ফিচার
Trending

কলকাতা শহর যখন জন্ম নিচ্ছে সেই সময় খেজুরির বৈভব, জানুন হারিয়ে যাওয়া খেজুরি বন্দরের ইতিকথা

History of Khajuri Port

The Truth Of Bengal : বাংলায় আনাচে কানাচে লুকিয়ে রয়েছে, এক অনন্য ইতিহাস। কিছু হারিয়ে গিয়েছে সময়ের গর্ভে, কিছু স্মৃতি রয়ে গিয়েছে সময়ের ক্ষত বুকে নিয়ে। আজকের চেনা বাংলার অজানা কথায় থাকছে এমনই এক ইতিহাসের কথা, যা এখনও এক দুর্লভ ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করে চলেছে। কিন্তু, আগামী দিনে, তা হয়তো সময়ের গর্ভে হারিয়ে যাবে। অপেক্ষা করছে অন্তর্জলি যাত্রার।  আজ আমরা খুঁজে দেখব এমন এক ইতিহাসের অধ্যায়কে যা হয়তো বাংলার পর্যটন শিল্পকে অনন্য মাত্রায় পৌঁছে দিতে পারত। দেশি বিদেশী পর্যটকদের কাছে হয়ে উঠতে পারত কৌতুহলী ইতিহাসপ্রেমীদের কাছে এক প্রচীন গড়। কিন্তু তা হয়নি। পূর্ব মেদিনীপুরের খেজুরি, জায়গাটার নাম সংবাদ শিরোনামে উঠে এসেছিল একটা সময়ে। স্রেফ রাজনৈতিক কারণে। কিন্তু খেজুরির আরও একটি গর্বের পরিচয় এখনও রয়েছে। তা হয়তো মলিন হয়েছে, কিন্তু পুরোপুরি হারিয়ে যায়নি। অথচ এই খেজুরিতেই জন্ম নিয়েছিল, ভারতের সর্বপ্রথম পোস্ট অফিস। এখানেই গড়ে উঠেছিল এক বৃহৎ বন্দর, তার সঙ্গে তৈরি হয়েছিল ছোটখাটো নগর। আর সেই বন্দর থেকেই রাজা রামমোহন রায় শেষবারের মতো দেশ ছেড়ে লন্ডনে পাড়ি দিয়েছিলেন। আজ সেইসব ইতিহাসের আকর খণ্ডহরে পরিণত হয়েছে।

ফোর্ট উইলিয়ম থেকে উলুবেড়িয়া পর্যন্ত প্রায় ২০ মাইল নদীর প্রবাহ দক্ষিণ পশ্চিমাভিমুখী।  উলুবেড়িয়া থেকে পরবর্তী কুড়ি মাইল নদী দক্ষিণমুখী। এখানেই হুগলি পয়েন্ট। ফোর্ট উইলিয়ম ও উলুবেড়িয়ে থেকে দক্ষিণে যাত্রাপথে ডানদিক থেকে একাধিক নদীর ধারা এসে মিলিত হয়েছে। দামোদর, রূপনারায়ণ, হলদী ও রসুলপুর নদী প্রধান। রূপনারায়ণ ও ভাগীরথীর সঙ্গম স্থলই হুগলি পয়েন্ট। এখানেই নদীর বাঁক সবচেয়ে ভয়াবহ। অষ্টাদশ শতাব্দীর সময় থেকে বিদেশি নাবিকরা এই বাঁকটিকে বিশেষ ভাবে মনে করে, জাহাজ ভেড়াতেন।  ইতিহাস বলছে, এখানকার ঘূর্ণিস্রোত ছিল অত্যন্ত ভয়াবহ। ফলে জাহাজডুবির আশঙ্কা লেগেই থাকতো। এই ভাগীরথী সোজা গিয়ে মিশেছে বঙ্গোপসাগরে।

অধুনা পূর্ব মেদিনীপুরের হিজলি ও খেজুরির মধ্যবর্তী সীমানা ভাগ করতো কুঞ্জপুর খাল। এই স্থানটির একটা বিশেষ গুরুত্ব ছিল নবাবী আমলে। জায়গাটিকে বলা হত, নিমক মহল। নীচু জলা জায়গায় জলের অভাব ছিল না, নোনা জল থাকায়, নুন তৈরির আদর্শ জায়গা ছিল। যদিও জায়গাটি খুব একটা নিরাপদ ছিল না। বুনো শুয়োর, মোষ, বাঘের দাপট ছিল প্রচণ্ড। আর ইংরেজরা আসার পরেই এই জায়গার চেহারা বদলাতে শুরু করে। বাংলাদেশ থেকে সমুদ্রপথে যাত্রার মুখেই ছিল খেজুরি ও হিজলি।

