দেওয়াল লিখনে রাজনীতির একাল-সেকাল, অভিনব দেওয়ালচিত্র ছাড়া পানসে বাংলার ভোট
The past of politics is written on the wall

The Truth Of Bengal : ‘আয় ভোটার আয় ভোট দিয়ে যা’….ছবি বিশ্বাস অভিনীত দাদাঠাকুর সিনেমার আইকনিক গান ছিল এটি। কথায় বলে বাঙালি অত্যন্ত রাজনীতি সচেতন জাতি। ভোটের মরসুমে আম জনতার চেতনায় কড়া নাড়ার বিভিন্ন শক্তিশালী পন্থা হল রাজনৈতিক স্লোগান, বক্তৃতা, দেওয়ালচিত্র ও গণসঙ্গীত। অভিনব দেওয়ালচিত্র আর ব্যঙ্গচিত্র অসম্পূর্ণ। শিল্পচেতনার জন্য বাঙালিদের খ্যাতি ভুবনজোড়া। রান্নাবান্না, পোশাকআশাকই হোক কিংবা নির্বাচনি প্রচার বাঙালি যাই করে তারমধ্যে থাকে শিল্প সুষমা। যতই সোশ্যাল মিডিয়া আসুক না কেন আজও ভোটের রঙ্গে বাংলাকে শাসন করে দেওয়ালচিত্রই। যেমন, একুশের বিধানসভা ভোটে সবচেয়ে শক্তিশালী শব্দগুচ্ছ ছিল খেলা হবে। জটায়ুর ভাষায় বলতে গেলে এই স্লোগান ছিল একেবারে ‘সেলিং লাইট হট কচুরিজ’।
বাংলার ভোটের মরসুমে ব্যঙ্গচিত্রভরা দেওয়াল লিখনের ইতিহাস বহু পুরনো। ১৯৫২ সালে স্বাধীন ভারতে প্রথমবার ভোট হয়। তখন কাগজের প্রচুর দাম হওয়ায় নিজেদের বক্তব্য ভোটারদের সামনে তুলে ধরতে কংগ্রেস আর বামপন্থীরা দেওয়াল লিখন শুরু করেন। সেই থেকে রসবোধে পরিপূর্ণ দেওয়াল লিখন ও ব্যঙ্গচিত্র বাংলার ভোটের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে। বাংলার প্রাক্তন মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায় একসময় বলেছিলেন, ‘দেওয়াল লিখন আর ব্যঙ্গচিত্র বাংলার নির্বাচনি প্রচারের অবিচ্ছেদ্য অংশ। দেওয়াল লিখন ছাড়া ভোট অসম্পূর্ণ। সোশ্যাল মিডিয়ায় বহু মানুষের কাছে একসঙ্গে কম সময়ের মধ্যে পৌঁছে যাওয়া যায় ঠিকই কিন্তু দেওয়াল লিখনের ভিজ্যুয়াল ইমপ্যাক্টকে অস্বীকার করার উপায় নেই। ছয় ও সাতের দশকে কংগ্রেস ও বামপন্থীদের মধ্যে প্রবল উৎসাহ থাকত দেওয়াল লিখনের। এক্ষেত্রে কিছুটা এগিয়ে থাকবে বামপন্থীরা কারণ নজরকাড়া স্লোগান লেখার জন্য তাদের নির্দিষ্ট দল থাকত।’
কংগ্রেসের জোড়া বলদ চিহ্ন ছিল। কংগ্রেস ছড়া কাটল, “ভোট দেবেন কোথায়/জোড়া বলদ যেথায়।”
সিপিএম উত্তর দিল, “জোড়া বলদের দুধ নেই/কংগ্রেসের ভোট নেই।ভোট দিন বাঁচতে/তারা হাতুড়ি কাস্তে”।
নাছোড় কংগ্রেস লিখল, “চিনের চিহ্ন কাস্তে হাতুড়ি/পাকিস্তানের তারা/এখনও কি বলতে হবে দেশের শত্রু কারা ?” ব্যক্তি আক্রমণও টুকটাক ভালই চলত। সিপিএম লিখল, “দু’আনা সের বেগুন কিনে/মন হল প্রফুল্ল/বাড়িতে এসে দেখি সব কানা অতুল্য” অথবা “ইন্দিরা মাসি বাজায় কাঁসি/প্রফুল্ল বাজায় ঢোল/আয় অতুল্য ভাত খাবি আয়/কানা বেগুনের ঝোল”।