
The Truth of Bengal: একটা সময় ছিল, বাঙালি কাছে স্বাস্থ্যোদ্ধারের অন্যতম প্রিয় জায়গা ছিল পশ্চিম। পশ্চিম মানে ইউরোপের কোনও দেশ নয়। বাংলার পড়শি রাজ্য বিহারের (অধুনা ঝাড়খণ্ড) জনপ্রিয় হাওয়া বদলের জায়গা। দেওঘর, জোশিডি, শিমুলতলা, মধুপুর এই সমস্ত অঞ্চল ছিল একসময় বাঙালিদের দ্বিতীয় ঘর। এখান থেকেই এক শ্রেণির বাঙালিদের নাম হয়ে ওঠে ড্যাংচি বাবু। সৌখিন বাঙালিরা বাবুরা এখানে তৈরি করেছিলেন একের পর এক বাড়ি। থাকার জন্য নয়, স্রেফ হাওয়া বদলের জন্যই এই বাড়িগুলি ছিল অনন্য তাঁদের কাছে। তাহলে কেন এক সময়ে বাঙালির প্রিয় পশ্চিম তথা জোশিডি ও শিমুলতলা মৃতপ্রায় হয়ে উঠলো? সেই ইতিহাসের একটা টাইমলাইন দেখে নেওয়া যাক। বোঝার চেষ্টা করা যাক, কোন ঘাত প্রতিঘাতে অমৃত জলবায়ুর এলাকা থেকে হারিয়ে গেল বাঙালিরা।
ব্রিটিশ শাসনকালেই একটা বাঙালি শ্রেণির উদয় হয়েছিল। তাঁরাও অনেকটাই সৌখিন মেজাজি ছিলেন। বলাই বাহুল্য, কর্ম হোক বা শখে জোশিডি, শিমুলতলায় বাড়ি তৈরি করতে শুরু করেন অনেক। মূল উদ্দেশ্য ছিল, স্বাস্থ্যোদ্ধার। কারণ এখানকার জলহাওয়ায় যে একটা ম্যাজিক ছিল বা এখনও রয়েছে, তা বহুবার প্রমাণিত।
তবে একটা সময় আসে এই জায়গা থেকে কার্যত বাঙালিরা উচ্ছেদ হতে শুরু করে তার মূল কারণ ঝাড়খণ্ড আন্দোলন। সময়ের সঙ্গে সেই আন্দোলন জোরালো হয়েছে, রক্তক্ষয়ীও হয়ে উঠেছিল। তার পরেই দ্রুত উধাও হতে থাকে বাঙালিরা।
এবার দেখা যাক, এই আন্দোলনের ইতিহাসের একটা টাইমলাইন।
১৮৩১-৩২ জমিদারদের বিরুদ্ধে একটা আওয়াজ উঠতে শুরু করে। প্রধানত এই আন্দোলনে প্রত্যক্ষ যোগ দেন কলকাতার বিপ্লবীরা।
১৮৯৫-১৯০০ বিরসা মুন্ডার নেতৃত্বে ইংরেজদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু হয়। দীর্ঘ পাঁচ বছর চলে গেরিলা লড়াই। সাঁওতাল পরগনা থেকে নিজেদের সরাতে থাকে ব্রিটিশরা। সেই লড়াইয়ে প্রাণ যায় উপজাতি ভূমিপুত্রের।
১৯১৫ সাল, গঠিত হয়, ছোটনাগপুর উন্নতি সমাজ।
১৯২৮ সিমন কমিশনের কাছে ঝাড়খণ্ড নামক পৃথক রাজ্যে দাবি জানায় ছোটনাগপুর উন্নতি সমাজ।
১৯৩৮ শুরু হয় খারশওয়ান আন্দোলন। এটাই সম্ভবত প্রথম গণ আন্দোলন। এর আগে মূলত জাতিগত আন্দোলন হয়েছে। এই আন্দোলনে শুরু হয় আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার।
১৯৩৯ সাল জয়পাল সিং তপশিলী জাতিদের প্রধান নেতা বৃহত্তর ঝাড়খণ্ডের দাবি জানায়। এবং আন্দোলন শুরু করে। দাবি ছিল, বাংলা, বিহার, মধ্যপ্রদেশ ও ওড়িশা থেকে নেওয়া ২৬টি জেলা নিয়ে গঠন করা হোক ঝাড়খণ্ড।
১৯৪৯ সালে আইন পাস হয়, সাঁওতাল পরগনা টেনেন্সি প্রহাইবিটিং অ্যাক্ট। আইনে বলা হয়, উপজাতিদের জমি অন্য কেউ কিনতে পারবেন না।
১৯৪৯ জয়পাল সিংয়ের নেতৃত্বে গঠন হয়, ঝাড়খণ্ড পার্টি এবং আদিবাসী মহাসভা।
১৯৫২ ঝাড়খণ্ড পার্টি প্রথম সাধারণ নির্বাচনে ৩ টি লোকসভা ও বিহারের ৩১টি বিধানসভা আসন জয় করে।
১৯৫৫ বিহার রাজ্যসরকারের কাছে পৃথক রাজ্যের সনদনামা পেশ করা হয়। যদিও কমিশন সেই আবেদন নাকচ করে দেয়।
