ফিচার

দেশে এমার্জেন্সি পর্ব ও ইন্দিরা গান্ধীর গুপ্তধনের খোঁজ

What happened to Jaigarh Fort’s treasure

The Truth of Bengal: ২৫ জুন ১৯৭৫। দেশের জরুরি অবস্থা জারি করে দিলেন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। সেই সময় রাজনৈতিক পরিস্তিতি ছিল পুরোটাই টালমাটাল। বিরোধীদের বিক্ষোভ তখন চরম রূপ নিচ্ছে। ট্রেড ইউনিয়নগুলির সৌজন্যে দেশের ভারী ও মাঝারি শিল্পগুলিতে তালা ঝুলতে শুরু করেছে। ভারত জুড়ে স্তব্ধ হয়ে গেল রেল। চূড়ান্ত এক নৈরাজ্য অবস্থা। দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির খবর বা সরকারের বিন্দুমাত্র সমালোচনা করলেই সেনার হানা পড়ত সংবাদপত্রের অফিসগুলিতে। সম্পাদক, সাংবাদিক, বিরোধী রাজনৈতিকনেতা সবাইকেই পুরে দেওয়া হল গারদে।

এই সময়ে শুরু হয় এক মহাকাব্যের। তবে এর গোড়া ছিল মুঘল আমলে। ভারত সম্রাট আকবরের দরবারে ছিলেন নবরত্ন। তার মধ্যে অন্যতম বীরবল। এ ছাড়াও উল্লেখযোগ্য ছিলেন আব্দুল রহিম খানেখানা এবং রাজা মানসিং। নবরত্নের মধ্যে সবচেয়ে খাস ছিলেন রাজা মানসিং, একাধিক রাজপুত রাজত্বকে মুঘল সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করার পিছনে তাঁর অবদান অপরিসীম। সম্রাট আকবরের সঙ্গে রাজা মানসিংয়ের একটি চুক্তি হয়েছি। যতগুলি রাজপুত রাজ্য জয় হবে, তার থেকে যা সোনাদানা, হীরে জওহরত মিলবে, তা তোমার। অর্থাৎ মানসিংয়ের।

এরপর একের পর এক রাজপুত রাজাদের হারিয়ে মুঘল সাম্রাজ্যের মানচিত্র বড় করতে থাকেন রাজা মানসিং। একবার সম্রাট আকবর, রাজা মানসিংকে আফগানিস্থানে পাঠান। আকবরের ইচ্ছে ছিল, মুঘল সাম্রাজ্য বিস্তার হোক আফগানিস্থানেও। রাজা মানসিং কাবুল যান, সেখানে বেশ কিছু ছোট গোষ্ঠীকে তিনি হারান। কিংবদন্তী রয়েছে, সম্রাট আকবর, মানসিংকে আফগানিস্থানে পাঠানোর আরও একটি কারণ ছিল, তা হল, বীরবলের মৃত্যুর বদলা নেওয়া। আফগানিস্থানে ইউসুফ জহির নামে একটি গোষ্ঠী ছিল, কিংবদন্তী রয়েছে, বীরবলের মৃত্যুর জন্য এই গোষ্ঠীর নেতাই নাকি দায়ী। ইউসুফ জাহিরের গোষ্ঠীর উপর হামলা চালান মানসিং। সেই যুদ্ধে মারা যান ইউসুফ।

আফগানিস্থানে বহু গোষ্ঠীকে হারিয়ে রাজা মানসিং ও তার সেনা বিপুল সোনা নিজের কব্জায় নেন। কিছু ইতিহাসকারের দাবি, আফগানিস্থান থেকে যে পরিমাণ সোনা বাজেয়াপ্ত করা হয়েছিল, সেই খবর সম্রাট আকবরের কাছে দেওয়া হয়নি।

