কলকাতা

ঐতিহ্য ও ইতিহাসের স্বাক্ষী সাউথ পার্ক স্ট্রিট সিমেট্রি

South Park Street Cemetery, a witness to tradition and history

জয় চক্রবর্তী (বিশিষ্ট সাংবাদিক): বাদামতলার কবরখানা চেনেন? প্রথমেই প্রশ্ন শুনে কিছুটা থতমতো খেতে হবে। কলকাতার বাদামতলা, সেখানে আবার কবর? বাদামতলা আষাঢ় সংঘের পুজো দেখতে গেছেন, কিন্তু এখানে তো কোন কবরখানা নেই? বাদামতলার কবরখানা সম্পর্কে জানতে আমাদের টাইম ট্রাভেলে বেশ কিছুটা পিছনে ফিরে তাকাতে হবে। যেখানে গত ২৩৫ বছরে নতুন করে কোন দেহ সমাধিস্থ হয়নি। তাতে কি? ২৬৮ বছর পর আজও নিজস্ব গরিমায় উজ্জ্বল কলকাতার প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত সাউথ পার্ক স্ট্রিট সিমেট্রি।

এবার তো বলে উঠবেন, চিনি তো। না চেনার কোন বিষয় নেই। কলকাতার ঝাঁ চকচকে পার্ক স্ট্রিটের উপরেই মল্লিক বাজারের মুখেই সাউথ পার্ক স্ট্রিট সিমেট্রি। বলা হয়, উনিশ শতকে আমেরিকা ও ইউরোপের বাইরে এটাই ছিল সম্ভবত সবথেকে বড় খ্রিস্টান সমাধিক্ষেত্র। প্রাচীন কলকাতার অন্যতম আইকন এই সমাধিস্থল বা সিমেট্রিতেই শায়িত রয়েছেন কলকাতায় এশিয়াটিক সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা স্যার উইলিয়াম জোন্স, শিক্ষক-কবি এবং সমাজ সংস্কারক তথা বাংলার নবজাগরণের অন্যতম পথিকৃৎ হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও, সুপ্রিম কোর্টের প্রথম প্রধান বিচারপতি স্যার এলাইজা ইম্পে, হিন্দু ওয়ার্ড নামে পরিচিত মেজর জেনারেল চার্লস স্টুয়ার্ট। এরকম আরও অনেকেই।

এই ঐতিহাসিক সমধিক্ষেত্রে প্রথম দেখা সমাধি দেওয়া নিয়ে মতান্তর রয়েছে। একাংশের মতে, কাস্টমস হাউসের লেখক জন উড প্রথম সমাধিস্থ হন। ১৭৬৭ সালের ২৫ আগস্ট কাস্টমস হাউজের জন উডকে কবর দেওয়া হয়। যদিও অনেকের মতে, প্রথম এখানে যাকে সমাধিস্থ করা হয়েছিল তিনি হলেন এস পিয়ারসন। এছাড়া ৩৬৩ নম্বর কবরে শায়িত ব্যক্তির কোন নাম নেই, অনামী এই সমাধিস্থলে লেখা রয়েছে ‘আ ভার্চুয়াল মাদার’। এখানে একটা সমাধিক্ষেত্র রয়েছে যা হিন্দু মন্দিরের আদলে তৈরি। ১৭৬৭ সালে এই কবর খানা স্থাপিত হয়েছিল। ১৭৯০ সাল পর্যন্ত এখানে কবর দেওয়ার কাজ হতো।

১৯৮৪ সালে এই সমাধিক্ষেত্রটি ভেঙেচুরে একটা দৃষ্টিনন্দন জায়গায় পরিণত করার চেষ্টা করে এক ব্যবসায়ী পরিবার। কিন্তু এই ঐতিহাসিক ক্ষেত্রের চরিত্র বদল নিয়ে শহর কলকাতায় প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। কলকাতা হাইকোর্টের নির্দেশে এই ঐতিহাসিক ক্ষেত্রের চরিত্র পরিবর্তন সম্ভব হয়নি। আজও সমান মর্যাদায় ও স্বমহিমায় ঐতিহাসিক গুরুত্ব নিয়ে ডিরোজিও-জোন্স-ইম্পে দের বুকে ধারণ করে রয়েছে সাউথ পার্কস্ট্রিট সিমেট্রি।

