কেন বারবার উত্তপ্ত হয়ে ওঠে পার্বত্য চট্টগ্রাম, ভারত-বাংলাদেশের এক ছাই চাপা আগুনের ইতিহাস
তোমাদের কোনও কথা শুনবো না, তোমরা বাঙালি হয়ে যাও

The Truth of Bengal: কয়েকবছর আগের একটা ঘটনা। কিছুটা বিড়ম্বনাতেই ফেলে দিয়েছিল ভারত সরকারকে। মিজোরামের ৪ ছাত্র এম বি বি এসের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। তারা পুরো মেধার ভিত্তিতেই পাস করেছিল। সেখানে কোনওরকম কারচুপি বা জালসাজি ছিল না। তা সত্ত্বেও তাঁদের আসন দিতে অস্বীকার করে মিজোরাম সরকার। এই ঘটনার পরেই কেন্দ্র সরকার মিজোরামে ম্যাডিকেলের যে আসন সংখ্যা ছিল তা কম করে দেয়। এটা নিয়ে মিজোরাম ও কেন্দ্রসরকারের মধ্যে একটা চাপান উতোরও চলেছিল। ৪ ছাত্রকে আসন দিতে না চাওয়ার কারণ ছিল, তারা চকমা উপজাতির ছাত্র।
এখন প্রশ্ন এমন কী বিপর্যয় ঘটল যে ৪জন চাকমা উপজাতির ছাত্র মেডিক্যালে চান্স পেয়েও পড়তে পারল না! আর এদের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কই বা কী?
স্বাধীনতার পর থেকে দণ্ডমুণ্ডের কর্তাদের মূল নজর ছিল মূলত হিন্দি বেল্টকে ঘিরেই। অর্থাৎ, দিল্লি, উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, বিহারকে ঘিরে (পরে কিছু রাজ্য ভেঙে নতুন তৈরি হয়েছে) কিন্তু অবহেলায় ছিল উত্তর পূর্ব ভারত। সেখানকার সমস্যা নিয়ে কেন্দ্রের কোনও সরকারই সে গুরুত্ব কোনও দিন দেয়নি।
ভারতের পূর্বে রয়েছে বাংলাদেশ, বঙ্গোপসাগর ও উত্তর পূর্ব ভারতের বেশ কয়েকটি রাজ্য। বাংলাদেশের কিছুটা বর্ডার শেয়ার করে মায়ানমার। বাংলাদেশের বাকি ৯৫ শতাংশই সীমাই ভারত লাগোয়া। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বে রয়েছে ত্রিপুরা ও মিজোরাম। এই দুই রাজ্যে লাগোয়া অঞ্চলকেই বাংলাদেশে বলা হয় পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকা। বাংলাদেশের চট্টগ্রাম ডিভিশনের তিনটি জেলা হল, খাগড়াছরি, রাঙামাটি, বান্দরবন। বহু বছর ধরেই চকমা উপজাতির মানুষেরা এখানেই থাকতো। একটা সময় চকমা জনজাতি কিছু মানুষ মায়ানমারের দিকে চলে যায়, কিছু চলে আসে ভারতে, আর কিছু অংশ থেকে যায় পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে। পার্বত্য চট্টগ্রামে আরও কিছু উপজাতি রয়েছে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত এই পার্বত্য চট্টগ্রামের বিশাল এলাকা একটা জেলা হিসেবেই পরিচিতি ছিল, পরে তিনটি জেলায় ভাঙা হয়।