কলকাতা শহর যখন জন্ম নিচ্ছে, অর্থাৎ জব চার্নকের আমল থেকেই খেজুরিতে প্রধান বন্দর  ও পোর্ট অফিস গড়ে ওঠে। সেই সময় খেজুরির বৈভব কতটা উঁচুতে উঠেছিল, তার প্রমাণ মেলে ১৭৯২ সালের ক্যালকাটা গেজেটে প্রকাশিত একটি নিলামের বিজ্ঞপ্তি থেকে।

আট বিঘার জমির উপর বারান্দা, হলঘরসহ প্রকাণ্ড অট্টালিকা খেজুরিতে একাধিক তৈরি হয়েছিল। ১৭৯২ সালে যে বাড়ি নিলাম হয়েছিল, সেইরকম একটি বাড়িও এখন আর নেই। বিদেশী বণিক ও নাবিকদের প্রধান বিশ্রাম আড্ডার স্থান ছিল খেজুরি।  ঘরবাড়ি, বন্দর, অফিস, এজেন্ট হাউস, ডাক অফিস ইত্যাদি ছিলই। তার সঙ্গে সেকালের ট্যাভার্ন ও হোটেলও ছিল খেজুরি বন্দর চত্বরে।  বিদেশীদের এমন কোনও বাণিজ্যকেন্দ্র, বসবাসকেন্দ্র বা বন্দর ছিল না, যেখানে ট্যাভার্ন, কফিহাউস বা হোটেল ছিল না। কলকাতা, শ্রীরামপুর, হুগলি ও খেজুরিতে ছিল বিখ্যাত ট্যাভার্ন। সেইসব ট্যাভার্নের অস্তিস্ব বর্তমানে খেজুরিতে নেই।

একটা সময়, খেজুরিতে উপদ্রব ছিল, মগ, ফিরিঙ্গি জলদস্যুদের, বন্যজন্তুদের উপদ্রবতো ছিলই। খোজুরি অঞ্চল মানুষের বসবাসের উপযোগী হয়ে ওঠে কোম্পানির আমল থেকে। কলকাতায় যখন বন্দর হয়নি, তখন খেজুরিতেই ছিল প্রধান বন্দর।

এক সময় মালবোঝাই বড় বড় জাহাজ যখন কলকাতায় পৌঁছত না, তখন খেজুরিতেই নোঙর ফেলে উপকূলে অবস্থান করত। তারপর খেজুরি থেকে স্নুপ বা ছোট মালবাহী নৌকায়, পণ্য পৌঁছত কলকাতা, হুগলিতে।  ফলে, কলকাতা সবে তখন কিশোর হলেও, খেজুরির গুরুত্ব ছিল মারাত্মক। ফলে ইংরেজরা ছোট নগরও গড়ে তোলে। খেজুরি শুধু বন্দর নয়, ব্রিটিশদের কাছে স্বাস্থ্যোদ্ধারের ভাল জায়গাও ছিল। বহু ইংরেজ কর্মী খেজুরিতেই থাকতেন এবং দীর্ঘকাল থেকে তাঁরা ওখানেই দেহ রাখতেন। তার বড় প্রমাণ গোরস্থান।  সাহেবদের গোরস্থান ঘুরলে বেশ কিছু তথ্য জানতে পারা যায়। খেজুরির অতীত জীবনের  হৈ-হুল্লোড়, হাসিকান্নার দিনগুলোর বেশ কিছু কথা এখনও গোরস্থানে খোদিত রয়েছে।

ইতিহাসে হিজলি শরিফ

খেজুরির ইংরেজ আমলের বন্দর ও ছোট নগরী আজ অনেকটাই হারিয়ে গিয়েছে। এই বন্দরের কাছেই হিজলিতে আরও একটি ঐতিহাসিক স্থান রয়েছে। সেটি হল, তাজ-খাঁ-মসনদ-ই আলার মসজিদ। একটা সময়,

