ফিচার

টাইমমেশিনে চড়ে আসা এক ব্যক্তির কাহিনী, যা একসময় কাঁপিয়ে দিয়েছিল জাপানকে

Man From Taured-The Traveler from an Alternate Universe

The Truth of Bengal: আপনারা অনেকেই হয়তো বেড়াতে যান। নতুন জায়গা নতুন পরিবেশ, নতুন মানুষজনের সঙ্গে পরিচয় হয়। হয়তো তাদের সঙ্গে একটা দীর্ঘমেয়াদি সম্পর্কও গড়ে ওঠে। আর সেই সম্পর্ক রয়ে যায় দীর্ঘদিন।

কিন্তু যদি কখনও জানতে পারেন, বেড়াতে গিয়ে যে মানুষটির সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল, গল্প করেছিলেন, একটা অসাধারণ অভিজ্ঞতা মনের মধ্যে সঞ্চয় করেছিলেন, সেই মানুষটির কোনও অস্তিত্ব নেই, আগেও কোনও দিন ছিল না। তাহলে আপনার মনে ঠিক কেমন অনুভূতি হবে?

ঠিক এমনই একটি ঘটনা ঘটেছিল জাপানে। ১৯৫৪ সালে ফেব্রুয়ারি মাস। জাপানের হেনেডা বিমানবন্দরে এসে থামলো ইউরোপের কোনও একটি দেশ থেকে আসা একটি বিমান। এয়ারহোস্টেজ জানিয়ে দিলেন যাত্রীদের লাগেজ কত নম্বর কনভেয়ার বেল্ট থেকে পাওয়া যাবে। একে একে প্রত্যেকটি যাত্রী, ইমিগ্রেশন চেক করে বেরতে থাকলেন। এমন সময় এক ব্যক্তি তাঁর পাসপোর্টটি এগিয়ে দিল ইমিগ্রেশন অফিসারদের দিকে। ইমিগ্রেশন অফিসার পাসপোর্ট খুলে দেখেন জাপানের ভিসা লাগানো রয়েছে। তিনি ওই ভদ্রলোককে প্রশ্ন করলেন, আপনি জাপানে কতদিন থাকবেন?

ভদ্রলোক উত্তর দিলেন ১০ দিনের মতো

ফের ইমিগ্রেশন অফিসার জিজ্ঞাসা করলেন, কীসের জন্য জাপানে তিনি এসেছেন?

ভদ্রলোক উত্তর দিলেন একটা ব্যবসায়ীক কাজে তিনি জাপানে এসেছেন।

বিমানবন্দরে এমন প্রশ্ন হামেশাই করে থাকেন ইমিগ্রেশন অফিসারেরা। সেই রকম প্রশ্নোত্তর পর্ব চলার সময়ই অফিসার পাসপোর্ট খুঁটিয়ে দেখতে থাকেন। তাঁর কেমন যেন সন্দেহ হয়। তাঁর মনে হয়, পাসপোর্ট নকল, অথচ জাপান এম্বাসির দেওয়া ভিসা ছিল আসল।

তাঁকে আবার জিজ্ঞাসা করা হয়, আপনি কোন দেশ থেকে এসেছেন?

ভদ্রলোক উত্তর দেন টোরেড থেকে। পাশাপাশি তিনি জানান, জাপানে আসার আগে তিনি ইউরোপের আরও কয়েকটি দেশ সফর করেছেন। তার ভিসাও রয়েছে, এবং এন্ট্রি ও এক্সিটের স্ট্যাম্পও রয়েছে।

এতো কিছু থাকার পরেও ইমিগ্রেশন অফিসারের সন্দেহ বাড়তেই থাকে। তিনি নিজেদের ডায়েরি বের করে টরেড নাম খুঁজতে থাকেন। কারণ এই দেশটির নাম তিনি আগে শোনেননি, কখনও পড়েছেন বলেও মনে পড়ছে না। বেশ কিছুক্ষণ খোঁজাখুঁজির পর টোরেড দেশের কোনও খোঁজ পাওয়া গেল না। ইমিগ্রেশন অফিসার খবর দিলেন উচ্চ পদস্থ আধিকারিককে।