এখানকার চাকমা উপজাতি মানুষেরা বৌদ্ধ ধর্মালম্বী। চট্টগ্রামের পার্বত্য অঞ্চলে যে সমস্ত উপজাতিদের বাস, সেগুলি হল, চকমা, হাজোং, সারমা, ঊীগজহী, মরো, বৌম, পাংখু, খ্যায়াং, খুমি, চাক, লুসাই, তানচাংগ্যা। এদের সবাইকে মিলিয়ে বলা হয় জুম্মা। জুম্মার কথার অর্থ যাঁরা পাহাড়ের অধিবাসী। এদের মধ্যে সব থেকে বেশি জনসংখ্যা রয়েছে চকমারা। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ধর্মনিরপেক্ষ থাকলেও, পরে ইসলামিক দেশ হিসেবে পরিচিতি পায়। সেখানে হিন্দুদের পাশাপাশি এরাও সংখ্যালঘু হিসেবে বিবেচিত। বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় যে উপজাতিরা রয়েছে, তারা এখানকার আদিম জনগোষ্ঠীও বটে।
অখণ্ড ভারতে ব্রিটিশরা ক্ষমতা কেয়েম করার পর, ১৮৬০ সালে বাংলাদেশেও দখল জমায় ইংরেজরা। ১৯০০ সালে ব্রিটিশরা সি এইচ টি (চট্টগ্রাম হিল ট্র্যাক্ট) রেগুলেশন তৈরি করে। এটি তৈরি হয়েছিল, এখানকার এই আদিম জনজাতিদের কথা মাথায় রেখেই। রেগুলেশনে উপজাতিদের স্বায়ত্তকে মেনে নিয়েছিল ইংরেজরা। এমনকি এখানকার জমিও ওই জনগোষ্টী ছাড়া আর কেউ কিনতে পারবে না এবং ব্যবহারও করতে পারবে না বলে আইন তৈরি করেছিল।
১৮৬০ থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত অধুনা বাংলাদেশের এই অঞ্চল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাইরে ছিল। অর্থাৎ এদের বিষয়ে কোনও দিনই ব্রিটিশরা নাগ গলায়নি। ১৯০০ সালে সি এইচ সি রেগুলেশন, সেই ভাবনায় কার্যত রক্ষাকবচের ব্যবস্থা করে ইংরেজরা। ফলত বাংলাদেশের মুসলিম নাগরিকরা এই অঞ্চলে সেভাবে জায়গা করতে পারেনি।
১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীন হল, পাশাপাশি দ্বি জাতি তত্ত্বে দেশও ভাগ হল। এই সময়ই পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্মারা (সমস্ত উপজাতিরা) ভারতের সঙ্গে থাকতে চায় বলে দাবি জানায়, কারণ সেই সময়ই সেখানে ৯৭ শতাংশ বৌদ্ধ ধর্মালম্বী। ১৯৪৭ সালে সিলেট ডিভিশন সহ পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকা জুড়ে গণভোট হয়। সিলেট ডিভিশনের বহু মানুষ জানায় তারা পাকিস্তানের সঙ্গে থাকতে চায়, অন্যদিকে অধুনা পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকার মানুষ জানায়, তারা ভারতের সঙ্গে যুক্ত হতে চায়। বিষয়টি নিয়ে জওহরলাল নেহেরু এবং সর্দার বল্লভ ভাই প্যাটেল সি এইচ টি ইউনিটের সদস্যদের আশ্বস্ত করেন। প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয় সি এইচ টি ভারতের সঙ্গেই থাকবে।
