ফিচার

মৃত্যু উপত্যকায় হেঁটে বেড়ায় পাথরের দল, এক অমীমাংসিত প্রকৃতির রহস্য

Death Valley's moving stone

The Truth of Bengal: একটা নাবাল জমি, তার উপর জমে রয়েছে, বালির স্তর, আর তার বুক চিরে কেউ যেন চলে গিয়েছে। না কোনও মানুষ বা জন্তু জানোয়ারের পায়ের ছাপ নয়। পাথরের। যেন কেউ একটি বড় পাথরের চাইঁকে টেনে নিয়ে গিয়েছে। আরও ভালো করে দেখলে বোঝা যাবে, সেই যাওয়ার চিত্র টেনে নিয়ে যাওয়ার নয়, যেন ধীর লয়ে পাথরগুলি হেঁটে গিয়েছে। একটি দুটি নয়, একাধিক পাথর, যেন বালু জমিতে নিজেদের মতো বিচরণ করেছে।

উপরের এই অংশটি পড়লে হয়তো কোনও কল্পবিজ্ঞানের বর্ণনা লাগতে পারে। কিন্তু এটি একদম বাস্তব চিত্র। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়াতে অবস্থিত ডেথ ভ্যালি বা মৃত্যু উপত্যকা হলো পৃথিবীর উষ্ণতম অঞ্চল। বাটির মতো দেখতে এই উপত্যকাটি প্রাণ নেই বললেই চলে। উদ্ভিদ ও প্রাণীদের বাঁচার জন্য সামান্যতম প্রাকৃতিক উপাদানও নেই। তাই ২২৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য এবং ৮ থেকে ২৪ কিলোমিটার প্রস্থের এই উপত্যকাটি কুখ্যাত হয়ে রয়েছে ডেথ ভ্যালি নামে। এখানকার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৫৬.৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস।

ডেথ ভ্যালির যে পরিমাণ গরম ধরা পড়ে, তা হার মেনেছে আফ্রিকার সাহারা, কালাহারি কিংবা মধ্যপ্রাচ্যের মরু অঞ্চলগুলিও। গোটা উপত্যকায় আছে গুটিকয়েক জলাশয় রয়েছে, তাও সেগুলি লবণাক্ত জলের, পানের অযোগ্য। বালি, কাঁকর, পাথর, ন্যাড়া পাহাড় ছাড়া আর কিছুই নেই উপত্যকায়।

১৯৪৮ সালে মৃত্যু উপত্যকায় অভিযান চালান একদল অভিযাত্রী। তাঁরা ডেথ ভ্যালির মধ্যে একটি রহস্যময়, হ্রদের সন্ধান পান। হ্রদটির দৈর্ঘ্য সাড়ে ৪ কিলোমিটার এবং প্রস্থ ২ কিলোমিটার। হ্রদটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১,১৩০ মিটার উঁচুতে। হ্রদটির কাছে পৌঁছতে অভিযাত্রীর দলটিকে দুর্গম পথ পার করতে হয়েছিল। এই জলশূন্য নাবাল জমিতেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে কিছু পাথর। বিস্ময়করভাবে তারা নিজে থেকে স্থান পরিবর্তন করে। চলমান ভৌতিক পাথরদের স্থান পরিবর্তনের জন্যই জায়গার নাম হয় রেসট্র্যাক প্লায়া।

কখনও সরলরেখায়, কখনও বক্রপথে স্থান পরিবর্তন করে থাকে পাথরগুলি। এমনও দেখা গিয়েছে, দু’টি পাথর সমান্তরাল পথে কিছুদূর যাওয়ার পর দিক পরিবর্তন করেছে। কখনও আবার ফিরে এসেছে আগের অবস্থানে। একটি দুটি নয়, শয়ে শয়ে পাথর। এক কেজি থেকে সাড়ে তিনশো কেজির পাথরও স্থান পরিবর্তন করেছে এই মৃত্যু উপত্যকায়।

গ্রহবিজ্ঞানী র‌্যাল্‌ফ লরেন্স, ২০০৭ সালে ‘রেসট্র্যাক প্লায়া’ নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। ২০১১ সালে একই জায়গায় গবেষণা করতে যান সমুদ্রবিজ্ঞানী রিচার্ড নরিস এবং এক ইঞ্জিনিয়ার জেমস নরিস। গ্রহবিজ্ঞানী র‌্যাল্‌ফ লরেন্সের সঙ্গে যোগাযোগও করেন তাঁরা। লরেন্স-এর সাহায্য নিয়ে পাথরগুলির নড়াচড়া ক্যামেরাবন্দী করার জন্য রেসট্র্যাক প্লায়াতে স্টিল ও ভিডিও ক্যামেরা বসানো হয়।

একই সঙ্গে রেসট্র্যাক প্লায়ার তাপমাত্রা, বায়ুচাপ, আর্দ্রতা, প্রভৃতি আবহাওয়াগত পরিবর্তন নথিভুক্ত করার জন্য একটি ছোট আবহাওয়া কেন্দ্র বসিয়ে ফেলেন তিনজন। রহস্যময় পাথরগুলোর নড়াচড়া ট্র্যাক করার জন্য তাঁরা বিভিন্ন আকারের কিছু পাথরের গায়ে জিপিএস ট্র্যাকার বসিয়ে দিয়ে আসেন। ফলাফল এসেছিল দু’ বছর পর।

২০১৩ সালের ডিসেম্বর মাসে রিচার্ড আর জেমস রেসট্র্যাক প্লায়াতে  গিয়ে তাঁরা অদ্ভুত একটি দৃশ্য দেখতে পান। মরুভূমির মতো শুষ্ক হ্রদটির তিনভাগের একভাগ জুড়ে রয়েছে বরফের পাতলা চাদর। বরফের স্তর দেখেই স্ট্যানলির আইস-সিট মতবাদ চাক্ষুষ দেখার কথা ভাবেন দুই ভাই। প্রচন্ড ঠাণ্ডার মধ্যে তাঁবু খাটিয়ে ফেলেন। মৃত্যু উপত্যকায় কাটতে থাকে দিনের পর দিন। এক প্রাণান্তকর প্রতীক্ষায়।

আরও পড়ুন- এক রহস্যময় দ্বীপ, এখানে জীবন্ত পোড়ানো হয়েছিল, দেড় লক্ষ মানুষকে

তাঁরা দীর্ঘ অনুসন্ধানের পর সিদ্ধান্তে আসে, ওই নাবাল জমিতে বরফের চাদর থাকায়, অনেক সময় বরফের প্লেটগুলি পাথরগুলিকে ঠেলে নিয়ে যায়, হাওয়ার সাহায্যে। ফলে গতিপথের ছাপ সমান্তরাল হয় এবং পাথরগুলো একই দূরত্ব অতিক্রম করে। এই মতবাদকে কিছু গবেষক মানলেও, একাংশ মানতে নারাজ। কারণ, বরফের চাদরের উপর দিয়ে পাথরগুলি যদি হাওয়ার সাহায্যে স্থান পরিবর্তন করে থাকে। তাহলে, তার ছাপ জমির উপর এতোটা পড়ল না। বরং আগের কিছুটা অংশ বরফ গলার পর তা ফের মিশে যেত। তাই এই রহস্য আজও গবেষকদের কাছে রহস্যময়ই থেকে গিয়েছে।