ভদ্রলোককে নিয়ে যাওয়া হয় অন্য একটি ঘরে। সেখানে গিয়ে তাঁর জিনিসপত্র চেক করা হয়। তেমন কিছু কাগজ, জামাকাপড় এবং সেভিংবক্স ছাড়া আর কিছুই পাওয়া গেল না। তাঁকে ফের জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করলেন অফিসারের। তাঁর কাছে একটি ওয়ার্ল্ড ম্যাপ তুলে ধরা হয়। এবং জিজ্ঞেস করা হয়, এই ম্যাপের মধ্যে টোরেড কোথায় রয়েছে সেটি দেখিয়ে বলুন।

ভদ্রলোক, বেশি সময় না নিয়েই, ম্যাপের একটি জায়গায় আঙুল রাখেন। ইমিগ্রেশন অফিসারেরা খেয়াল করেন তিনি যেখানে আঙুল রেখেছেন, সেটি অন্য একটি দেশের উপর, নাম অ্যান্ডোরা। অফিসার জিজ্ঞেস করলেন, এটিতো অ্যান্ডোরা, টোরেড কোথায়?

ভদ্রলোক পাল্টা বললেন, এটা টোরেডই, অ্যান্ডরা আবার কোন দেশ? দ্বীতীয় দফার কথোপকথনে অফিসারদের মনে সন্দেহের দানা আরও বেশি করে বাঁধতে শুরু করে। তাঁরা মনে করেন, এই ব্যক্তি কোনও সাধারণ যাত্রী নয়, নির্ঘাত কোনও বদ অভিসন্ধি নিয়ে জাপানে এসেছেন। পুরোপুরি এই ব্যক্তি সম্পর্কে না জেনে ছাড়াও যাবে না আবার ডিপোর্টও করা যাবে না। কারণ ডিপোর্ট করিয়ে দিলে বড় কোনও অপরাধী হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে।

এরপরেই আধিকারিকরা একটা সিদ্ধান্ত নেন। তাঁরা ওই ভদ্রলোককে জানান, তাঁকে আপাতত বিমানবন্দরের পার্শ্ববর্তী কোনও হোটেলে রাখা হবে। তাঁর জিনিসপত্র, ইমিগ্রেশন অফিসারদের অধীনেই থাকবে। সামান্য কিছু তদন্তের পর তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হবে। সেই মতো, ভদ্রলোককে একটি পাঁচতারা হোটেল রাখার ব্যবস্থা করা হয়। পাশাপাশি, তাঁর উপর নজরদারি রাখার জন্য চারজন পুলিশ কর্মীও মোতায়েন করা হয়। দুটি পুলিশ কর্মী ছিলেন তাঁর রুমের বাইরে। চূড়ান্ত আঁটোসাঁটো নিরাপত্তা ব্যবস্থার মধ্যেই ওই সন্দেভাজন ব্যক্তিকে থাকার ব্যবস্থা করা হয়। আর তাঁর সমস্ত লাগেজ, কাগজপত্র নিজেদের লকারে রাখা হয়। এর পরেই শুরু হয়, খোঁজখবর।

ভদ্রলোক বলেছিলেন, তিনি বাণিজ্যিক কাজে এসেছিলেন। সেই মর্মে একটি কাগও দেখিয়েছিলেন। যা নোট করে রেখেছিলেন অফিসার। ফোন করা হয় সেই সংস্থায়। সংস্থার তরফে খোঁজ খবর নিয়ে জানিয়ে দেওয়া হয়, এমন কোনও ব্যক্তির সঙ্গে তাঁদের ব্যবসা নিয়ে কথা হয়নি এমনকী তাঁরা জানেনও না। ভদ্রলোক, অফিসারদের দেখিয়েছিলেন আগাম হোটেল বুকিংয়ের টেলিগ্রাম মেসেজ। তার ভিত্তিতে সেই হোটেলের সঙ্গেও যোগাযোগ করা হয়। হোটেল কর্তপক্ষও রেজিস্ট্রার চেক করে জানিয়ে দেন। টোরেড থেকে বুকিং করা কোনও ব্যক্তির নামে হোটেল বুক করা নেই। হোটেলের প্রত্যেকটি বোর্ডারের তালিকা তুলে দেওয়া হয় পুলিশের হাতে।