এখানে একটু ব্যাকগ্রাউন্ড বলে রাখা ভালো। ১৯০৫ সালে লর্ড কার্জন ধর্মের ভিত্তিতে বঙ্গভঙ্গ করেন। সেই সময়, সিলেটকে অসমের সঙ্গে যুক্ত করে দেওয়া হয়। এবং সিলেটের অংশ ছিল এই সি এইচ টি বা পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল। কিন্তু ৪৭ সালে গণভোট হল সিলেটে, আর সিলেটে যেহেতু মুসলিম জনসংখ্যা বেশি, তাই পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষকেও যেতে হয় পাকিস্তানের সঙ্গে। এর পরেই বাউন্ডারি কমিশন বসে, তার প্রধান ছিলেন সিরেল রেডক্লিফ। তিনি চকমাদের এলাকা পাঠিয়ে দিলেন পাকিস্তানে।
এটা করার কারণ ছিল, ভারতের হাতে ছিল কলকাতা পোর্ট। তাই পাকিস্তানকেও চট্টগ্রাম পোর্ট দিতে হত। তাই, চট্টগ্রাম এলাকাকে ঢোকানো হল পূর্ব পাকিস্তানে। চাকমারা পাকিস্তান অন্তর্ভুক্তির পরেও, রাঙামাটিতে তারা ভারতের পতাকা তোলা শুরু করে এর প্রতিবাদ জানিয়ে। পাকিস্তানের তরফে এদের সমস্যার কথা না বুঝে বিশ্বাসঘাতক তকমায় দায়িগে দেওয়া হয়। এর পরেই পাকিস্তান সরকার, চকমাদের এক্সক্লিউটেড গ্রুপ (ইংরেজদের দেওয়া) নাম পাল্টে ট্রাইবাল গ্রুপ বলে নোটিফিকেশন জারি করে। এর ফলে যেটা হল, আগে এখানে তাদের উপজাতি ছাড়া যেখানে অন্য কারও প্রবেশ নিষেধ ছিল, সেখানে অন্যরাও আসতে শুরু করলো।
এর পরেই এই অঞ্চলের মূল দুই উপজাতি চাকমা ও হাজোংদের বের করা শুরু হল। উপজাতিদের উচ্ছেদ করে পাকিস্তান সরকার বানানো শুরু করলো, কাপ্তাই হাইড্রো ইলেকট্রিক পাওয়ার প্রোজেক্ট। ১৯৬২ সালে এই প্রকল্পের সূচনা হয়। জলাধার তৈরির জন্য প্রায় ১ লক্ষ উপজাতিকে ওই অঞ্চল থেকে সরিয়ে দেওয়া হয় সেনা দিয়ে। ফলে ৭০ শতাংশ চকমা উপজাতির মানুষ পালিয়ে যেতে বাধ্য হন নিজ ভূম ছেড়ে। কিন্তু এদের ঠাঁই হয় না অন্য কোথাও, কারণ ওই অঞ্চল বাদ দিলে বাংলাদেশের ৯৪ শতাংশ জায়গাই মুসলিম অধ্যুষিত।
অগত্যা সেই সময় চকমারা মূলত আসতে থাকে অসমের লুসাই হিল বা পার্বত্য এলাকায়। যা আজ মিজোরাম রাজ্য বলে পরিচিত। এরা উদ্বাস্তু হওয়ার ফলে ভারত তাদের জায়গা দিতে শুরু করে। ১৯৬৪ সালে অসমের গভর্নর বিষ্ণু সহায় আশঙ্কা প্রকাশ করেন, অসমের মিজো উপজাতিদের সঙ্গে চাকমা উদ্বাস্তু জনজাতিদের মধ্যে গণ্ডগোল দানা বাঁধতে পারে। সেই সময় অসমের রাজ্যপাল, রাজ্যসরকারের কাছে দাবি জানায়, চকমাদের পাঠানো হোক, নর্থ ইস্ট ফ্রন্টিয়ার এজেন্সিতে, যা আজ অরুণাচল প্রদেশ বলে পরিচিত।
১৯৬৪ থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত এই চাকমারা তিরাপ, লোহিত ও সুবানশিরি জেলায় বাসা জমাতে শুরু করে। এবার আপত্তি জানাতে শুরু করে অরুণাচল প্রদেশ। সেখানকার জনজাতিরাও চাইত না, বাইরের লোক এসে তাদের প্রতিযোগী হয়ে উঠুক। তবে সেই সময় অরুণাচলে তেমন জনপ্রিয় নেতাও ছিল না, আর সরকারও তেমন জোরালো ছিল না। ফলে ওখানকার আদি জনজাতিদের আপত্তি থাকলেও, কেউই গুরুত্ব দেয়নি। চকমারা যখন বেশি পরিমাণে আসতেই থাকে, তখন ওখানে স্টুডেন্ট ইউনিয়ন তৈরি হয়। এরাই প্রথম চকমাদের বিরুদ্ধে জোরদার আন্দোলন শুরু করে। এবং দাবি জানায় চকমারা আসলে বিদেশী। ফলত অ্যান্টি ফরেনার মুভমেন্ট শুরু হয় অরুণাচলে। ধীরে ধীরে তা আশে পাশের রাজ্যগুলিতেও ছড়িয়ে পড়ে। শুরু হয় চাকমা বিরোধী আন্দোলন।