ভাগীরথী দিয়ে বঙ্গোপসাগরের পথে সমুদ্রযাত্রাকালে  এবং যাত্রাশেষে ভাগীরথীর মোহনায় প্রবেশকালে, দূর থেকে নাবিক, বণিক  ও অন্যান্য যাত্রীরা এই মসজিদ দেখতে পেতেন। পর্তুগিজ, ডাচ, ফরাসি, ইংরেজ প্রত্যেক জাতের বণিকরা দূর থেকে এই মসজিদকে দেখেই কুলের কিনারা পেতেন।

এই প্রচীন মসজিদ, শুধু বিদেশী বণিকদের কাছেই গুরুত্বপূর্ণ নয়, স্থানীয় মাজিমাল্লাদের কাছেও যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। আসলে মছলন্দিরের পীরের উদ্দেশে ভক্তি দেখাতো সবাই।

সেকালে পাঠান সেনাপতিরা যুদ্ধে নিহত হলে পির-গাজি রূপে  বিবেচিত হতেন। সেই সঙ্গে মুলসলিম ফকির দরবেশ সাধুরাতো পেতেনই। এইসব পিরস্থানের দৈব মাহাত্ম্য ক্রমে সর্বসাধারণের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। তবে ইতিহাস থেকে জানা যায়,

হিজলির মছলন্দি পির কোনও নিহত বীর সৈনিক ছিলেন না। ধর্মপ্রচারক কোনও ফকিরও নন। তিনি একজন ঐতিহাসিক ব্যক্তি, তাঁর আসল নাম তাজ খাঁ মসনদ-ই আলা। হিজলি অঞ্চলে তিনি রাজত্ব করতেন। ধর্মপ্রাণ ও উদার জমিদার হওয়ার দরুণ তিনি, পূজা পান।

তাজ খাঁ নিয়ে যাঁরা দেশী বিদেশী গবেষকেরা যাঁরা ইতিহাস রচনা করেছেন, তাঁদের অধিকাংশ কিংবদন্তীতে ভিত্তি করে লিখেছেন। তবে যেটুকু প্রমাণ্য তথ্য পাওয়া যায়, তার থেকে জানা গিয়েছে, বাংলাদেশের হুসেন শাহের রাজত্বকালে উড়িষ্যার সীমান্তে সমুদ্রের তীরে  চণ্ডীভেটি মৌজার মনসুর ভুঁইয়া  নামে একজন  ক্ষমতাশালী  মুসলিম জমিদার বাস করতেন। তাঁর দুই পুত্র ছিল।  জামাল ও রহমৎ। জামাল ছিলেন বিষয়বুদ্ধি সম্পন্ন। এবং রহমৎ কুস্তী, শিকার নিয়ে সময় কাটাতেন। লোকের কুপরামর্শে রহমতের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে জামাল তাঁকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র করে।  জামালের বিবি এই চক্রান্তের কথা রহমতের কাছে প্রকাশ করে দেয়। এরপরেই রহমৎ এলাকা ছেড়ে পালান। এবং

গুমগড় পরগনায় সমুদ্রতীরে অরণ্যের মধ্যে জেলেদের এলাকায় উপস্থিত হন। সেখানেই সে ৫০০ জেলেদের নিয়ে লাঠিয়াল বাহিনী তৈরি করেন। তাদের নিয়ে জঙ্গল সাফাই করে, বাসস্থান গড়ে তোলেন। এই সময় চাঁদ খাঁ নামে এক বণিকের সঙ্গে পরিচয় হয়। বাণিজ্যযাত্রার সময় চাঁদ খাঁ হিজলিতে পানীয় জল সংগ্রহের জন্য অবতরণ করেন। সেই সময়ই রহমতের সঙ্গে চাঁদের পরিচয় হয় ও কিছু ধনপ্রাপ্তি হয়।

