্য টিপু সুলতান মাইসোর থেকে কিছু তাঁতিকে পাঠিয়েছিলেন। বাংলায় রেশম শিল্প প্রসারের পরেই দক্ষিণ ভারতে রেশম চাষের প্রভাব শুরু হয়। পরে গোটা দক্ষিণভারত জুড়ে, এই শিল্পের ব্যাপক উন্নতিসাধন হয়। ভারতে মসলা, খনিজ পদার্থ ও বিভিন্ন পণ্য উৎপাদের ক্ষেত্রে সস্তার শ্রমিক মেলায় যেমন অতি কম সময়ে ইউরোপ ফুলে ফেঁপে ওঠে, তেমনই রেশম-বাণিজ্যে বাজার দখল করতে উপনিবেশ তৈরিতে জোর দিতে শুরু করে। মুঘল আমল থেকেই মুর্শিদাবাদ সিল্কের কদর ছিল এশিয়াজুড়ে। ব্রিটিশরা আসার পর, সেই বাজার ছড়াতে শুরু করে পাশ্চাত্যে। কিন্তু সময়ের সঙ্গে মুর্শিদাবাদের সিল্কের চাহিদায় কিছুটা ভাটা এসেছে। কারণ, বর্তমান প্রযুক্তিকে আধার করে, সিল্কের বাজারে ঝাঁপিয়েছে বহু দেশ। চিনও এখনও সিল্ক রফতানির ক্ষেত্রে বড় বাজার দখল করে রয়েছে। ফলত, ভারতের সিল্কের চাহিদা ততটা অগ্রসর হয়নি। সময়ের কালরোষে পড়ে, বহু মানুষ এই পেশা থেকে মুখ সরিয়ে নিয়েছেন, বেশ কিছু প্রজন্ম ভিন্ন পেশার দিকে সরে গিয়েছেন। ফলত, আগের মতো বাজার নেই মুর্শিদাবাদের সিল্কের। যদিও বর্তমান বাংলার সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় ফের একবার মুর্শিদাবাদ সিল্কের চাহিদা আন্তর্জাতিকমুখী করতে তুলতে উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।