দীর্ঘ ১০ ঘণ্টা ধরে সমস্তদিক খোঁজ খবর করার পর ইমিগ্রেশন আধিকারিক ও পুলিশ একটা সিদ্ধান্তে নিশ্চিত হয়। টোরেড নামক দেশ থেকে যে ব্যক্তি এসেছেন, তিনি একজন ফ্রড। বড়সড় কোনও কাণ্ড ঘটানোর জন্যই জাপানে এসেছে ভুয়ো একটি দেশের পাসপোর্ট নিয়ে। ফলত তাঁকে গ্রেফতার করে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়াই একমাত্র পথ।

সেই দিনই রাত্রি নাগাদ, হোটেল পুলিশের একটি বাহিনী যায় ওই ভদ্রলোককে গ্রেফতার করতে। পুলিশের নির্দেশে, বাইরে থাকা পুলিশকর্মীরা হোটেল রুমের তালাচাবি খোলেন। ভিতরে প্রবেশ করেন দুই অফিসার। কিন্তু তাঁরা পুরো রুম তন্ন তন্ন করে খুঁজে দেখার পরেও ওই ব্যক্তির কোনও খোঁজ পাননি। হোটেলের বাথরুম, জানালা খুঁটিয়ে দেখা হয়। মনে করা হয়, ওই ব্যক্তি হয়তো, জানলা খুলে হোটেল থেকে পালিয়েছেন। কিন্তু তেমন কোনও চিত্র ছিল না। বাইরে নজরদারিতে থাকা পুলিশকর্মীরাও জানান, এই রুমে কেউ আসেননি এমনকী কেউ বেরোননি।

ধন্ধে পড়ে যায় পুলিশ খবর দেওয়া হয় ইমিগ্রেশন অফিসারদের। তাঁর ঘটনার কথা শুনে অবাক হয়ে যান। অফিসারেরা দ্রুত লকারে গিয়ে বাজেয়াপ্ত করা কাগজপত্র ঘাঁটার পরিকল্পনা করেন। কারণ সেখানে ছিল পাসপোর্ট, তার ছবি কপি করে বিভিন্ন থানায় পাঠানোর পরিকল্পনা করা হয়। কিন্তু লকার খুলে তাজ্জব বনে যান অফিসারের। ভদ্রলোকের বাজেয়াপ্ত করা বাক্স, ব্যাগ, কাগজপত্র কিছুই নেই। ঘটনার কথা ছড়িয়ে পড়ে গোটা জাপানে। বিষয়টি এতটাই সংবেদনশীল যে প্রশ্ন উঠতে থাকে, বিমানবন্দরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়েও। বিষয়টিকে একধারে ধামাচাপা দেওয়া চেষ্টা করা হয়, অন্যদিকে একটি গোপন তদন্ত কমিটিও গঠন করা হয়। প্রায় তিন বছর ধরে তদন্ত চালানো হয়। কিন্তু কোনও সূত্র মেলেনি। কারণ ওই ব্যক্তির ছবি, কাগজপত্র এমনকী ব্যক্তির সঙ্গে জড়িত সামন্য সূত্রও পাওয়া যায়নি। এমন একটা ঘটনা আজও অমীমাংসিত হয়ে রয়ে গিয়েছে।

এতো বছর পরেও এই অদ্ভুতুড়ে ঘটনা নিয়ে সাধারণ মানুষের কৌতুহল কম নেই। আম জনতার নজরে এই তথ্য আসার পর, বিভিন্ন ধরণের কনস্পিরেসি থিওরি দাঁড় করিয়েছেন। কেউ দাবি করেছেন, হোটেলের পুলিশকর্মী ও ইমিগ্রেশন দফতরের কর্মীদের মধ্যে নিশ্চয়ই দুর্নীতিগ্রস্ত কেউ ছিলেন, যাঁরা ওই ব্যক্তিকে গা ঢাকা দিতে সাহায্য করেছিলেন। কেউবা দাবি করেছিলেন, ওই ব্যক্তি ছিল সিআইএ এজেন্ট। কেউবা মন্তব্য পোষণ করেছেন, এটি কোনও ভিনগ্রহের মানুষ, বা বহু আগের কোনও মানুষ যিনি টাইম মেসিনে চড়ে ওই সময়ে এসে পড়েছিলেন।