১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধের পর কলকাতা পুরোপুরি ব্রিটিশদের দখলে আসার পর নিত্যনৈমিত্তিক সমস্ত সুযোগ-সুবিধাগুলোর প্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে। কেউ মারা গেলে তাঁকে কবর দেওয়ার বিষয়টাও তাদের মাথায় ছিল। তথ্য পাওয়া যাচ্ছে, আকাশবাণী ভবন, রাজ্য বিধানসভা হয়ে মহাকরণের দিকে এগোতেই সেন্ট জোন্স গির্জা যেখানে এখন দাঁড়িয়ে রয়েছে সেই জমিতেই এখনও পর্যন্ত আবিষ্কৃত প্রাচীন ব্রিটিশ সমাধিস্থল। এখানেই জোব চার্নকের সমাধি রয়েছ। সেই সমাধিস্থল ধীরে ধীরে ভরে ওঠে। এরপর ১৭৬৭ সালে নতুন করে সমাধিক্ষেত্র তৈরির কাজ শুরু হয় তৎকালীন মরাঠা খালের কাছে। যেহেতু কবর লাগোয়া রাস্তা তাই নাম হয় বেড়িয়াল গ্রাউন্ড রোড।

স্থানীয় নাম অবশ্য ছিল বাদামতলা। এই অঞ্চলে অসংখ্য বাদামগাছ ছিল। সেই জন্য নাম হয় বাদামতলা। গোটা অঞ্চলটা বেশ খানিকটা ঘন জঙ্গলে ভরা ছিল। ডাকাতদের বাস ছিল। এখানেই গড়ে ওঠে নতুন কবরখানা। সেটাই আজকের সাউথ পার্ক স্ট্রিট সিমেট্রি। তথ্য বলছে, ১৭৯০ সালের পর এই সিমেট্রিতে আর কোনও সমাধি দেওয়া হয়নি। তবে ঐতিহ্যের প্রেক্ষাপটে আজও সমুজ্জ্বল পার্ক স্ট্রিটের (বর্তমান নাম মাদার টেরেজা সরণি) এই ঐতিহাসিক ক্ষেত্র। প্রতিদিন সকাল ১০ টা থেকে খোলা থাকে। টিকিটের মূল্য ২০ টাকা এবং ছবি তোলা সুযোগ পেতে হলে ৫০ টাকা। অনেকেই বলেন সাউথ পার্ক স্ট্রিট সিমেট্রি কলকাতার অন্যতম ‘হন্টেড প্লেস’।‌

এখানে নাকি একটা কবর দিয়ে রক্ত পড়ে। কিন্তু সেই ভাবে কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তবে আপনি নিশ্চিন্তে যেতে পারেন সাউথ পার্ক স্ট্রিট সিমেট্রিতে। তবে কবরের উপর উঠে না বসাই ভালো। কিন্তু কেন? তন্ত্র বিশেষজ্ঞ ধ্যান যোগি আচার্য কৌটিল্য ‘আরো খবর’-কে জানালেন,’জীবিত অবস্থায় মানুষের এক জীবন। আবার মৃত্যুর পর আর এক জীবন। যেখানে কোন ব্যক্তিকে সমাধি দেওয়া হয়, সেটা তার ঘরবাড়ির মতো। আমি কারোর বাড়িতে তার অনুমতি ছাড়া যেমন প্রবেশ করতে পারি না, এমনই এই কবরগুলিতে আমি জুতো পড়ে উঠে বসতেও পারি না।’ তিনি বললেন,’এটা আমাদের ঐতিহ্যের একটা অংশ। একদিকে আমাদের সংস্কার অন্যদিকে আমাদের ঐতিহ্যকে রক্ষা করাটা দায়িত্ব।’ এখানে এসে আপনি ঐতিহ্য ও ইতিহাসের সাক্ষী থাকতেই পারেন। তাই চলে আসতে পারেন কলকাতার সাউথ পার্ক স্ট্রিট সিমেট্রি তে।

Related Articles