এদিকে অসম, ত্রিপুরা, ও মিজোরামে চকমারা নাগরিকত্বের অধিকার পেতে শুরু করেছিল। তাদের তফশিলি উপজাতি মর্যাদা দেওয়া হয়। মজার ব্যাপার এই অধিকার দেওয়ার ফলে, ত্রিপুরা, মিজোরাম, অসমে আদি তফশিলি উপজাতি যারা ছিল, তাদের সংরক্ষণে ভাগ বসাতে শুরু করলো চাকমারা। এদিকে অরুণাচলে সবচেয়ে বেশি বিক্ষোভ ছিল চকমাদের নিয়ে। এর কারণটা ছিল, জম্মু ও কাশ্মীর যেমন ভারতে বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত রাজ্য ছিল, তেমনই বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত রাজ্য অরুণাচল। বিশেষ সাংবিধানিক রক্ষাকবচ রয়েছে।
যদিও অরুণাচলে আশঙ্কা তৈরি হতে থাকে, চাকমারা নাগরিকত্ব পেলে, ভোটের অধিকার পেলে আরও শক্তিশালী হয়ে উঠবে। ফলে তাদের অধিকার খর্ব হবে। অরুণাচলবাসীরা মনে করতে শুরু করলো, তাদের এলাকা ডাম্পিং গ্রাউন্ড হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে, যেখান সেখান থেকে উদ্বাস্তুদের এনে ভরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। সেই সময়ে অবশ্য অসমের রাজ্যপাল তাই করেছিলেন। কারণ অরুণাচলে প্রায় ৭০ শতাংশ জমি খালি। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ তৈরি হল, পূর্ব পাকিস্তানের অধ্যায় শেষ হয়। এর পরেই চকমারা নিজেদের অধিকারের জন্য লড়াই শুরু করে। তবে এদের লড়াই শান্তিপূর্ণ ছিল না, হাতে অস্ত্র তুলে নেয়। অনেকটা গেরিলা কায়দায় প্যারালাল মিলিটারি ফোর্স বানিয়ে ফেলে চাকমারা। পোশাকি নাম ছিল শান্তি বাহিনী।
এরা বাংলাদেশ সরকারকে বহুবার আলোচনায় বসার ডাক দেয়, কিন্তু সরকার তাদের পাত্তা না দিয়ে সেনা পাঠাতে থাকে। ১৯৮৬ সালে জুলাইয়ের মাঝামাঝিতে প্রেসিডেন্ট হুসেন মহম্মদ এরশাদ সংসদে জানিয়েছিলেন, এক হাজারের বেশি চকমাকে খতম করে দেওয়া হয়েছে।
এর পরেই দেশে অ্যান্টি চকমা সেন্টিমেন্টে হাওয়া লাগে। বাংলাদেশের একাংশ নাগরিক এদের বিশ্বাসঘাতক মনেই করতো, অস্ত্র তুলে নেওয়ার পর, সেই ভাবনায় আরও ঘি ঢাললো। ১৯৮৭ সালে বাংলাদেশ সরকার ব্যাপক অভিযান চালায় পার্বত্য চট্টগ্রাম জুড়ে। সেই সময়, প্রায় ৪৫ হাজার চকমা ও হাজোং ত্রিপুরায় ঢুকে পড়ে প্রাণ বাঁচাতে। আর এটা হয় মাত্র ১৫ দিনে। জায়গা নেয় ত্রিপুরার উদ্বাস্তু শিবিরে।