আফগানিস্থান থেকে উদ্ধার হওয়া বিপুল সোনা, আমেরের দুর্গে লুকিয়ে রাখেন রাজা মানসিং। এরপর বিষয়টি ধামাচাপা পড়ে।  বিষয়টি প্রথমবার চর্চায় আসে একটি আরবি ভাষার বইয়ে। নাম ছিল ‘হফত্ তিলিসমাতে আম্বেরি’। যা বাংলায় তর্জমা করলে দাঁড়ায় আম্বের গুপ্তধন। বইটি যখন প্রকাশ পায়, তা কার্যত দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে। বইয়ের ছত্রে ছত্রে আফগানিস্তান যুদ্ধের কথা লেখা ছিল এবং রাজা মানসিং সোনা নিয়ে কীভাবে হিন্দুস্তানে ফিরেছে, তার পূর্ণ বিবরণ রয়েছে। বইটি যারাই পড়েছে, তারা বিশ্বাস করতে শুরু করে, এই কাহিনি, সত্য, কোনও হাওয়ায় ছোঁড়া গল্প নয়।

মুঘল সাম্রাজ্যের শেষ দিকে ইংরেজরা যখন ভারত শাসনের হাল ধরে, তখনও এই বইয়ের প্রসঙ্গ ওঠে। ইংরেজরাও জয়গড় কেল্লায় কয়েকদফা খানাতল্লাশি শুরু করে। কিন্তু তাদের হাতে কিছুই আসে নি। ধীরে ধীরে, ইংরেজ শাসন যায়, ভারতে স্বাধীনতা আসে।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পরেও, এই গুপ্তধনের চর্চা চলছিলই।  আরবি বইয়ের সূত্র ধরে, ফের একবার গুপ্তধের খোঁজ শুরু হয়। কিন্তু একটা কেল্লায় ঢুকে গুপ্তধনের সন্ধান করা এতো সহজ ব্যাপার নয়। যদিও সেই সময় প্রিন্সলে স্টেটগুলি ভারতের সঙ্গে সংযুক্ত হওয়াতে চুক্তিবদ্ধ হলেও, কেল্লাগুলি রাজাদের ব্যক্তিগত অধীনেই ছিল। ফলে কোনও কেল্লায় সরকারিভাবে হানা দেওয়া সম্ভব ছিল না। সুযোগটা এলো দেশের জরুরি অবস্থায়।

১৯৭১ সালে পাকিস্তান থেকে কেটে বেরিয়ে গেলো বাংলাদেশ। সেই যুদ্ধে ভারতেরও বড় ভূমিকা ছিল। ফলে বিপুল অর্থ খরচ হয় ভারতের। পাশাপাশি টানা কয়েক বছর বর্ষাও ভালো হয়নি, চাষাবাদও হয়নি। প্রায় সব দিক থেকেই ভারতে টানাটানি পরিস্থিতি। অর্থের জন্য বেসরকারিকরণের পথে হাঁটার সিদ্ধান্ত নেওয়া। এদিকে তখন সরাকের উপর চাপা বাড়াচ্ছে  জয়প্রকাশ নারায়ণের আন্দোলন। পুরো সাঁড়াশি আক্রমণের মুখে ইন্দিরার সরকার।

এই কঠিন পরিস্থিতি থেকে  বেরতে নয়া কৌশল নিলেন ইন্দিরা গান্ধী।  ইনকাম ট্যাক্স, সিবিআই, এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেটের মতো এজেন্সিগুলিকে কাজে লাগানো শুরু হল। সেই সময় রাজস্থানের জয়পুর রাজবাড়ির প্রধান ছিলেন গায়ত্রীদেবী। ইন্দিরা এবং গায়ত্রীদেবীর সম্পর্ক ছিল সেই সময় আদায় কাঁচকলায়। কারণ, গায়ত্রীদেবী তিনবার সাধারণ নির্বাচনে দাঁড়ান, তিনবারই কংগ্রেসপ্রার্থীকে হারিয়েছিলেন।

প্রায় এক বছর হয়ে গিয়েছে দেশে জরুরি অবস্থা চলছে। সেই সময়ই সেই আরবি বইয়ের সূত্র ধরে ইন্দিরা গান্ধীকে কয়েকজন ঘনিষ্ট পরামর্শ দেন জয়গড় কেল্লায় হানা দেওয়া জন্য। গুপ্তধন মিললেও মিলতে পারে।