১৯৫৭ সালের নির্বাচনেও ঝাড়খণ্ড পার্টি, ১৯৫২ সালের আসন সংখ্যা নিজেদের দখলে রাখে। এবং দক্ষিণ বিহারে তারা প্রধান বিরোধী শক্তি হিসেবে নিজেদের প্রকাশ করে।
১৯৭২ ঝাড়খণ্ড আন্দোলনে গতি বদলায়। সাঁওতাল নেতা শিবু সোরেন তৈরি করেন ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চা। তাঁর পাশে ছিলেন শিবাজী সমাজের নেতা বিনোদ বিহারী মাহাতো। এমসিসি (মার্ক্সসিস্ট কো-অর্ডিনেশন কমিটি) র সঙ্গে হাত মিলিয়ে শুরু করেন নতুন ধরার আন্দোলন।
১৯৭৮ সালে দুমকা বিধানসভার আসনটি ছিনিয়ে নেন শিবু সোরেন। এর পরেই কংগ্রেস সাংসদ জ্ঞানরঞ্জন এবং পরে ইন্দিরা গান্ধীর প্রিয় হয়ে ওঠেন শিবু সোরেন।
১৯৮৬ কংগ্রেস এবং ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চার ঘনিষ্টতা দেখে দলের একাংশ বিরক্ত হতে থাকে। তৈরি হয় আরও এক দল অল ঝাড়খণ্ড স্টুডেন্টস ইউনিয়ন।
১৯৮৬ সালে রাম দয়াল মুন্ডা ফের আদিবাসীদের সংগঠিত করে আন্দোলন শুরু করেন।
১৯৮৭ রামদয়াল মুন্ডার নেতৃত্বে ঝাড়খণ্ড কো-অর্ডিনেশন কমিটি তৈরি হয় এবং ৪৮টি আদিবাসী সংগঠন যোগ দেয়। তার মধ্যে একটি ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চা।
১৯৮৮ কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বুটা সিঙের কাছে রামদলায় মুন্ডা ঝাড়খণ্ডের পৃথক রাজ্য নিয়ে রিপোর্ট পেশ করেন। দাবি জানানো হয়, বৃহত্তর ঝাড়খণ্ডের জন্য স্বশাসন দেওয়া হোক।
১৯৮৯ সালে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক কমিটি গঠন করে ঝাড়খণ্ড সম্পর্কে। সেখানে তিনটি প্রস্তাব উঠে আসে।
ক) বৃহত্তর ঝাড়খণ্ড গঠন হতে পারে।
খ) কেন্দ্র শাসিত অঞ্চল হতে পারে।
গ) ঝাড়খণ্ড জেনারেল কাউন্সিল গঠন করা হতে পারে।
১৯৮৮-৮৯ ঝাড়খণ্ড কো-অর্ডিনেশন কমিটি থেকে বেরিয়ে আসে, ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চা এবং অল ঝাড়খণ্ড স্টুডেন্টস ইউনিয়ন। শুরু করে সংগঠিত লাগাতার বন্ধের রাজনীতি। আর এতেই পঙ্গু হতে শুরু করে রাজ্যের আর্থিক ব্যবস্থা।
১৯৮৯ সালে বিজেপি ক্ষমতায় আসে এবং পৃথক রাজ্যের দাবিকে সমর্থন করে। কিন্তু ১৬টি জেলা নিয়ে বৃহত্তর ঝাড়খণ্ডের যে দাবি তুলেছিল, তা সমর্থন করেনি বিজেপি।
১৯৯১ ফের জোরালো আন্দোলন শুরু করে ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চা, সাধারণ নির্বাচনে লোকসভায় ৬টি আসন জয় করে।
১৯৯৫ পৃথক রাজ্য তৈরি না হলেও, গঠন করা হয় ঝাড়খণ্ড অঞ্চল স্বশাসন পর্ষদ (JAAC)
২০০০ সালে অবশেষে ১৫ নভেম্বর দেশের ২৮তম রাজ্য হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে ঝাড়খণ্ড।
নতুন রাজ্য গঠন হওয়ার পর, কেটেছে কয়েকটা বছর। আগের থেকে অনেকটাই বদলেছে, ঝাড়খণ্ডের এই সব অঞ্চলগুলি। কিন্তু জোসিডি, শিমুলতলা, মধুপুর যেন ধীরে ধীরে হারিয়ে গিয়েছে। এখনও পড়ে রয়েছে, পুরনো বাঙালি বাবুদের বাড়িগুলি। কলকাতা থেকেও হারিয়ে গিয়েছে, সেই সমস্ত বাঙালিদের আভিজাত্য। তাই শিমুলতলা, জোশিডির প্রাকৃতিক গুন এখনও বহাল থাকলেও, বেহাল হয়ে উঠেছে ড্যাংচি বাবুদের স্মৃতিকথা