১৯৭২ সালে শান্তিবাহিনী, শেখ মুজিবর রহমানের সঙ্গে বৈঠক করেন। অভিযোগ, সেই সময় শেখ মুজিবর রহমান এই চকমাদের কর্মকাণ্ডের উপর প্রচণ্ড রেগে গিয়ে বলেছিলেন, তোমাদের কোনও কথা শুনবো না, তোমরা বাঙালি হয়ে যাও। সেই সময়ই সেনা পাঠানো হয়, অত্যাচারের রেকর্ড আন্তর্জাতিক মানবাধিকার কমিশন সংগঠনের নজরে আসে। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান হত্যার পর, বাংলাদেশ সেনা সমস্ত শক্তি দিয়ে এই চকমাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। এর পর, একাধিকবার চকমারা নানা সরকারের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করে, কিন্তু কেউই বিশেষ পাত্তা দেয়নি।
১৯৯৬-৯৭ সালে আওয়ামী লিগের সরকার ক্ষমতায় আসে, প্রধানমন্ত্রী হন শেখ হাসিনা, সেই সময় তিনি চকমাদের বিষয়টি প্রথম গুরুত্ব দেন। তিনি সি এইচ টি অ্যাকর্ড চুক্তি স্বাক্ষর করেন। ইংরেজদের তৈরি সি এইচ টি রেজোলিউশন মেনে নেন, শেখ হাসিনার সরকার। প্রতিশ্রুতি দেন, চকমাদের অধিকার সুরক্ষিত থাকবে। এই অঞ্চলে অন্য জায়গার মানুষেরা প্রবেশ করবে না। চুক্তির সময়, সরকারের তরফে বলা হয়, তাদের অস্ত্র ছেড়ে দিতে এবং তাদের স্বায়ত্তশাসন বা অটোনমি দেওয়া হবে।
এদিকে ১৯৯৭ সালে ভারতে সুপ্রিম কোর্ট একটি রায় দেয়, ভারতে যে চকমা বা হাজোং উদ্বাস্তু রয়েছে, তাদের নাগরিকত্ব দেওয়া হোক, যদিও এখনও সেটি কার্ষকর হয়নি। অন্যদিকে ১৯৯৭ সালে যখন বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে চকমাদের শান্তি স্বাক্ষর হয়, তখন ভারত সরকার চেষ্টা চালায়, বাংলাদেশে ফেরত পাঠাতে, কারণ বাংলাদেশ সরকার ওদের ফিরিয়ে নিতে উদ্যোগী হয়েছে। ২০০৩ সালে প্রায় ৬৫ হাজার উদ্বাস্তুকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হয়। চকমাদের অভিযোগ, তারা দেশে ফেরার পর চুক্তিমতো বাংলাদেশ সরকার ঠিকঠাক প্রতিশ্রুতি পালন করছে না।
মূল লড়াইটা যেখানে দাঁড়িয়ে রয়েছে
চাপা লড়াই এখনও রয়েছে মূলত, কেন্দ্র বনাম রাজ্যে। ১৯৯৭ সালে সুপ্রিম কোর্ট বললো চকমাদের নাগরিকত্ব দিতে। কিন্তু অরুণাচল প্রদেশের সরকার সেটা লাগু করতে পারেনি, কারণ রাজ্যের আদি মানুষেরা রাস্তায় নেমে পড়বে এই আশঙ্কায়। এই সময় ত্রিপুরা, অসম, অরুণাচলে চকমা গো ব্যাক স্লোগানে সরগরম হয়ে ওঠে। এর মাঝে ১৯৯৫ সালে অরুণাচলের কংগ্রেস সরকারের মুখ্যমন্ত্রী জোগং অপাং হুমকিও দেন, চকমাদের না সরালে ইস্তফা দিয়ে দেবেন। অন্যদিকে কেন্দ্রও জানায় তাদের পক্ষে এখুনি কোনও ব্যবস্থা করা সম্ভব নয়। তাই তখন থেকে কেন্দ্র রাজ্য লড়াই শুরু হয় চকমাদের নিয়ে।