একাংশ রাজনৈতিক বিশ্লেষকের মত, এই হানা দেওয়ার পিছনে সঞ্জয় গান্ধীর দাবি ছিল  সবথেকে বেশি। কারণ ওই সময়, রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক সব জায়গাতেই সঞ্জয়ের দাপট ছিল চরমে।

১০জুন ১৯৭৬। জরুরি অবস্থা চলাকালীন জয়গড় কেল্লায় ইনকাম ট্যাক্সের টিম পাঠানো হল। তার আগে গায়ত্রীদেবীকে গ্রাফতার করা হয়, বেআইনি ভাবে বৈদেশিক মুদ্রা রাখার অভিযোগে। তবে জয়গড় কেল্লায় যে শুধু আইটি অফিসারদের পাঠানো হয়েছিল তা নয়, পাশাপাশি পাঠানো হয় সেনাও। খবর ছড়িয়ে পড়ে, রাজা মানসিংয়ের গুপ্তধনের খোঁজে এই আইটি ও সেনা অভিযান জয়গড় কেল্লায়। বেশ কয়েকদিন ধরে চলে তল্লাশি। খবর ছড়িয়ে পড়ে, তল্লাশী চলাকালীন স্বয়ং সঞ্জয় গান্ধী একটি চপারে চড়ে জয়গড় কেল্লায় প্রবেশ করেছেন। গুজব ওঠে, বিপুল সোনা উদ্ধার হচ্ছে এবং নিয়ে যাওয়া হবে।

প্রশ্ন উঠতেই পারে, আরবি বইয়ের সূত্র ধরলে, রাজা মানসিং আম্বের কেল্লায় গুপ্তধন রেখেছিলেন। তাহলে জয়গড় কেল্লায় ইন্দিরা গান্ধী হানা কেন দিতে বলেছিলেন? আসলে ১৭২৬ সালে রাজা দ্বিতীয় মানসিং জয়গড় কেল্লা নির্মাণ করান। কিংবদন্তী রয়েছে, এই জয়গড় কেল্লায় একটি সুরঙ্গ পথ রয়েছে, যা আম্বের কেল্লার সঙ্গে যুক্ত।

কাহিনি হল, সবার নজরে জয়গড় কেল্লায় তল্লাশি চললেও, বাস্তবে আম্বের কেল্লায় গুপ্তধনের খোঁজ চলছিল। খবর ছড়িয়ে পড়ে। সেই সময় এমনও কিছু কথা ওঠে, গুপ্তধনের খোঁজে সেনা, পুরাতত্ত্ব আধিকারিকরা জয়গড় কেল্লায় বিভিন্ন জায়গায় খুঁড়ে প্রায় তাণ্ডব চালায়। ধীরে ধীরে খবর জয়পুর ছাড়িয়ে দিল্লিতেও ছড়াতে থাকে। যদিও সংবাদপত্রের মুখ বন্ধ থাকায়, এই সংক্রান্ত কোনও খবরই প্রকাশ করা হচ্ছে না। কোনও না কোনও সূত্র ধরে, খবর ছড়িয়ে পড়ে পাকিস্তানেও।

সেই সময় পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন জুলফিকার আলি ভুট্টো। ১১ অগাস্ট ১৯৭৬ সালে জুলফিকার ইন্দিরাকে একটি চিঠি লেখেন।  তল্লাশি শুরু হওয়ার প্রায় দু মাস পর। তিনি জানান, জয়গড় কেল্লায় আপনি গুপ্তধনের খোঁজ চালাচ্ছেন। তা পাওয়া গেলে,  পাকিস্তানকেও তার হিসেব বুঝিয়ে দিতে হবে। জুলফিকারের দাবি ছিল, দেশ ভাগ হওয়ার সময় ওই সম্পত্তি সম্পর্কে কারও কাছে কোনও তথ্য ছিল না। তাই সেই সম্পত্তি পাওয়া গেলে তার মধ্যে পাকিস্তানেরও অধিকার রয়েছে।