রহমৎ ভীমসেন মহাপাত্র নামে এক ব্যক্তিকে প্রধান পরামর্শদাতা হিসেবে নিযুক্ত করেন। পরে লোকবল বাড়িয়ে আশেপাশের অঞ্চল দখল করেন। এই সব জায়গায় প্রচুর হিজল গাছ ছিল বলেই, নাম হিজলি।  তারও পরে, রহমৎ উড়িষ্যার সুবেদার বাকর খাঁয়ের কাছ থেকে সনদ পান এবং ইখতিয়ার খাঁ উপাধি পান । ইখতিয়ারের পুত্র দাউদ খাঁ পরে হিজলির অধিপতি হন। দাউদ খাঁয়ের বহু পুত্রসন্তান ছিল, তাঁদের মধ্যে অন্যতম তাজ-খাঁ-মসনদ-ই আলা।  এটি একটি ইতিহাস, কিন্তু এখানেও কিছু সন্দেহের অবকাশ রয়েছে ইতিহাস গবেষকদের মনে। প্রামাণ্য তথ্য বলছে, ১৬২৮ থেকে ১৬৪৯ পর্যন্ত  তাজ খাঁ মসনদ-ই আলার রাজত্বকাল। মুঘল যুগে তাজ খাঁর নামের সঙ্গে  মসনদ-ই আলা উপাধি স্থানীয় মানুষেরা ব্যবহার করতেন। এমনকি, তাঁর নাম নিয়ে ফকিরেরাও গান করে ভিক্ষে করে বেড়াতেন। সেই ধারার গীত হল মসন্দলীর গীত।

হিজলির তাজ মসনদ-ই আলার মৃত্যুর পর, ১৬৫১ সালে  ইংরেজ বণিকরা বাংলাদেশের প্রথম বাণিজ্যকুঠি তৈরি করে হুগলিতে।  তার আগেই বালেশ্বর থেকে বাংলার জন্য বাণিজ্যের লেনদেন চলত। হিজলি ও খেজুরির ইতিহাস এখানেই শেষ নয়। ব্রিটিশরা হিজলি ও খেজুরি এলাকায় ঘাঁটি গাড়ার পর, এখানকার ছবিটা ধীরে ধীরে বদলাতে শুরু করে। যদিও, সেই সময় ব্রিটিশদের পক্ষে এই এলাকায় ঘাঁটি তৈরি করা খুব একটা সুখকর ছিল না।

১৬৮২ সালের অগাস্টে উইলিয়ম হেজেস কোম্পানির প্রথম গভর্নর ও এজেন্ট হুগলিতে এসে দেখেন, নবাব শায়েস্তা খাঁয়ের কর্মচারীরা বাণিজ্যে নানা রকম সমস্যা তৈরি করছে। ১৬৮৬ সালে ২৮ অক্টোবর ইংরেজ কুঠির তিনজন সৈন্য হুগলির বাজারে আক্রান্ত হন।

মুঘল ফৌজদার আব্দুল গনি  কুঠি আক্রমণ করেন এবং কাঁচা ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেন।  সেই সময় জব চার্নক ছিলেন হুগলির কুঠির কর্মচারী। চার্নক সৈন্য নিয়ে ভাগিরথীর পূর্ব তীরে  পালিয়ে আসেন। সেকান থেকে গার্ডেনরিচের দুর্গ অধিকার করে, হিজলি দ্বীপ আক্রমণ করে  দখল করেন।

১৬৮৭ সালের মে মাসে  শায়েস্তা খাঁ ১২ হাজার সৈন্য নিয়ে হিজলি থেকে ইংরেজদের বিতাড়িত করতে অভিযান চালান। প্রচণ্ড যুদ্ধ হয় ইংরেজ ও শায়েস্তা বাহিনীর মধ্যে। ইংরেজরা হিজলি ছাড়তে বাধ্য হয়। যদিও শায়েস্তা খাঁ তাদের উলুবেড়িয়াতে থাকার অনুমতি দেন। চার্নক, উলুবেড়িয়াতে ঘাঁটি গাড়ে। ফের গণ্ডগোল বাঁধায়, চার্নক সুতানুটিতে আসতে বাধ্য হন।

আজকের দৃষ্টিতে পূর্ব মেদিনীপুরের খেজুরি হিজলি অঞ্চল কার্যত গুরুত্বহীন একটি এলাকায় পরিণত হলেও, একটা সময় এই অঞ্চলের গুরুত্ব কতটা ছিল, তার নজির ইতিহাস থেকে মেলে। যে জায়গাকে ঘিরে একটা সময় যুদ্ধ হয়েছিল, বাণিজ্যের জন্য বন্দর গড়ে উঠেছিল, সেই সব জায়গাই আজ অনাদরে অবহেলায় হারিয়ে যাচ্ছে।

 

FREE ACCESS

 

Related Articles