পাল্টা কংগ্রেস প্যারডি করে ছড়া কাটল, “অনিলা মাসি বাজায় কাঁসি/জ্যোতি বাজায় ঢোল/আয় প্রমোদ ভাত খাবি আয়/মাগুর মাছের ঝোল”কংগ্রেসের নির্বাচনী প্রতীক ‘হাত’হওয়ার পর সিপিএম বিদ্রূপ করল, “শুনলেও হাসি পায়/কাটা হাতে ভোট চায়”। কংগ্রেসই বা ছাড়বে কেন ! তারা লিখল, “সিপিএমের তিনটি গুণ/লুট, দাঙ্গা, মানুষ খুন” অথবা “দিনের বেলায় কৌটো নাড়ায়/রাত্রে করে ফিস্ট/এরাই আবার মুখে বলে/আমরা কমিউনিস্ট” বা “ডানহাতেতে মদের বোতল/বামহাতেতে গুলি/এরাই আবার মুখে বলে/মার্কসিজমের বুলি” কিংবা “টাটা বিড়লার কোলে/জ্যোতি বসু দোলে”।একবার পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা ভোটের দিন পড়েছিল জুন মাসের উনিশ তারিখে। কংগ্রেস লিখল, “উনিশে জুন আসছে দিন/জ্যোতি বসুর বিয়ের দিন”। সিপিএম উত্তর দিল, “লিখেছিস বেশ করেছিস/ইন্দিরাকে সাজিয়ে রাখিস”। ছয়ের দশকে কমিউনিস্টরা ভিয়েতনাম যুদ্ধের সমর্থনে স্লোগান লিখতেন, ” তোমার নাম আমার নাম, ভিয়েতনাম ভিয়েতনাম। ”
বাম বিরোধীরা কটাক্ষ করে লিখতেন, ‘বলতে বলতে ভিয়েতনাম ভুলে গেছে বাপের নাম।’
নন্দীগ্রাম আন্দোলনের সময় রাজ্যের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন, “তোমার নাম আমার নাম নন্দীগ্রাম।” ২০১৬ সালের বিধানসভার নির্বাচনে তৃণমূলের স্লোগান ছিল, ‘ঠান্ডা ঠান্ডা কুল কুল আবার আসছে তৃণমূল।’
একুশের বিধানসভার নির্বাচনে দেওয়ালজুড়ে দেখা গেছে, ‘বাইরে থেকে বর্গী আসে নিয়ম করে প্রতি মাসে/আমিও আছি তুমিও রবে/বন্ধু এবার খেলা হবে’ কিংবা ‘ফুটবে না আর পদ্মফুল /ভারত গড়বে তৃণমূল।’
এখন ইন্টারনেটের যুগ। হাতে থাকা মোইলের ফোনে অনেক কাজ সেরে নেওয়া যায়। নেট-নির্ভর এই সময়কে কাজে লাগাচ্ছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল। চিরাচরিত প্রচার তো আছেই, সেই সঙ্গে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এখন প্রচারে অনেকটা সময় ব্যয় করছে ভার্চুয়াল জগতে। কারণ ভোটারদের মধ্যে তরুণ একটা বড় অংশ তরুণ প্রজন্ম। তাঁদের হাতে হাতে মোবাইল ফোন। সেই তরুণ প্রজন্মকে কাছে টানতে বিভিন্ন দলের আইটি বিভাগ আছে। সেখান থেকে সাজানো হচ্ছে ভার্চুয়াল জগতের প্রচারের রণকৌশল।
আগে দেওয়াল চিত্রে যেরকম স্লোগানের বহর দেখা যেত, ভার্চুয়াল জগতে অবশ্য সেটা তেমন দেখা যায় না। এখানে আবার প্রতিদ্বন্দ্বীদের বিরুদ্ধে মিমের ছড়াছড়ি। তাতে হাস্যরসের মজা থাকলেও অনেক সময় রুচিহীন অনেক কিছু ছড়িয়ে দেওয়া হয়। তৃণমূলের বিখ্যাত স্লোগান ‘খেলা হবে’ এই নেটের দুনিয়ার দৌলতে সবার জানা। কত ছড়া, কত গান তৈরি হয়েছে ‘খেলা হবে’ স্লোগানকে ঘিরে। ২৪ ঘণ্টা সক্রিয় থাকে ভার্চুয়াল জগৎ। ভোট-বাজারে সেই খোলা মাঠ দাপিয়ে বেড়াচ্ছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল। কোন দল কিছু করলে সঙ্গে সঙ্গে তার পাল্টা জবাব দিতে প্রস্তুত অন্য দল। মাঠে-ময়দানের রাজনীতি এখন অনেকটাই আবর্তিত হচ্ছে নেটের দুনিয়ায়।
FREE ACCESS