জুলফিকারের পাঠানো সেই গোপন চিঠি ফাঁস হয়ে যায়। চিঠির কথা ফাঁস হতে চর্চা আরও জোরালো হয়। জয়গড় কেল্লায় যে খানাতল্লাশি চলছে, তাহলে তা সত্যি। গুপ্তধনের সারবত্তা নিশ্চয়ই রয়েছে। যদিও এই চিঠির প্রেক্ষিতে ইন্দিরা পাল্টা কোনও উত্তর দেননি।

নভেম্বর ১৯৭৬ ইন্দিরা নির্দেশ দেন, গুপ্ত সম্পত্তির খানাতল্লাশি বন্ধ করার। প্রায় ৫ মাস তল্লাশির পর এই সিদ্ধান্ত। এর পর ইন্দিরা গান্ধী জুলফিকারকে একটি চিঠি লেখেন, যা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। সেটি হল, এখানে যে সম্পত্তি পাওয়া গেছে, তাতে পাকিস্তানের কোনও অধিকার নেই। আর সবচেয়ে বড় বিষয় হল, এই তল্লাশিতে কোনও সম্পত্তি মেলেনি, ফলে এই বিষয় নিয়ে বাড়তি কোনও আচোলনার প্রয়োজন নেই।

ইন্দিরা অফিসিয়ালি স্বীকার করেছিলেন, এই তল্লাশিতে মাত্র ২৫০ কেজির মতো রুপোর জিনিসপত্র মিলেছে। এই সময়ই আর এক সন্দেহের জন্ম নেয়। কারণটা, যেদিন ইন্দিরা তল্লাশি বন্ধের নির্দেশ দিয়েছিলেন, ঠিক তার আগের দিন, দিল্লি-জয়পুর হাইরোড পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়া হয়। সেটি পুরোপুরি চলে যায়  সেনার দখলে। আচমকা এমনটা কেন করা হয়েছিল, তার উত্তর দেয়নি সরকার। সেদিন সেনার ট্রাক ছাড়া আর কিছুই চলাচল করেনি দিল্লি-জয়পুর হাইরোডে। আর ট্রাকগুলি আসছিল জয়গড় কেল্লা থেকে দিল্লিতে।

খবর ছড়িয়ে পড়ে ৫০-৬০টি সেনার ট্রাকেই বিপুল গুপ্তধন জয়পুর থেকে দিল্লি নিয়ে আসা হয়েছে। এরপর গুজব দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে, ওই বিপুল ধনসম্পত্তি রাতারাতি দুটি বিমানে করে স্যুইজারল্যান্ডে পাঠানো হয়েছে। যদিও এই খবরের সত্যতা কেউ আজ পর্যন্ত দিতে পারেনি।

প্রশ্ন উঠতে থাকে, আরবি বইয়ে উল্লেখিত এতো ধনসম্পত্তি তাহলে কোথায় গেল? পরে একটা কাহিনি চালু হয়, যে রাজা দ্বিতীয় জয়সিং এই পুরো সম্পত্তি খরচ করেছিলেন, জয়পুর শহর তৈরি করার জন্য। বিষয়টি বিশ্বাসযোগ্য হলেও, কতগুলি প্রশ্নের উত্তর এখনও অমিল। কেন ৫ মাস ধরে জয়গড় কেল্লায় তল্লাশি চালানো হয়েছিল? কেন পুরো একটা দিন দিল্লি-জয়পুর হাইওয়ে ব্লক করে দেওয়া হয়েছিল? সম্পত্তি যদি পাওয়াই না যায়, তাহলে কেন সেনার ট্রাক ডাকা হয়েছিল আর সেগুলি ফাঁকা অবস্থায় দিল্লিতে ফেরৎ কেন পাঠানো হয়েছিল? দিনের পর দিন সেনার পদস্থ আধিকারিকদের কেল্লা চত্বরে কেন আসতেন? এবং স্বয়ং সঞ্জয় গান্ধী কেন চপারে করে কেল্লায় গিয়েছিলেন? না এই সমস্ত রহস্যমাখা প্রশ্ন আজও অমীমাংসিত।

Related Articles