২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ঘোষণা করেন, যাঁরা হিন্দু উদ্বাস্তু, তাঁরা ভারতে আসতে পারে। এমনকি নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল ২০১৬ পাস করেন। যদিও একটি কেবলমাত্র হিন্দুদের জন্য প্রযোজ্য, হলেও তার মধ্যে বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, জৈন, পারসিদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। কিন্তু মুসলিমদের জন্য নয়।
আরও পড়ুন- দেশে এমার্জেন্সি ও ইন্দিরা গান্ধীর গুপ্তধনের সন্ধান
২০১৫ সালে সুপ্রিমকোর্ট সরকারকে ডেডলাইন দিয়ে দেয়, যে চাকমা ও হিন্দু হাজোং উদ্বাস্তু রয়েছে অরুণাচলে, তাদের অবিলম্বে নাগরিকত্ব দেওয়া হোক। মানে ১৯৯৬ সালে যে রুলিং ছিল, সেটাকেই পুনর্প্রয়োগ করতে নির্দেশ দেওয়া হয়। এর ফলে ২০১৫ সাল থেকে অরুণাচলে চকমাদের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ আরও ব্যাপক আকার নেয়।
অরুণাচল ছাড়াও, মিজোরামে ব্যাপক ক্ষোভ রয়েছে চকমাদের বিরুদ্ধে। এদের চকমা বিদেশী বলা হয়, মিজোরামে, আর স্থানীয় যে উপজাতি রয়েছে, তাদের বক্তব্য এই চকমাদের সংখ্যা দিনের পর দিন লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। পরিসংখ্যান বলছে, চকমাদের সংখ্যা ১ লক্ষ পার করে গিয়েছে। এদিকে চাকমারা দাবি জানিয়েছে, তাদের আলাদা জায়গা দেওয়া হোক, চাকমাল্যান্ড করে সেটিকে কেন্দ্র শাসিত করা হোক। অরুণাচলে এখনও বহু চকমা উদ্বাস্তু শিবিরে রয়েছে। তাদের অবস্থা এখনও খারাপ, শিক্ষা, স্বাস্থ্যের কোনও পরিষেবার ছিটেফোঁটাও পায়নি তারা।
আরও পড়ুন- শ্রীলঙ্কার গৃহযুদ্ধ ও রাজীব গান্ধীর ভুল
২০১১ সালে বাংলাদেশে জনগণনা হয়, সেই রিপোর্ট অনুসারে, পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রায় ১৬ লক্ষ মানুষ রয়েছে। তাদের মধ্যে ৮ লক্ষ ৪০ হাজার রয়েছে চকমা ও অন্যান্য উপজাতি। আর ৭ লক্ষ ৬০ হাজার রয়েছে মুসলিম বা বাংলাদেশের অন্যান্য জায়গা থেকে আসা বাসিন্দারা।
পরিস্থিতি বিচার করলে, চকমাদের অবস্থা ভারতেও যেমন খারাপ, তেমন বাংলাদেশেও খারাপ, কেন্দ্র সরকার চাইলেও, রাজ্যের বিরোধিতায় সুস্পষ্ট রূপরেখা তৈরি করতে পারছে না। অন্যদিকে বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকা সংবেদনশীল এলাকা হিসেবেই রয়েছে গিয়েছে। অথচ বাংলাদেশের এই অঞ্চল প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর। পর্যটনের ক্ষেত্রে ব্যাপক সম্ভবনাময় এলাকা হলেও, পরিস্থিতি মাঝে মধ্যেই সরগরম হয়ে ওঠে। অপহরণ, খুন, লুঠের খবর প্রায় সংবাদমাধ্যমের শিরোনামে উঠে আসে।
আরও পড়ুন- কাশ্মীরের এক রহস্যময় গুহা, কীযোগ রয়েছে মহাভারতের সঙ্গে
Free Access